ট্রাম্প-কিম বৈঠক: অশ্বডিম্ব প্রসব?

সিঙ্গাপুরে মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের মধ্যে ঐতিহাসিক বৈঠক হয়। ছবি: রয়টার্স
সিঙ্গাপুরে মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের মধ্যে ঐতিহাসিক বৈঠক হয়। ছবি: রয়টার্স

সিঙ্গাপুরে গতকাল মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের মধ্যে ঐতিহাসিক শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। বৈঠকটি একটি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রমুক্ত কোরীয় উপদ্বীপ প্রতিষ্ঠার দুয়ার খুলে দেবে—এমন প্রত‍্যাশা থেকে বিশ্বব‍্যাপী পর্যবেক্ষকেরা আগ্রহের সঙ্গে এর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্বভাবসুলভ নাটকীয় ভঙ্গিতে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আসলেই একটি দারুণ বৈঠক করেছি। অনেক অগ্রগতি। আসলেই, অত্যন্ত ইতিবাচক। আমি মনে করি, অন‍্য যে-কারও প্রত্যাশার চেয়ে ভালো, একেবারে সেরা মানের। আসলেই ভালো।’

দুই নেতার যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই বিশ্বের শীর্ষ গণমাধ‍্যমগুলো আদৌ এ বৈঠক থেকে সারগর্ভ কিছু অর্জিত হয়েছে কি না—সেই উত্তর খোঁজার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের মতে, দুই নেতার আলোচনা থেকে সত্যিকারের সারবস্তু যদি বেরিয়ে এসে থাকে, তা হলো দুই দেশের প্রধান ও তাঁদের সফরসঙ্গীদের জন‍্য ‘কর্মমধ্যাহ্নভোজ’-এ পরিবেশিত ডার্ক চকলেট টার্ট।

দ্য নিউইয়র্ক টাইমস তার সম্পাদকীয় স্তম্ভে বলেছে, কূটনীতির মডেল হিসেবে সিঙ্গাপুরে শীর্ষ বৈঠকের সাফল্য ও ব্যর্থতার মুহূর্ত রয়েছে। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের একক শিল্পনৈপুণ্যের মঞ্চ হিসেবে একে দশে দশ দেওয়া যায়।

চুক্তি সম্পাদনে নিজের ‘বুলিং’ ক্ষমতার ওপর বরাবর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অগাধ আস্থা। কিমের সঙ্গে তাঁর লড়াইটা হবে ব‍্যক্তিত্বের, যেখানে তিনিই—ট্রাম্প—জিতবেন, এ কথাই এযাবৎ বলে এসেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। মনে রাখতে হবে, ট্রাম্প এমন এক ব্যক্তির ব‍্যাপারে এ রকম ভেবেছিলেন, যাঁর সম্পর্কে বাকি দুনিয়ার গতকালের আগে অবধি সে রকম কোনো ধারণাই ছিল না। এমনকি এখনো যথেষ্ট হয়েছে, সে কথা বলা যাচ্ছে না। মাত্র কয়েক দিন আগেও পশ্চিমা গণমাধ্যম তাঁকে ‘উন্মাদ’ প্রতিপন্ন করতে উঠেপড়ে লেগেছিল। আর এখন অনেকেই কিম জং-উনকে চতুর ভাবছেন।

সত্যি বলতে, আমেরিকার জাতীয় স্বার্থে বৈঠকটিকে সুযোগের অপচয় বলা চলে। বিশ্বের দরবারে নিজের বৈধতা আদায় করে নেওয়ার জন্য এ বৈঠক উত্তর কোরিয়ার ভীষণভাবে এর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বিনিময়ে কিছুই পাননি ট্রাম্প। যৌথ বিবৃতি স্বাক্ষরের পর বিবৃতিতে যা বলা হয়নি, সংবাদ সম্মেলনে সে কথাও ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, আলোচনা চলাকালে তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া বন্ধ রাখবেন। কার্যত, এটি বরাবরই কিম দাবি করে আসছিলেন। উত্তর কোরিয়ার জন্য এটি বিরাট ছাড়। তবে ট্রাম্প সম্ভবত সেভাবে দেখেন না বিষয়টি। তিনি বলেছেন, এতে আমেরিকার অর্থ ‘সাশ্রয়’ হবে। গুয়ামে আমেরিকার বিমানঘাঁটি থেকে বোমারু বিমান দক্ষিণ কোরিয়ায় উড়িয়ে আনা ‘অনেক ব‍্যয়সাধ‍্য’ হতো। এরপর ট্রাম্প যোগ করেন, একদিন তিনি মার্কিন সৈন‍্যদের কোরীয় উপদ্বীপ থেকে দেশে ফিরিয়ে আনতে চান। এমনকি তিনি কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চলাকালে সামরিক মহড়াকে ‘উসকানিমূলক’ বলেও অভিহিত করেন। তাঁর এই শেষ কথাটা যেন কিম জং-উনের থেকে ধার করা। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেও উত্তর কোরিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের যা কিছু কর্তৃত্ব থেকে থাকুক, গতকালের পর ট্রাম্প তা অনেকটাই খুইয়েছেন বলা যায়।

দুপুর অবধি আলোচনার পর দুই নেতা কোরীয় উপদ্বীপে ‘দীর্ঘমেয়াদি ও স্থিতিশীল শান্তি’ স্থাপনের লক্ষ‍্যে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ট্রাম্প ঘোষণা করেন, তিনি উত্তর কোরিয়াকে ‘নিরাপত্তার নিশ্চয়তা’ দিচ্ছেন। বিনিময়ে কিম কোরীয় উপদ্বীপকে বিপারমাণবিকীকরণে তার ‘দৃঢ় ও অবিচল প্রতিশ্রুতি’ দান করেন। দুই নেতা আরও বলেন, ঘোষণাটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব’ তাঁরা বিভিন্ন স্তরে আরও বৈঠক অনুষ্ঠান করবেন। বলতে কি, দীর্ঘ ঘোষণাটিতে প্রয়োগযোগ‍্য কোনো সুনির্দিষ্ট কথা নেই। বাগাড়ম্বরকে সারবস্তুতে রূপ দেওয়ার আসল দায়িত্বটা ভবিষ্যতে মাইক পম্পেও ও তাঁর শিষ্যদের সামলাতে হবে।

যৌথ বিবৃতির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে এতে অনুচ্চারিত থেকে যাওয়া বিষয়গুলো। উত্তর কোরিয়ার প্লুটোনিয়াম ও ইউরেনিয়াম কর্মসূচি বন্ধ, আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস, পারমাণবিক স্থাপনাগুলোয় পরিদর্শকদের ফিরে যাওয়ার অনুমতি প্রদান, উত্তর কোরিয়ার মানবিক অধিকার পরিস্থিতি—কিছুই এখানে নেই। ঠিক, সম্পূর্ণ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের পথে ‘বাস্তব অগ্রগতি’ অর্জিত না হওয়া অবধি উত্তর কোরিয়ার ওপর মার্কিন ও জাতিসংঘের অর্থনৈতিক অবরোধ বলবৎ থাকছে। কিন্তু বৈঠকটি যে আদৌ অনুষ্ঠিত হয়েছে, এই বাস্তব প্রমাণ করে যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে উত্তর কোরিয়ার ওপর চাপ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। অর্থাৎ, কার্যকর চাপের ফলেই কিম জং-উন আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়েছেন। এরপর সামনে এগোনোর জন্য নমনীয় রাস্তা ধরতে হবে। সন্দেহ নেই, কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি বজায় রাখতে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া এবার দেশটিকে কিছু ছাড় দেওয়ার জন্য অন্যদের সঙ্গে দেনদরবার শুরু করবে।

নিউইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট নিকোলাস ক্রিস্টফ মনে করছেন, আলোচনায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সম্পূর্ণ বোকা বানিয়েছেন কিম, এবং ভয়ের ব্যাপার হলো ট্রাম্প সেটা বুঝছেন না।

কিম জং-উনকে বিশ্বনেতার স্বীকৃতি দিয়ে, যুক্তরাষ্ট্র-উত্তর কোরিয়ার ‘নতুন সম্পর্ক’ স্থাপনের জন‍্য উদ্যোগ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে, যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়া যৌথ সামরিক মহড়া বন্ধ করে ট্রাম্প সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে উত্তর কোরিয়ার দীর্ঘদিনের পূর্বশর্তগুলোর অনেকটাই পূরণ করেছেন।

কিন্তু কিম জং-উন এগুলোর প্রতিদান দেননি। উত্তর কোরিয়া যদিও ‘সম্পূর্ণ বিপারমাণবিকীকরণ’ এবং ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষাস্থান ধ্বংস করার প্রতিশ্রুতি আবারও দিয়েছে, কিন্তু কবে নাগাদ তা করা হবে এবং সেই প্রক্রিয়ার সুযোগ কতটা রয়েছে, সেগুলো পরিষ্কার করেনি। ফলে অবৈধ পারমাণবিক অস্ত্রের মালিকরাষ্ট্র হিসেবে উত্তর কোরিয়ার অবস্থান অপরিবর্তিত থেকে গেলেও এ বৈঠক বিশ্বমঞ্চে কিম জং-উনকে রাষ্ট্রনায়কের মর্যাদায় আসীন করেছে।

বৈঠকে নাটকীয়তা ও এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব সত্ত্বেও প্রত‍্যাশানুগ ফল আসেনি। ফলে ঐতিহাসিক অর্জন হিসেবে এই বৈঠককে চিহ্নিত করতে ট্রাম্পকে বেগ পেতে হবে। কাজটা করার জন‍্য পম্পেও ও তাঁর বাহিনীকে মাথার ঘাম পায়ে ঝরাতে হবে। কিন্তু সে জন‍্য দরকার হবে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের সাহায্য, যাদের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বেয়াড়া আচরণে ইতিমধ্যে চটিয়ে রেখেছেন।

রওশন জামিল চৌধুরী, সাংবাদিক
[email protected]