হেঁয়ালির নাম প্রণব মুখোপাধ্যায়

নাগপুরে আরএসএসের সম্মেলনে বক্তব্য দেন প্রণব মুখোপাধ্যায়
নাগপুরে আরএসএসের সম্মেলনে বক্তব্য দেন প্রণব মুখোপাধ্যায়

শুরুতেই বলে রাখা দরকার, প্রত্যাখ্যাত হতে হবে জানলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ বা আরএসএস-প্রধান মোহন ভাগবত সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে নাগপুরে আমন্ত্রণ জানাতেন না। কারণ, প্রত্যাখ্যাত হলে তাঁদের সম্মানহানি হতো। বয়ে যেত সমালোচনার বন্যা। শুনতে হতো, এমন আদ্যন্ত একজন কংগ্রেসিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে মুখ পোড়ানোর কী দরকার ছিল?

এর অর্থ তাহলে কী? অর্থ এটাই, আপত্তি তো দূরের সম্ভাবনা, প্রণববাবু সাদরে সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করবেন এবং নাগপুরে যাবেন জানার পরই মোহন ভাগবত আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে এটাও স্পষ্ট, সম্মেলন নিয়ে প্রণববাবুর সঙ্গে মোহন ভাগবতের আগেই কথাবার্তা হয়েছে। বাকি ছিল আনুষ্ঠানিকতার। যেটা জানা দুষ্কর, নাগপুরে যাওয়ার আগ্রহটা কার বেশি ছিল? সংঘ পরিবার নাকি প্রণববাবুর? প্রস্তাবটা কোন দিক থেকে এসেছিল? সংঘের তরফ থেকে নাকি সাবেক রাষ্ট্রপতির দিক থেকে?

প্রশ্নগুলো উঠতে শুরু করেছে। কারণ, জন্মাবধি কংগ্রেসি প্রণব মুখোপাধ্যায়, যিনি রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে পর্যন্ত কংগ্রেসের নির্বাচনী ইশতেহারসহ এআইসিসি অধিবেশনের সব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও পররাষ্ট্রনীতি প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করে এসেছেন, ২০১০ সালে আরএসএস ও সংঘ পরিবারের ‘গৈরিক সন্ত্রাসের’ তদন্তের প্রস্তাবও পেশ করেছিলেন, ক্রমাগত সংঘকে সমালোচনায় বিদ্ধ করেছেন, মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার জন্য দায়ী করে এসেছেন, কী করে ও কোন যুক্তিতে তিনি নাগপুরের আমন্ত্রণে রাজি হলেন? উত্তরটা এখনো অজানা। কারণ, কেন নাগপুর যাচ্ছেন, তার কোনো রকম জবাবদিহি প্রণববাবু আজ পর্যন্ত করেননি। উত্তর দিতে তিনি বাধ্যও নন। এখন তিনি দলহীন। দলীয় অনুশাসন ও শৃঙ্খলা তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তিনি নিছকই এক ব্যক্তি।

আমন্ত্রণের খবরটা নাগপুর যাত্রার ১০ দিন আগে জানাজানি হওয়ামাত্র রাজনৈতিক মহলে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে প্রথমে জাগে বিস্ময়। তারপর শুরু হয় না যাওয়ার অনুনয়-বিনয়। রাষ্ট্রপতি হয়ে যাওয়ার সময় থেকে তিনি যে দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে এবং কংগ্রেসের সঙ্গেও ‘সম্পর্কহীন’, সেই সত্য বিস্মৃত হয়ে কেউ কেউ তাঁর কঠোর সমালোচনা করতেও ছাড়লেন না! তীব্র কটাক্ষ প্রণব-তনয়া শর্মিষ্ঠার টুইটেও।

মহিলা কংগ্রেসের এই নেত্রী হয়তোবা গান্ধী পরিবারের কাছে ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ থাকতে বাবার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলেন। বললেন, বাবা ওখানে গিয়ে ভালো ভালো যা কিছু বলবেন, মানুষ তা ভুলে যাবে। বেঁচে থাকবে তাঁর সংঘের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার ছবি। আর সেটাই হবে ওদের
প্রচারের হাতিয়ার।

ভারতীয় রাজনীতির অশীতিপর চাণক্যের এই সিদ্ধান্তকে কোনো কিছুই কিন্তু টলাতে পারেনি। প্রণববাবু নাগপুরে গেলেন। ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’–এর কথা বললেন। তুলে ধরলেন দেশের ‘বহুত্ববাদী ও বৈচিত্র্যপূর্ণ’ চরিত্রের কথা। জোর দিলেন ‘সহিষ্ণুতার’ ওপর। স্মরণ করিয়ে দিলেন ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’-এর (গোটা বিশ্বই এক পরিবার) আদর্শ এবং সেই আলোয় ব্যাখ্যা করলেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের। এসব কথা তিনি আগে বহুবার বলেছেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিদায়ী ভাষণেও বলেছেন।

বহুকথিত এসব কথা আরও একবার শোনানোর জন্য তাঁর আরএসএসের আতিথেয়তা গ্রহণের প্রয়োজন ছিল কি? প্রশ্ন এখানেই। কোন তাড়নায় তাহলে তাঁর নাগপুর সফর? শুধু কি এই বার্তা দিতে যে গণতন্ত্রে মতপার্থক্য থাকবেই, কিন্তু আলোচনার পথও খোলা রাখতে হবে? এই কথা বোঝাতে কি, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘এনগেজমেন্ট ইজ দ্য কি’? কিংবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আর যা-ই হোক, শত্রু হতে পারে না?

কোনো কোনো মহলের মতে, নাগপুরে গিয়ে প্রণববাবুর উচিত ছিল সরাসরি সংঘের ‘কট্টর হিন্দুত্ববাদী’ চরিত্রের সমালোচনা করা। বলতে পারতেন, সংঘের ‘ভারতীয়ত্বের সংজ্ঞা’ দেশের পক্ষে ক্ষতিকর। বলতে পারতেন, এই আদর্শ সমাজকে বিভক্ত ও দেশকে দুর্বল করে তুলছে। গান্ধী হত্যা প্রসঙ্গও তিনি তুলতে পারতেন। এই মহলের বোঝা উচিত, গৃহীর আমন্ত্রণ ও আতিথেয়তা গ্রহণ করে তাঁর আঙিনায় দাঁড়িয়ে তাঁরই সমালোচনা করাটা মোটেই শোভনীয় নয়। শিষ্টাচারও নয়। বার্তা তিনি যা দিতে চেয়েছেন, তা তাঁর ভাষণেই স্পষ্ট।

কিন্তু শুধু সেই বার্তা তো নয়! প্রণববাবু অন্য এক বার্তাও দিয়ে এসেছেন। সংঘের অনুষ্ঠানের মূল ভাষণের চেয়েও যা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের বাসভবনে যান।

ঘুরে ঘুরে সেই গৃহ দেখেন এবং দর্শকের মন্তব্য লেখার জাবেদা খাতায় লেখেন, ‘আই কেম হিয়ার টু পে রেসপেক্টস টু গ্রেট সন অব মাদার ইন্ডিয়া।’ ‘হেডগেওয়ার ভারতমাতার মহান সন্তান’, সক্রিয় রাজনীতির ৬০ বছরেও এ কথা প্রণববাবু কখনো বলেননি!

তাঁর উপস্থিতি যদি ষোলো আনা পূর্ণ করে, হেডগেওয়ার সম্বন্ধে প্রণববাবুর এই মন্তব্য তাহলে হয়ে দাঁড়াল আঠারো আনা উশুল। কংগ্রেসের কাছে এযাবৎ ‘অচ্ছুত’ আরএসএসকে নাগপুরে গিয়ে মান্যতা দিয়ে এলেন প্রণববাবু। রামচন্দ্রের স্পর্শে পাথর হয়ে থাকা অহল্যা প্রাণ ফিরে পেয়েছিলেন। অহল্যারূপী আরএসএসের কাছে প্রণববাবুই হয়ে দাঁড়ালেন সাক্ষাৎ রামচন্দ্র। ওই সমাবেশে মোহন ভাগবত সবাইকে মনে করিয়ে দিতে ভোলেননি যে ‘আরএসএস আরএসএসই থাকবে, প্রণব মুখোপাধ্যায়ও প্রণব মুখোপাধ্যায়ই থাকবেন। কিছুই বদলাবে না।’ কিন্তু তা বললেও তাঁরা অবশ্যই উৎফুল্ল প্রণববাবুকে দিয়ে এত দিনের ‘অস্পৃশ্যতা’ দূর করতে পেরে। ভোঁতা হয়ে গেল সংঘ ও বিজেপির বিরুদ্ধে হেনে চলা কংগ্রেসের এত দিনের ব্রহ্মাস্ত্র। রাহুল গান্ধীসহ কংগ্রেসের নেতারা এখনো নিয়মিত আরএসএসকে আক্রমণ করে চলেছেন। নাগপুর-বৃত্তান্ত অবশ্যই সেই সমালোচনাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাবে।

সংঘ পরিবারের কাছে লালকৃষ্ণ আদভানির যে হাল হয়েছিল, কংগ্রেসিদের কাছে প্রণববাবুর হালও হতে চলেছে ঠিক সেই রকম। পাকিস্তানে গিয়ে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে ‘মহান পুরুষ’ বলেছিলেন আদভানি। সেই মন্তব্য সংঘের সঙ্গে আদভানির দূরত্ব সৃষ্টি করেছিল। প্রণববাবুও সেই রকম অলঙ্ঘনীয় এক দূরত্ব তৈরি করে ফেললেন কংগ্রেস এবং বিশেষ করে গান্ধী পরিবারের সঙ্গে। আদভানি আজ উৎফুল্ল। প্রণববাবুকে সমর্থন করে তিনি বলেছেন, নাগপুর সফর ‘সমসাময়িক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা’। কংগ্রেসের মুখ কালো হতে আর কী চাই?

কিন্তু আনখুশির কংগ্রেসি প্রণব মুখোপাধ্যায় জীবনসায়াহ্নে এসে কেন এমন কিছু করবেন, যা কংগ্রেসের মাথা হেঁট করে দেবে? রাজধানীর রাজনীতির অলিন্দের আলোচ্য বিষয় এখনো এটাই। জনশ্রুতি, ইন্দিরা গান্ধী মারা যাওয়ার পর তিনি নাকি প্রধানমন্ত্রী হবেন আশা করেছিলেন। আশাবাদী হওয়া সত্য না মিথ্যা, তিনিই জানেন।

তবে তাঁর তিন খণ্ডের আত্মজীবনী দ্য কোয়ালিশন ইয়ার্স-এ লিখেছেন, ২০০৪ সালে ভেবেছিলেন তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করে মনমোহন সিংকে রাষ্ট্রপতি করা হবে। প্রধানমন্ত্রী হতে না পারার যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়ে তিনি রক্তাক্ত হয়েছেন। ইন্দিরা গান্ধীর অকৃপণ স্নেহ শেষ দিন পর্যন্ত পেলেও পরবর্তী গান্ধী প্রজন্মের বিশ্বস্ত সেভাবে তিনি হতে পারেননি। ২০১২ সালের যে পরিস্থিতিতে তিনি রাষ্ট্রপতি হন, তা তৈরির কৃতিত্ব তাঁরই। রাইসিনা হিলসে তাঁকে না পাঠিয়ে সোনিয়া গান্ধীর উপায় ছিল না।

কংগ্রেসের যে রাজনৈতিক ‘অবিচারের শিকার’ তিনি, এই নাগপুর-বৃত্তান্ত তাহলে কি তারই মধুর প্রতিশোধ? বিশেষ করে ২০১৯-এর প্রাক্কালে? এই প্রশ্নও বিপুলভাবে চর্চিত। ঢাকঢাক গুড়গুড় না করে শিবসেনা তো বলেই দিয়েছে, ২০১৯-এ বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে (যা না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বিজেপির সবকিছুই এখন নিম্নমুখী) সর্বসম্মত গ্রহণযোগ্য প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিত প্রণববাবুরই। প্রণব-তনয়া শর্মিষ্ঠা এই সম্ভাবনা নস্যাৎ করেছেন। কিন্তু তবু জল্পনা থেমে নেই।

বলাবলি হচ্ছে, তবে কি ৮২ বছর বয়সে প্রণববাবু নিজেকে মাহাথির মোহাম্মদের ভূমিকায় দেখতে আগ্রহী? ৯৩ বছর বয়সে মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ার কান্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ। প্রণববাবুর বয়স তো আরও ১০ বছর কম! তা ছাড়া ভারতের সংবিধানে কোথাও লেখা নেই, একবার কেউ রাষ্ট্রপতি হয়ে গেলে সক্রিয় রাজনীতিতে ফেরার পথ তাঁর জন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।

প্রণববাবুর নাগপুর ভ্রমণ আপাতত সমকালীন ভারতীয় রাজনীতির সেরা হেঁয়ালি হয়ে রইল।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি