পাহাড়ধসে মৃত্যু

গত বছর যে দিনটিতে রাঙামাটিতে পাহাড়ধসে ১২০ জন মানুষের জীবনপ্রদীপ নিভে গিয়েছিল, চলতি বছরে সেই দিনটিতে একই ঘটনায় নানিয়ারচরে ১১ জনের প্রাণহানিকে কাকতাল ভাবার কোনো কারণ নেই। এটি হলো আমাদের সম্মিলিত মূঢ়তা, অক্ষমতা ও দায়িত্বহীনতার অন্যতম উদাহরণ। প্রতিবছরই বর্ষার মৌসুমে পাহাড়ধসের ঘটনায় একের পর এক নারী, পুরুষ ও শিশু মারা গেলেও এর প্রতিকারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের প্রতিবেদন মতে, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের লাখ লাখ মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করে। সাউথ এশিয়া ডিজাস্টার প্রতিবেদনেও বাংলাদেশকে ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এসব দুর্যোগ নিবারণের দায়িত্ব যাদের, সেই ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় কী করছে? পাহাড়ধসে মানুষ মারা গেলে স্বজনদের হাতে কিছু টাকা তুলে দেওয়াই কি তাদের একমাত্র কাজ?
পাহাড়-টিলা কাটা, বৃক্ষনিধন, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে থাকে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে বলা হয়েছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া ‘ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করা যাবে না।’ বাংলাদেশের পাহাড়গুলো প্রধানত মাটিতে তৈরি এবং গাছের শিকড়ই একে সুরক্ষা দিয়ে থাকে। কিন্তু একশ্রেণির বনখেকো মানুষ পাহাড় থেকে নির্বিচারে গাছপালা কেটে নিয়ে যায়। গত বছর পাহাড়ধসের পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে যে উচ্চপর্যায়ের কমিটি করা হয়েছিল, তারা পাহাড়ে গাছ কাটা বন্ধের সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সুপারিশটি এখনো আইনে পরিণত করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার। ফলে স্থানীয় প্রশাসনও নির্বিকার। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে পাহাড়ধসের সংকেতযন্ত্র থাকলেও তিন পাহাড়ি জেলায় সে রকম কোনো ব্যবস্থা করতে না পারাও মন্ত্রণালয়ের আরেকটি ব্যর্থতা বলেই মনে করি।
প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, গত বছর যেসব এলাকায় পাহাড়ধসে ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছিল, সেসব ছিল অপরিকল্পিত ও অনিরাপদ। মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে ‘ভূমি দখল ও অবৈধ বাসস্থান’ নির্মাণকে ধসের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। অথচ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বলেছেন, ‘সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু চলছে।’ কিন্তু তাঁরা এক বছরেও মন্ত্রণালয়ের কমিটির সুপারিশগুলো আইনে পরিণত করতে পারলেন না। এটাই হলো মন্ত্রণালয়ের সবকিছু সঠিকভাবে চলার নমুনা।
সমস্যা এড়িয়ে বা অস্বীকার করে নয়, সমস্যা স্বীকার করেই দ্রুত সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা দেখানোর আগে মন্ত্রণালয় নিজেকে দুর্যোগমুক্ত করুক।