বাতিলের খাতায় ৮০ হাজার মানুষ

নন–এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক–কর্মচারী ফেডারেশন গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নিলে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়।  ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ
নন–এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক–কর্মচারী ফেডারেশন গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নিলে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

যখন রাষ্ট্রের বেতনভোগীরা ঈদ উৎসবের কেনাকাটায় ব্যস্ত, তখন আমাদের শিক্ষকেরা বেতনের দাবিতে রাজপথে। আশরাফ সিদ্দিকীর ‘তালেব মাস্টার’ কবিতার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। কবিতায় তালেব মাস্টার কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনুরোধ করেছিলেন, ‘আমার অনুরোধঃ আপনি আরও একটি বই লিখুন/ আপনার সমস্ত দরদ দিয়ে তাকে তুলে ধরুন/ আর, আমাকেই তার নায়ক করুন!/ কোথাও রোমান্স নেই। খাঁটি-করুণ বাস্তবতা/ এবং এই বাংলাদেশেরই কথা।’ এ কবিতায় তালেব মাস্টার কম মাইনে পাওয়া একজন শিক্ষক। মাইনে কম পাওয়ার কারণে তাঁর জীবনে অসংখ্য করুণ ঘটনা ঘটেছে। কবিতাটি পড়লে যেকোনো পাষাণের হৃদয়ও বেদনায় সিক্ত হয়। তবুও তো সেই তালেব মাস্টার বেতন পেতেন। তাহলে যাঁরা বেতন একেবারেই পান না, তাঁদের কষ্টের মাত্রা অবশ্যই তালেব মাস্টারের চেয়েও বেশি। আমাদের দেশে এখন তালেব মাস্টারের চেয়েও করুন জীবনযাপন করা শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার।

সরকারি চাকরিজীবীদের নতুন বেতনকাঠামো হয়, ফিবছর তাঁদের বেতন বাড়ে, তাঁরা বৈশাখী ভাতা পান, ঈদ বোনাস পান, বাড়ি করার জন্য কম সুদে লাখ লাখ টাকা ঋণ পান, মোবাইল কেনার জন্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জন্য পৌনে লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়, গাড়ি কেনার সহজ সুবিধা পান, অবসরে গেলে অবসর ভাতা পান। স্বামী মারা গেলে স্ত্রী আর্থিক সুবিধা লাভ করেন। দেশের হাজার হাজার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি হলো। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে যে শিক্ষকেরা বেতন পান না, তাঁদের বেতনের কোনো ব্যবস্থাই হয় না। বিনা বেতনে চাকরিজীবন শেষ করে অবসরে যাচ্ছেন অনেকেই। সরকার যদি শিক্ষকদের শ্রমের মূল্য না দেয়, তাহলে এই ৮০ হাজার শিক্ষক কোথায়, কার কাছে যাবেন?

সরকার বয়স্ক ভাতা দেয়, বিধবা ভাতা দেয়, বন্যার্তদের মাঝেমধ্যে আর্থিক সুবিধা দেয়। কিন্তু নন-এমপিও শিক্ষকেরা সরকারের কোনো ভাতাও পান না। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাঁরা চাকরি করেন, সেটা কি তাঁদের অপরাধ? বেতন না পাওয়া কি তাঁদের শাস্তি? দেশের এই একটি মাত্র বিভাগ, যেখানে বিনা বেতনে শ্রম কেনা সম্ভব হচ্ছে। পোশাক কারাখানায় ঈদের বোনাস যথাসময়ে দেওয়া না হলে যে সরকার মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চায়, সেই সরকার কী করে বিনা পারিশ্রমিক শ্রম কেনে, সেটা সহজবোধ্য নয়।

রাষ্ট্র আজ ঋণী সেই শিক্ষকদের কাছে, যাঁরা বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাচ্ছেন। এই ঋণ যদি সরকার পরিশোধ না করে, তাহলে ওই শিক্ষকদের প্রতি সরকারের অবিচার করা হবে। অনেক শিক্ষক এক দিনও বেতন না পেয়ে অবসরে যাচ্ছেন—এটা কি ভাবা যায়? সারা জীবন শুধু পরিশ্রম করে গেলেন। তাও সরকার অনুমোদিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এসব শিক্ষকের জীবনে কত করুণ কাহিনি রচিত হয়েছে, তার হিসাব কি সরকার রাখে?

ঈদসহ যেকোনো উৎসব তাঁদের জন্য বিভীষিকাময়। কত শিক্ষক যে না খেয়ে সারা দিন পাঠদান করেন, তার অন্ত নেই। ভাবুন তো, এসব শিক্ষকের সন্তান আছে, স্ত্রী আছে, বৃদ্ধ বাবা-মা আছে, আত্মীয়-স্বজন আছে। এঁরা কি কোনো দিন প্রাণখোলা হাসিতে তাঁদের সামনে দাঁড়াতে পেরেছেন? সন্তানেরাও নিশ্চয় জেনে গেছে উৎসবে বাবার কাছে কোনো আবদার করা যাবে না। তারা আবদার করে বাবাকে বিব্রত করে না। স্ত্রীও কোনো রকম জীবনটা পার করে দেওয়ার অপেক্ষায় আছেন। এই শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার সামর্থ্য সরকারের নেই—এ কথা একেবারেই মানা সম্ভব নয়।

এই শিক্ষকেরা যখনই আন্দোলন করতে যান, তখনই বাধা দেওয়া হয়। শিক্ষকদের পক্ষে তো সহিংস হওয়া সম্ভব নয়। তাঁদের অহিংস আন্দোলনে সরকার এত ভয় পায় কেন? তাঁরা তো সবচেয়ে দুর্বল ধরনের কর্মসূচি দেন। তাঁরা বলেন, বেতন না দিলে তাঁরা অনশন করবেন। প্রতিদিন তো কত শিক্ষক বাধ্য হয়ে না খেয়ে থাকেন, সেটাই নাহয় নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে করেন। আর তা ছাড়া এসব শিক্ষককে তো সরকার খাওয়ার টাকা দেয় না। সুতরাং তাঁদের না খেয়ে থাকার কর্মসূচিটাই সবচেয়ে সহজ। এখনো তাঁরা ঢাকায় আছেন বেতনের দাবিতে। যখন রাষ্ট্রের বেতনভোগীরা ঈদ উৎসবের কেনাকাটায় ব্যস্ত, তখন আমাদের শিক্ষকেরা বেতনের দাবিতে রাজপথে। রাষ্ট্রের কদর্য রূপ ক্ষণিক চাপা দিয়ে রাখা যেতে পারে। কিন্তু কদর্য রূপ দূর না করলে বিস্ফোরিত হতে বাধ্য।

মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন, একজন শিক্ষকও যেন না খেয়ে না থাকেন, সেই ব্যবস্থা করুন। অনেক দিন ধরে বিনা বেতনে শ্রম দেওয়া শিক্ষকেরা আন্দোলন করছেন। সরকারের আশ্বাসে তাঁরা কর্মসূচি স্থগিত করেছিলেন। আমরাও জেনেছিলাম, এ বছর তাঁদের এমপিওভুক্ত করা হবে। সেই আশায় বুক বেঁধেছিলেন নন-এমপিও শিক্ষক ও তাঁদের পরিজন। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেটে সেই ঘোষণা অনুপস্থিত। ৮০ হাজার শিক্ষককে বিনা বেতনে রেখে আমাদের দেশ উন্নয়নশীল দেশ!

শিক্ষকদের প্রতি বৈষম্যপূর্ণ আচরণ আমাদের দেশীয় রীতিতে পরিণত হয়েছে। আবার তাঁদের পড়ানো স্কুল-কলেজে রেজাল্টের দিন আনন্দের বন্যাও বয়ে যায়। মনে চাপা কষ্ট রেখে সেই উৎসবে শিক্ষকেরাও হয়তো অভিনয় করেন। আর মনে মনে তীর্থের কাকের মতো দীর্ঘ অপেক্ষা—একদিন হয়তো কষ্টের অবসান হবে।

সরকারের কাছে আমরা বেতন না দেওয়ার পক্ষে কোনো কথাই শুনতে চাই না। যাঁরা যত দিন ধরে চাকরি করেন, তাঁদের বকেয়াসহ বেতন নিয়মিত দেওয়ার ব্যবস্থা করাই আইনসংগত। অপচয়, দুর্নীতি, প্রচারাভিযানে কত টাকা ব্যয় হয়, কেবল শিক্ষকের খোরাকের বেলায় টানাটানি! যে জাতি শিক্ষাগুরুকে সামাজিক-মানসিক-আর্থিকভাবে হেয় করে রাখতে দ্বিধা করে না, সে জাতি যত উন্নতি করুক না কেন, তাকে সভ্য জাতি বলা সম্ভব নয়। আমরা উন্নয়নের যে মুখোশ পরে আছি, সেটি আমাদের প্রকৃত উন্নয়ন নয়। আমাদের মুখশ্রী সুন্দর হলে আর মুখোশের প্রয়োজন হবে না। মুখশ্রী সুন্দর করতে হলে রাষ্ট্রে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শিক্ষকদের ন্যায্য অধিকার দিতে হবে। তাঁরা বেতন না পাওয়ায় পাঠদানে পূর্ণমাত্রায় মনোনিবেশ করতে পারছেন না। এতে রাষ্ট্রেরই ক্ষতি হচ্ছে। এ ক্ষতি থেকেও দেশকে রক্ষা করা জরুরি।

তুহিন ওয়াদুদ: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক।