বাদাবনের মেয়ে বৃষ্টি ও অন্যদের কথা

বাদাবনের মেয়ে বৃষ্টি। দৃষ্টিতে তির বেঁধা হরিণীর কাতরতা। ছোটবেলা থেকে জল-জঙ্গলের সঙ্গে ওর যুদ্ধ। সঙ্গে আছে সীমাহীন দারিদ্র্য। বাবা বাদাবনে 

মাছ ধরেন, মধু ভাঙেন। সুন্দরবনের বাঘকে ওরা ভয় পায় না, কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই যে পুরুষরূপী বাঘ থাবা বসিয়েছে ওর শরীরে। সবে ক্লাস ফোরে পড়ে ও। ছেঁড়াখোঁড়া অপরিণত শরীর নিয়ে কাতরাচ্ছে ওসিসিতে।

গতবার জলোচ্ছ্বাসে ঝড়ে ভেসে আশ্রয় নিয়েছিল ওর প্রিয় স্কুলের নিচের সাইক্লোন শেল্টারে। ওই স্কুলঘরের পাশেই নদীতে বাঁধ দেওয়া দেখতে গিয়েছিল দুরন্ত বালিকা। এবারে পুরুষরূপী বাঘের থাবার চিহ্ন নিয়ে ওসিসিতে। যৌনাঙ্গে ছয়টি সেলাই লেগেছে ওর। রক্ত চার ব্যাগ। ক্ষত শরীরে ও মনে। খবর পেয়ে ছুটলাম ওসিসিতে। ওর বর্ণনা শুনে প্রতিটি লোমকূপ শিউরে উঠেছে, মনুষ্যত্বের চরমতম পরাজয়ের গ্লানিতে মাথা হেঁট হয়েছে। আসামি ধরা পড়েছে, মামলা হয়েছে, চিকিৎসাসেবাও পেয়েছে। শিগগির হয়তো শরীরের ক্ষত শুকাবে, কিন্তু মনের ক্ষত? শুকাবে কি?

একটা করে ধর্ষণ, হত্যা-সহিংসতার খবর—একজন করে তনু, রূপা, পূজা, খাদিজা, রিশার শিরোনাম হওয়া। প্রতিবাদে-প্রতিরোধে, ব্যানারে-ফেস্টুনে রাজপথে ঝড় বয়ে যাওয়া। ঝড় শেষে আবার স্থিতাবস্থা। আবার ঘটনার পুনরাবৃত্তি।

পত্রিকা পড়তে গিয়ে সদ্য বয়ঃসন্ধিতে পা রাখা ছেলেটা হঠাৎ দুম করে প্রশ্ন করে ফেলল, ‘আচ্ছা মা, ধর্ষণ কী? এটা কি খুনের থেকে বেশি কিছু? খুব বেশি কি যন্ত্রণাদায়ক?’ বিব্রত, স্তম্ভিত মা। সামাজিক মাধ্যমে এখন সর্বাধিক ব্যবহৃত শব্দ ধর্ষণ। হুমকির মুখে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।

একটা সময় চলচিত্রে ‘ধর্ষণদৃশ্য’ দেখানো ছিল অবধারিত। মর্মার্থ না জানলেও বিষয়টি ছিল চরম অস্বস্তিকর। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হিসেবে, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের প্রতিনিধি হিসেবে ‘ধর্ষণ ও ধর্ষিতা’ শব্দ দুটির সঙ্গে বেশ পরিচিত। এর অন্তর্নিহিত বেদনা, প্রতিটি অক্ষরে ধারণ করা অবমাননা—সবকিছুই তীব্রভাবে অনুভূত হয়।

ওসিসিতে রক্তাক্ত ধর্ষিতা যখন দাঁতে দাঁত চেপে তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে সামাজিক মর্যাদাহানির ভয়ে মামলা করতে অপারগতা জানায়, তখন সমাজের সদস্য হিসেবে অসহায় লাগে। আমরা দেখছি ছয় বছরের শিশুকে ধর্ষণ করছেন আপন ফুপা, দেখছি আট মাসের শিশুসন্তানকে হত্যা করতে। মামলা হচ্ছে, আসামি ধরা পড়ছে, বিচারে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে। কিন্তু মহামারি কমছে কি? এর সবটাই এক যৌন বিকারগ্রস্ততা। আট মাসের শিশুটিকে কেন এবং কোন মানসিকতায় থাকলে ধর্ষণ করার মানসিকতা জাগে? আমাদের সমস্যার গোড়ায় পৌঁছাতে হবে।

সমস্যা আসলে গোড়াতেই, অর্থাৎ সমাজবদ্ধ পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে। এখন সময় এসেছে সামগ্রিকভাবে সমাজকে সংবেদনশীল করে তোলার। এত দিন শুধু ভিকটিম সচেতনতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। মেয়েদের আত্মরক্ষার কলাকৌশল শেখানো, অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি, সর্বোপরি জাতীয় হেল্পলাইনগুলোও এখনো ধর্ষিতাকে রক্ষা করতে সম্পূর্ণভাবে হাত বাড়াতে সক্ষম হয়নি।

এখন সন্তানেরা আমাদের কাছ থেকে বেশি কিছু প্রত্যাশা করে। নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরকালের। যৌনতা ও ধর্ষণ-সম্পর্কিত আলোচনা নিঃসন্দেহে চরম অস্বস্তি ও বিব্রতকর। আমাদের দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে তো আরও বেশি বিড়ম্বনার। বর্তমানে পাঠ্যক্রমে যৌন-সংক্রান্ত বিষয়বস্তু সংযোজন করা হয়েছে। তার পাশাপাশি বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সংবেদনশীল করে তোলাটাও অভিভাবকের নৈতিক দায়িত্ব। যৌনতার পাশাপাশি অন্যের মতামতের গুরুত্ব দেওয়া, নারীকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা—এ বিষয়গুলোতে সন্তানকে মানবিক করে তুলতে হবে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ‘আ গুড ম্যান প্রজেক্ট’, ‘রেপ ফ্রি ক্যাম্পাস’, ‘ভয়েস অ্যাগেইনস্ট রেপ’, ‘আ ম্যান হু কেন স্টপ দ্য রেপ’—এ ধরনের বিদ্যালয়ভিত্তিক গণসচেতনতামূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন জরুরি।

এই পৃথিবীতে বিনোদনের কত মাধ্যম আছে, আনন্দ খুঁজে নেওয়ার কত উপকরণ আছে...প্রকৃতি আছে, বই আছে, সংগীত আছে, চিত্রকলা আছে, নাটক-সিনেমা আছে, ভ্রমণ আছে, আড্ডা আছে, রেস্তোরাঁ আছে—কত কিছু। অথচ এই আধুনিক যুগে পৌঁছেও কিছু মানুষ আদিমই রয়ে গেছে। তাদের কাছে বিনোদনের একমাত্র উৎস যৌনতা।

আমাদের সন্তানকে সুস্থ বিনোদনের উৎস খুঁজে দেওয়া, তার কৌতূহলী মানসকে সঠিক পথে চালনা করার দায়িত্ব আমাদেরই। ধর্মীয় অনুশাসন যাতে গোঁড়ামিতে পরিণত হয়ে সন্তানের মনের মানবিক বিকাশকে অবরুদ্ধ করতে না পারে, তার চিন্তার আকাশটিকে সীমাবদ্ধ না করতে পারে—এ দায়িত্ব পরিবারকেও নিতে হবে। আসুন, সবাই মিলে সচেতন নাগরিকের ভূমিকাটুকু পালন করি। সচেতন নাগরিকেরা পারে রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বোত্তম সেবা নিশ্চিত করতে।

গণজাগরণ তৈরি হোক ‘ধর্ষণ’ নামক অসুস্থ ব্যাধির বিরুদ্ধে। আর ধর্ষকের বিরুদ্ধে জাগ্রত হোক সামাজিক ঘৃণা। আসুন, আপনার কন্যাশিশুটি নিরাপদে রাখার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক সন্তানকে একজন সংবেদনশীল, মুক্ত প্রাণের অধিকারী করে গড়ে তুলুন।

সোনালী সেন খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার