চাঁদরাতের চাওয়া-পাওয়া

চাঁদটা ফি বছর রোজার ঈদের ঠিক আগের দিনই কেন ওঠে? ছোটবেলায় এই প্রশ্ন সারাক্ষণ খোঁচাত। বড়দের জিজ্ঞাসা করলে ধমক মিলত, ‘যা তো, জ্বালাসনে! যত সব আবোলতাবোল প্রশ্ন! ঈদের আগের দিন চাঁদ ওঠে কেন, এখন বুঝবি না, বড় হলে বুঝবি!’
বড় হলে সবাই বোঝে। তবে একেকজনের বুঝ হয় একেক রকম।
প্রতিবছরই রোজা শেষে একই কায়দার চাঁদ ওঠে। একই মেজাজে আমরা গোধূলিবেলায় আকাশে তাকে তালাশ করি। একই কায়দায় দৃষ্টিসীমায় সে ধরা দেয়। তাকে দেখে আমরা একই তরিকায় কোলাকুলি করি। বিগলিত হই। এই আনন্দ আটপৌরে। এই বিনোদন ঐতিহ্যসঞ্জাত।
পশ্চিম আকাশের অস্পষ্ট ‘হেলাল’ স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, কাল ঈদ। কেউ খালি হাতে ফিরবে না। সবার নামে আনন্দ বরাদ্দ হয়েছে। টিমটিমে আলো জ্বলা নিভৃত গ্রামে বসে কত মা দূর শহরে থাকা সন্তানের বাড়ি আসার আশায় মাসের পর মাস পার করেছেন! কত সন্তান বাবার জন্য, কত বাবা সন্তানের জন্য, কত স্ত্রী স্বামীর জন্য, কত মানুষ মনের মানুষের জন্য অপেক্ষায় থেকেছে।
এই চাঁদ একঝলক উঁকি দিয়ে বলে যাবে, অপেক্ষার শেষ হয়েছে। এবার মিলনের ক্ষণ। শহর থেকে ছেলে বাড়ি আসছে; বাবা বাড়ি আসছেন; স্বজন ফিরে আসছে।
বাস-ট্রেন ঠেঙিয়ে চাঁদরাতে বাড়ি ফেরে কতজন। আমবাগান পার হয়ে, কাশবন ডিঙিয়ে কেউ পৈতৃক ভিটেয় ফিরতে থাকে। অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে ‘বিপন্ন বিস্ময়ে’ দেখতে থাকে ‘দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া’। পথের পাশে হয়তো পড়ে ছেলেবেলার বন্ধুর বাড়ি। যাওয়ার সময় ‘অবনী, বাড়ি আছো!’ হাঁক দিতে দিতে ঘরে ফেরার মধ্যেই তার ঈদের আনন্দ। এতেই তার চাঁদ দেখার আনন্দ।
বাপের ভিটেয় একটা জুতসই টিনের ঘর দেওয়ার আশায় যে ছেলেটা সৌদি আরব গেছে; রাতদিন খেটেও আকামার টাকা পর্যন্ত জোগাড় করতে পারেনি; সেও সব হতাশা চেপে গিয়ে হাসি হাসি গলায় মাকে ফোন করবে:
—মা গো, চান কি দেহা গেইছে? আমরা তো আইজ ঈদ করলাম। ঈদের আগে তো পারলাম না, সামনের শুক্কুরবারে ছিরু মোল্লার দোকানে খোঁজ নিয়ো। টাকা পাঠায়া দেবোনে!
ফোনের ওপাশ থেকে প্রথম মিনিট দুয়েক শুধু কান্নার আওয়াজ আসবে। মায়ের চিরায়ত গোঙানির ফাঁকে ফাঁকে ‘আব্বা! আব্বা!’ ছাড়া আর কোনো কথা শোনা যাবে না। ‘বাজিল বুকে সুখের মতো ব্যথা’র মতো আবেগমথিত ব্যথাতুর সুখে মা ও ছেলে ভেসে যাবে।
এবারও হয়তো নবজাতক চাঁদ তুলোট মেঘের ফাঁকে ফুচকি মারবে। অযুত-নিযুত উল্লসিত মানুষের ভিড়ে নামহীন, পরিচয়হীন, ছিন্নমূল উলঙ্গ শিশুটিও তালি বাজাবে। তালির শব্দে তার বঞ্চনা-বিষাদ কয়েক মিলিসেকেন্ডের জন্য চাপা পড়ে যাবে। সে-ও জানবে, রাত পোহালেই ঈদ। কাল উপোস করতে হবে না।
নতুন চাঁদকে সামনে রেখে লাখো শ্রমিক তাঁর বেতন-বোনাসের অধিকারের কথা তোলেন। নজরুল যেমন ঈদের চাঁদকে প্রাপ্য বুঝে নেওয়ার প্রেরণা হিসেবে দেখেছিলেন। ধনীর সম্পদে গরিবের অধিকার যে জাকাত, নজরুলের কাছে সেই জাকাত আদায়ের হাতিয়ার হলো এই চাঁদ। নজরুলের চোখে এই চাঁদ ছুরির মতো। অস্ত্রের মতো। দস্যুর মতো। সে অধিকার ছিনিয়ে নেয়: ‘আমাদের বাঁকা ছুরি আঁকা দেখ/আকাশে ঈদের চাঁদ...জাকাত লইতে আসমানে এল আবার ডাকাত চাঁদ।’ এই চাঁদ অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার আনন্দ ঢেলে দেয় বিপ্লবী প্রলেতারিয়েতের বুকে।
ঈদের আনন্দ-অনুভূতি মৌলিক হলেও সেই আনন্দ প্রকাশের ধরন কিন্তু ‘যৌগিক’; মানে ভঙ্গিটা আলাদা।
চাঁদ দেখার পর মহানগরের মহল্লার মোড়ে মোড়ে লাউডস্পিকার চিল্লায়। মোড়ে মোড়ে হাই ভলিউমে হিন্দি গানের ফাঁকে ফাঁকে ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’র রিমেক বাজে। ঝাঁক ঝাঁক তরুণের অস্থির নাচ চলে। চলে বেধড়ক ধূমপান। সেই নাগরিক উন্মাতাল মহল্লা থেকে দুই-তিন শ কিলোমিটার দূরের কোনো গ্রামে তখন হয়তো কোনো একদল কিশোর অন্ধকারে তারাবাজি পোড়াচ্ছে। আলো-আঁধারিতে চকচক করছে তাদের ঘর্মাক্ত গ্রাম্য দেহ।
গত ঈদ মা-বাবার সঙ্গে কেটেছে। এ বছর বাবা নেই, কিংবা মা নেই। কিংবা দুজনেরই কেউ নেই। চাঁদের দেশে চলে গেছেন তাঁরা। সম্প্রতি এতিম হওয়া এমন কাউকেও বঞ্চিত করে না ঈদের চাঁদের হাসি। চাঁদে চোখ পড়তেই দরদর করে মুক্তোর ফোঁটা ঝরে তার বুক ভেসে যাবে। অঝোর কান্নায় বুক থেকে নেমে যাবে কষ্টপাথর। পরম করুণাময়ের কাছে হাত তুলে সে বলবে, ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সগিরা’। হঠাৎ মনে হবে, সে অভিভাবকহীন নয়। সে এতিম নয়। পরপারে চলে যাওয়া মা-বাবা তার চারপাশে আছেন। তাঁরা তাঁদের অশরীরী উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন।
ঈদের চাঁদের কাছে এর বেশি কী-ই বা চাওয়ার আছে? এর বেশি কে চায়?

সারফুদ্দিন আহমেদ, প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
sarfuddin 2003 @gmail. com