রানা, কোমো ইশতা?
রানা, কোমো ইশতা? কোমো কে এ আতুয়া কোমোনিদাদ? ইশতা তু দু বের? (রানা, তুই কেমন আছিস? তোর কমিউনিটি কেমন আছে? সবকিছু ঠিক আছে?)
এই রানা হলেন রানা তাসলিম উদ্দিন। আর যিনি কুশলাদি জিজ্ঞেস করছেন, তাঁর নাম অ্যান্টোনিও কস্তা।
রানা তাসলিম ইউরোপের দেশ পর্তুগালের রাজধানী লিসবন সিটি করপোরেশনের একজন নির্বাচিত কাউন্সিলর। নির্বাচনী এলাকার নাম ‘সান্তা মারিয়া মাইওর’।
আর অ্যান্টোনিও কস্তা পর্তুগালের প্রধানমন্ত্রী।
রানা তাসলিম উদ্দিন নামটি এ দেশের অনেকের কাছেই অপরিচিত নয়। ছয় বছর আগে যখন তিনি প্রথমবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হলেন, তখনই এ দেশের কোনো কোনো গণমাধ্যমে তিনি উঠে আসেন। কাউন্সিলর হিসেবে এখন রানার দ্বিতীয় মেয়াদ চলছে।
বাংলাদেশের লক্ষ্মীপুরের মানুষ রানা তাসলিম এখন ঢাকায় আছেন। মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন দেশে। ঈদুল ফিতরের পরপর মাকে নিয়ে ফিরে যাবেন লিসবন।
সম্প্রতি ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দপ্তরে বসে আলাপ হলো রানা তাসলিমের সঙ্গে। শোনা হলো তাঁর এই পর্যায়ে আসার গল্প। জানা হলো স্বপ্নের কথাও।
একটি বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের মাঠের কর্মী ছিলেন রানা। তখন স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। সরকারের রোষানলে পড়লেন। রানা তখন ঢাকা সিটি কলেজ থেকে স্নাতক দিয়েছেন।
দেশ ছাড়তে হলো। প্রথমে গেলেন হংকং। সেখান থেকে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, ম্যাকাও ও ফিলিপাইন।
কোথাও স্থির হতে পারলেন না। কেটে গেল দুটি বছর।
মনে রাজ্যের হতাশা জমিয়ে উড়াল দিলেন পর্তুগাল। সালটা ১৯৯১। পুরো পর্তুগালে তখন বাংলাদেশি মোটে ৬ জন। তাঁকে নিয়ে হলো ৭ জন। আর আজ? ৩৫ হাজারের কাছাকাছি।
লিসবনে গিয়ে ১২ জন বাংলাদেশিকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বাংলাদেশ কমিউনিটি অব পর্তুগাল’। তিনি হন এ সংগঠনের মহাসচিব। দেশে যেহেতু রাজনীতি করে গেছেন, তাই লিসবনে গিয়েও রাজনীতি করার ইচ্ছা জাগল।
কিন্তু রাজনীতি করতে হলে আগে জানতে হবে পর্তুগিজ ভাষা। চেষ্টা করলে কী না হয়! কয়েক মাসের মধ্যেই এ ভাষায় সাবলীল হলেন। একটা সময় যোগ দিলেন বামপন্থী দল পর্তুগিজ সোশ্যালিস্ট পার্টিতে। ২০১৩ সালে প্রথমবারের মতো লিসবনের সান্তা মারিয়া মাইওর থেকে কাউন্সিলর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই সফল হলেন। প্রথম মেয়াদ শেষ করে ২০১৭ সালে দ্বিতীয়বার কাউন্সিলর হয়ে কাজ করছেন। রানা তাসলিম পর্তুগাল সোশ্যালিস্ট পার্টির লিসবন কমিটির ১৮ জন সদস্যের মধ্যে ১০ নম্বরে আছেন।
তাঁর নির্বাচনী এলাকায় ভোটার সংখ্যা ১৫ হাজার। বলার অপেক্ষা রাখে না, এর মধ্যে স্থানীয় মানুষই বেশি।
রানা তাসলিমের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, স্থানীয় মানুষের মনোযোগ তিনি কীভাবে আকর্ষণ করলেন? জবাবে রানা বললেন, ‘এই দুনিয়ায় আচরণ, সৌজন্যবোধ ও বিনয়ের ভাষার মধ্যে কোনো রকমফের নেই। আমি সব মানুষকে সম্মান করি। কী স্থানীয়, কী অভিবাসী, তা বিচার করি না। ঘর থেকে বের হয়ে কারও সঙ্গে দেখা হলেই সালাম দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিই। মানুষের প্রয়োজনের সময় পাশে থাকার চেষ্টা করি। আর কোনো সময়ে কোনো বিষয়ে ইতস্তত করি না।’
এ প্রসঙ্গে রানা একটি গল্প শোনালেন। বাজেট বরাদ্দ নিয়ে আলোচনা হবে। দলের সভায় সভাপতিত্ব করছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টোনিও কস্তা। রানার মুখে, ‘আমি গিয়ে সামনের সারির একপাশে বসলাম। আইনত আমাকে এখান থেকে উঠিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। প্রধানমন্ত্রী আমার কুশল জিজ্ঞেস করলেন। আমার কমিউনিটির লোকজন কেমন আছে, জানতে চাইলেন। আমি যদি পেছনের দিকে বসতাম তিনি কি আমাকে খুঁজে পেতেন?’
তবে লিসবনে কাউন্সিলর পদ কোনো লাভের পদ নয়। এটা বলা চলে জনসেবা। সেখানে রানার নিজের ব্যবসা আছে, যা দেখাশোনা করেন তাঁর স্ত্রী। রানা নিজে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে অনুবাদকের কাজ করেন। এটা তাঁর নিজের আয়ের অন্যতম উৎস।
রানা তাসলিম পর্তুগালের নাগরিকত্ব লাভ করেন ১৯৯৪ সালে।
বাংলাদেশি লোকজন সেখানে কেমন আছে? রানা জানালেন, অনেকেই ভালো আছেন। ৩৫ হাজার বাংলাদেশির মধ্যে ২২ হাজার পর্তুগালে থাকেন। বাকিরা এ দেশের ভিসা নিয়ে ইউরোপের অন্য দেশে থাকেন। এই সুবিধাটা আছে।
তবে কয়েক মাস আগের একটি ঘটনার কথা শোনালেন তিনি। লিসবনে এক বাংলাদেশি তাঁর স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে একটি কক্ষে গাদাগাদি করে থাকতেন। পুলিশ এসে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের সেখান থেকে নিয়ে নিরাপত্তা হেফাজতে রেখেছে। পুলিশ বলেছে, অন্তত তিন কক্ষের বাসা নিতে হবে। এর পরে স্ত্রী ও সন্তানদের তাঁর কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এক কক্ষের ঘরে এত জনের থাকা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এই হলো পর্তুগাল!
পর্তুগাল ইউরোপের দেশ হলেও খুব বেশি ধনী নয়। এটা মূলত একটি পর্যটননির্ভর অর্থনীতির দেশ। সারা বছর পর্যটকে গিজগিজ করে। এই পর্যটকদের সঙ্গে নানা ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত আছেন বাংলাদেশিরা। কথা হলো লিসবনের বাসিন্দা আম্মার হোসেন বাবুর সঙ্গে। আম্মার ও তাঁর স্ত্রী লন্ডনে পড়াশোনা শেষ করে এখন পর্তুগালে থাকছেন। বিভিন্ন মালিকদের কাছ থেকে অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেন তিনি। সেই অ্যাপার্টমেন্ট আবার পর্যটকদের কাছে ভাড়া দেন। এক দিন, দুই দিন, তিন দিন। যার যেমন লাগে। হোটেলে খরচ বেশি, অ্যাপার্টমেন্টে কিছু কম। তাই পর্যটকেরা অনেকেই অ্যাপার্টমেন্ট বেছে নেন। এটাই আম্মারের ব্যবসা।
বাগেরহাটের ফকিরহাটের আম্মারের কাছে রানা তাসলিম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। আম্মার বললেন, ‘কমিউনিটির খুব পরিচিত মানুষ। রাজনীতি করেন। সবাই চেনেন। তবে তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপ হয়নি।’
ফিরে আসি রানা তাসলিমের কাছে। পর্তুগাল সম্পর্কে কথা বলতে গেলে অবধারিতভাবে চলে আসে সিআর সেভেন বা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর নাম। জানতে চাই, দেখা হয়েছিল কখনো?
‘২০১৭ সালে একবার দেখা হয়েছে। লিসবনে তাঁর পাঁচ তারকা হোটেল রয়েছে। হোটেলের একটা অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছে। হাই-হ্যালো হয়েছে।’
রোনালদোর গল্প শোনালেন রানা। বাবা ছিলেন মদ্যপ। অতিরিক্ত মদ্যপানই তাঁর মৃত্যুর কারণ ছিল। রোনালদোর আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনে মা ও বোনদের অবদানই বেশি।
রানার সঙ্গে দেখা হয়েছে বহু জ্ঞানীগুণী মানুষের। এর মধ্যে একজন জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। গুতেরেস একজন পর্তুগিজ রাজনীতিবিদ এবং পর্তুগালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। গুতেরেস রানার কাছে বাংলাদেশিদের নিষ্ঠা ও কর্মদক্ষতার প্রশংসা করেছেন।
পর্তুগিজদের সঙ্গে বাংলার ঐতিহাসিক সম্পর্ক, বাংলা ভাষায় পর্তুগিজ শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন রানা তাসলিম। তাঁর ইচ্ছা, পর্তুগিজদের সঙ্গে বাংলার মানুষের সম্পর্ক নিয়ে একটি বিশদ গবেষণামূলক বই লেখার।
পর্তুগালে পার্লামেন্ট দুই ধরনের। একটা কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট। আরেকটি মিউনিসিপ্যালিটি পার্লামেন্ট। রানা তাসলিমের লক্ষ্য, আগামী দিনে মিউনিসিপ্যাল পার্লামেন্টের একজন সদস্য হওয়া। ২০২১ সালে সে নির্বাচন সামনে রেখে কাজ করছেন রানা। এরপর তাঁর লক্ষ্য কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট।
রুশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিক, রূপা হক বড় অনুপ্রেরণা রানা তাসলিমের জন্য। তাঁরা ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন। আর লক্ষ্মীপুরের রানা তাসলিমের স্বপ্ন, পর্তুগালের পার্লামেন্টে বাংলাদেশের নাম লেখা।
কাজী আলিম-উজ-জামান: সাংবাদিক
[email protected]