'দু-একটি ভুলের' একটি কি একরাম?

দেশে মাদকের ভয়াবহ প্রসার রোধ করতে সরকারের জোরালো উদ্যোগ সময়োচিত। অভিযানে কয়েক হাজার গ্রেপ্তার হন। কিছু সাজা পান মোবাইল কোর্টে। বিরাটসংখ্যক আছেন জেলহাজতে। এর যৌক্তিকতা আমরা অনুধাবন করি। আর এ অভিযোগ পরিচালনা করতে গিয়ে কাউকে যদি ভুলে অন্তরীণ করা হয়, তাহলে প্রতিকার রয়েছে আদালতের কাছে। এমনকি মোবাইল কোর্টে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরও সুযোগ রয়েছে উচ্চতর আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার। তবে এ অভিযান পরিচালনার সময় প্রায় দুই দশকের সংস্কৃতি অনুসরণে কথিত ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের প্রতিকারের আর সুযোগ রইল না। এবার তাঁদের সংখ্যা ১৩৪-এর ওপর। তাঁরা হারিয়ে গেছেন আমাদের হিসাব থেকে। তাঁদের একজন টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরাম। শেষ পর্যন্ত একরাম শুধু স্মরণে থাকবেন তাঁর বিধবা স্ত্রী ও মেয়েদের কাছে।

স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে ব্যক্তিজীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না-এমনটি বলা হয়েছে। ৩১ অনুচ্ছেদে রয়েছে আইনের আশ্রয়ের অধিকার। জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালে বিশ্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ৩ নম্বর অনুচ্ছেদেও প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনের অধিকার সম্পর্কে অনুরূপ বক্তব্য রয়েছে। কে শুনছে কার কথা! অপরাধ দমনের নামে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়াটি এখন আমাদের শাসনব্যবস্থার অঙ্গ হয়ে পড়েছে। চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে অপারেশন ক্লিনহার্ট থেকে এর শুরু। তারপর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় র‍্যাব গঠনের মাধ্যমে। আর এখন পুলিশও একই প্রক্রিয়া জোরদারভাবে চালু করেছে।

অভিযান এখনো চলছে। বিভিন্ন দিকের ধাক্কায় একটু ধীরগতি নিয়েছে। তাও প্রতিদিন দু-একজন শিকার হচ্ছেন এ ধরনের প্রাণহানির। বলা হচ্ছে, কয়েকটি সংস্থার প্রতিবেদন সমন্বয় করে এ তালিকা তৈরি। কিন্তু টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বলছেন, একরামের বিরুদ্ধে মাদক কেন, কোনো মামলাই নেই। স্থানীয় জনগণ বলছেন, একরাম সৎ রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। তিনি সংসার চালাতেন টানাহেঁচড়া করে। তাহলে তাঁকে ধরা হলো কেন? ২৬ মে রাতে এ অমানবিক বিপর্যয়ের শিকার হন একরাম। গতানুগতিক কৈফিয়ত, প্রতিপক্ষের গুলিতে এ প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। বক্তব্যটি যে নির্জলা অসত্য, তা ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। যদি ধরে নিই সত্য, তাহলে তো বলতে হবে কোনো ব্যক্তিকে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার আওতায় নেওয়ার পর তাঁর নিরাপত্তা বিধান তাদেরই নিরঙ্কুশ দায়িত্ব। এতে ব্যর্থতা শুধু দায়িত্বে অবহেলা নয়, অবজ্ঞাজনিতভাবে প্রাণহানির কারণ ঘটানোর ফৌজদারি অপরাধও বটে।

অসংখ্য একরাম গেছেন, যাচ্ছেন। এভাবে চললে আরও যাবে। বিষয়টি নিয়ে কি কেউ জোরালো প্রশ্ন তুলছেন? আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার গঠন আইনের দ্বারা। তাদের কার্যক্রমও চলার কথা আইন অনুসারে। অথচ শতশত একরামের ক্ষেত্রে কি তা ঘটছে? সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণ বলছেন, বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে। আর কারও মতে, এ ধরনের অভিযানে দু-একটি ভুল হতেই পারে।

মাদক চোরাচালান ও পাচারের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের আইনের আওতায় আনতে সমন্বিত অভিযানের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও কোনো প্রশ্ন নেই। মাদকের ব্যবসার যত প্রসারই ঘটুক, আমাদের ড্রাগ ব্যবসায়ীরা কেউ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে সশস্ত্র মোকাবিলার অবস্থানে গেছেন, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বরং তাঁরা সমাজের প্রভাবশালী অংশসহ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও প্রশাসনের অন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে কাজ করে যাচ্ছেন, এমনটাই ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। এই প্রশ্ন খুবই স্বাভাবিক যে মাদকবিরোধী অভিযানে প্রাণহরণের কারণ ঘটছে কেন? এটা তো ঘটতে পারে জঙ্গি গ্রেপ্তার বা ওই ধরনের কার্যক্রমে।

এ প্রাণহরণকে বিচারবহির্ভূত হত্যা বলে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ১০ জন বিশিষ্ট নাগরিক। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ-জাতীয় হত্যার বিরুদ্ধে বরাবরই প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। কিন্তু এসব বিবৃতি আর প্রতিবাদ কার্যত অরণ্যে রোদন বলে লক্ষ করা যায়। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো যেন আইনের ঊর্ধ্বে বিচরণ করছে। তাদের জবাবদিহি কোথায় এবং কতটুকু, তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। এরূপ করতে গিয়েই নারায়ণগঞ্জে কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তাসহ বাহিনীর বেশ কিছু সদস্য পেশাদার খুনি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। দায়রা আদালতে সর্বোচ্চ দণ্ড হয়েছে। তবে উচ্চ আদালতে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সরকারের কোনো প্রচেষ্টা লক্ষণীয় নয়। একরাম নিহত হওয়ার ঘটনা সেরূপ কি না-এটা নিয়ে জনমনে গভীর সন্দেহ রয়েছে। প্রয়োজন আছে বিচার বিভাগীয় তদন্তের।
আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা তাদের দায়িত্ব পালনে ভুল করতে পারে না, এমন নয়। আর সে ধরনের কোনো ভুল যাতে প্রাণহানির কারণ না ঘটায়, তার জন্য তাদের আইন ও প্রবিধানে রয়েছে বহুবিধ বিধান। প্রথমত, তাদের কাউকে হত্যা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। আমাদের বিচারপদ্ধতিতে প্রাণদণ্ডের আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা দায়রা জজেরও নিরঙ্কুশ নয়। তাঁর আদেশও হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক অনুমোদিত হতে হয়। তারপরও থাকে আপিল বিভাগ। তা ছাড়া রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা ভিক্ষার সুযোগ তো রয়েছেই।

এ ক্ষেত্রে হত্যার বিষয়টি আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা স্বীকার করে না। করবে না। একরামের ক্ষেত্রেও নয়। তবে তারা যে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল, এটা যেকোনোভাবে প্রমাণিত হবে। প্রমাণিত হবে মৃত্যুর সময় তিনি তাদের হেফাজতেই ছিলেন। তাহলে তাঁর নিরাপত্তা বিধান করার ব্যর্থতা, এমনকি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার দায় তো তারা এড়াতে পারার কথা নয়। বলা হবে, এভাবে খুঁটিনাটি দেখতে থাকলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঠেকানো যাবে না। এটা ভুল তত্ত্ব। নাগরিকের অধিকার সুরক্ষা না করে আইনশৃঙ্খলাব্যবস্থা জোরদার করা যায় না। অপরাধীর বিচারের দায়িত্ব আদালতের। এ দায়িত্বের অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় প্রাণদণ্ড। আর তা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা নিয়ে নিলে আদালতের প্রয়োজনীয়তা কোথায়? নিজেদের কাজগুলো যদি তারা ভালোভাবে করে, তবেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

বিচারবহির্ভূত হত্যার ধারণা এ উপমহাদেশে আমাদের দেশেই নতুন নয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নকশালবাদী আন্দোলনের তুঙ্গ সময়ে এর কিছুটা প্রয়োগের অভিযোগ আছে। তেমনি তা করা হয় পাঞ্জাবে শিখদের হিন্দুবিরোধী দাঙ্গার সময়ে। অবশ্য সে দেশটিতে কঠোর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আছে। তদুপরি মানবাধিকার সংগঠন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সোচ্চার ছিল এমন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। ফলে সীমিত প্রয়োগে দ্রুতই তা শেষ করতে হয়।
আর এ দেশে অপারেশন ক্লিনহার্টকে আইন করে দায়মুক্তি দিতে হয়েছে। র‍্যাব গঠন সম্পর্কে বর্তমান সরকারি দল বিরোধী দলে থাকার সময়ে ছিল সমালোচনামুখর। ক্ষমতায় গেলে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের অঙ্গীকার ছিল। বিপরীতে তাদের ১০ বছরের শাসনামলে ব্যবস্থাটি অনেকটা স্থায়ী রূপ পেয়েছে। অথচ এটা আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কার্যক্রমের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ নয়। একরাম গেছেন। তাঁকে আর ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। তবে কেন, কীভাবে গেলেন-তা খতিয়ে দেখলে ভবিষ্যতে অন্য একরামেরা রক্ষা পাবেন। রবীন্দ্রনাথের ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতায় রাজমহিষীকে এ ধরনের ‘সামান্য ক্ষতির’ জন্য যেরূপ দণ্ড দেওয়া হয়েছিল, সেরূপ কিছুটা সম্ভব হলেও এ ধরনের ‘ভুল’ হবে না।

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]