ফুটবল বিশ্বকাপ: এ এক অদ্ভুত আন্তর্জাতিকতা

স্প্যানিশ সমর্থকদের আবেগটা একটু বেশিই। ছবি: এএফপি
স্প্যানিশ সমর্থকদের আবেগটা একটু বেশিই। ছবি: এএফপি

‘৯০ মিনিট ধরে একটি বলের পেছনে ২২ জনের ছুটে চলা এবং শেষ পর্যন্ত জার্মানদের জয়’—এই যার সারসংক্ষেপ, ইংলিশ স্ট্রাইকার গ্যারি লিনেকারের ভাষায় তার নামই ‘ফুটবল’। অবশ্য লিনেকার এমনটা বলারই কথা। ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে খেলায় সমতাসূচক গোলটি করেছিলেন তিনিই। কিন্তু ফাইনালের শিকে ছেঁড়েনি। পেনাল্টি শুটআউটে ইংল্যান্ড পরাজয় মানে পশ্চিম জার্মানির কাছে।

এমন কথা যদি গত বিশ্বকাপের ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার কোনো খেলোয়াড়ের মুখ দিয়েও বের হতো, তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকত না। ২০১৪ বিশ্বকাপের সেই সেমিফাইনাল কার পক্ষে ভোলা সম্ভব! আর ফাইনাল? তাই-বা কার পক্ষে ভোলা সম্ভব? গোটশের এক লহমার ঝলক, যখন ঢেকে দিল জাদুকরের দীর্ঘ লড়াইকে। কিন্তু এমন বক্তব্য শোনা যায়নি না আর্জেন্টাইন, না ব্রাজিল, কারও কাছ থেকেই। লাতিন ফুটবলের একটা অহম আছে না! জার্মান মেশিনকে স্বীকার করা যায়, কুর্নিশ কখনো নয়।

বিশ্বকাপ এলেই  নানারকম সমর্থকদের হাতে দেশের পতাকা শোভা পায়।ছবি: এএফপি
বিশ্বকাপ এলেই নানারকম সমর্থকদের হাতে দেশের পতাকা শোভা পায়।ছবি: এএফপি

ইংল্যান্ড ও জার্মানি যদি হয় ইউরোপের মস্তিষ্কনির্ভর ছকবাঁধা ফুটবলের প্রতিনিধি, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিঃসন্দেহে আবেগ ও ব্যক্তিগত কারিশমানির্ভর ফুটবলের শেষ কথা। দুটি দুই ঘরানা। সারা বিশ্বই বলা যায় ভাগ হয়ে আছে এই দুই ঘরানায়। বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে এই দুই ঘরানারই জয়জয়কার।

১৪ জুন রাশিয়ার লুঝনিকি স্টেডিয়ামে শুরু হয়েছে বিশ্বকাপ ফুটবল। দীর্ঘ বাছাইপর্ব উতরে আসা ৩২টি দল খেলছে এই বিশ্বকাপ। স্বাভাবিকভাবেই এই ৩২ দেশের মানুষেরই বিশ্বকাপ নিয়ে আগ্রহটা বেশি। কিন্তু অন্য দেশগুলোরও কম নয়। আর ফুটবল খেলুড়ে ২০৭টি দেশের মধ্যে ১৯৭তম অবস্থানে থাকা এবং কখনো বিশ্বকাপে না খেলা বাংলাদেশও এ সময় সত্যিকার অর্থেই হয়ে ওঠে ‘আন্তর্জাতিক’, যা খেলাটিরই জয়।

বিশ্বের তাবৎ সংবাদমাধ্যমের চোখ এখন বিশ্বকাপের দিকে। জন-আগ্রহই এর কারণ। বিশ্বকাপ ফুটবলের মর্মবাণীও এর অন্যতম কারণ। বিশ্বখ্যাত সাময়িকী ইকোনমিস্টের ভাষায়, ‘আমরা বিশ্বকাপের দিকে তাকিয়ে আছি। এটা এই কারণে নয় যে আমাদের প্রধান কার্যালয় যে দেশে (যুক্তরাজ্য), সেই দেশের এবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে বিশ্বকাপ জেতার। আমরা এর দিকে নজর রাখছি এর অভাবনীয় খেলোয়াড়সুলভ মঞ্চায়ন, নাটকীয়তা ও নায়কোচিত প্রপঞ্চের কারণে, যা একে শিল্পের স্তরে উন্নীত করে। এই বিশ্বকাপ আমাদের বহুল চর্চিত ও সযত্নে লালিত মূল্যবোধকে সমন্বিতভাবে সবার সামনে হাজির করে, যা এর প্রতি মনোযোগী হওয়ার অন্যতম কারণ।’

ঐতিহ্যবাহী ককেশিয়ান পোশাকে রাশিয়ার কিছু মেয়ে। বিশ্বকাপ তাঁদের কাছেও উৎসবের উপলক্ষ্য। ছবি: এএফপি
ঐতিহ্যবাহী ককেশিয়ান পোশাকে রাশিয়ার কিছু মেয়ে। বিশ্বকাপ তাঁদের কাছেও উৎসবের উপলক্ষ্য। ছবি: এএফপি

এটা সত্য যে ফুল যত সুন্দর হয়, তাতে কাঁটার উপস্থিতির আশঙ্কাও তত বাড়ে। এই ফুটবল ও এর সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক মঞ্চায়ন বিশ্বকাপের সৌন্দর্যে কাঁটার কথা বললে বলতে হয় এর নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফার কথা। দুর্নীতি থেকে স্বজনপ্রীতি, কী নেই এর ইতিহাসে। এবারের রাশিয়ায় বিশ্বকাপ আয়োজনের পেছনেও রয়েছে এমন কিছু কলঙ্ক। কিন্তু এ কলঙ্ক এত শক্তিশালী নয়, যতটা ফুটবলের সৌন্দর্য। এ কারণে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাজ্যের হালের কূটনৈতিক বিরোধ সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ড অংশ নিচ্ছে বিশ্বকাপে। শুধু যুবরাজেরা যাচ্ছেন না।

বিশ্বকাপ আয়োজক দেশ নির্ধারণ প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা উঠলেও যখন এটি শুরু হয়, তখন গোটা বিশ্বের এর দিকে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না। কারণ এর ইতিহাস। ইকোনমিস্টের ভাষায়, ‘এখন পর্যন্ত সুশাসন নেই—এমন কোনো দেশকেই পুরস্কৃত করেনি বিশ্বকাপ। খেলাটির পুরুষ সংস্করণে একমাত্র ব্যতিক্রম ১৯৭৮ সালের আর্জেন্টিনা। এর বাইরে ফুটবল সব সময়ই একনায়কত্বের অধীনে থাকা দেশকে হতাশ করেছে। শত প্রস্তুতি নিয়েও ভাগ্যের শিকে ছেঁড়েনি। এ ক্ষেত্রে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানিকে আলোচনায় আনা যায়, আনা যায় সোভিয়েত ইউনিয়নকেও। চোখ রাখা যায় এখনকার চীনের দিকেও।’

বাঁশি আর পতাকা নিয়ে বিশ্বকাপের উৎসবে মেতেছে ইরানের সমর্থকেরা। ছবি: এএফপি
বাঁশি আর পতাকা নিয়ে বিশ্বকাপের উৎসবে মেতেছে ইরানের সমর্থকেরা। ছবি: এএফপি

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ফ্রিডম হাউসের তথ্যমতে, এবারের বিশ্বকাপে মাত্র চারটি দেশ অংশ নিচ্ছে, যেখানে ‘গণমুখী’ সরকার নেই। আর খেলাটির নারী সংস্করণে এখন পর্যন্ত যে কয়টা দেশ জয়ের মুকুট পরেছে, তাদের সবাই গণতান্ত্রিক দেশ। এগুলো হচ্ছে আমেরিকা, জার্মানি, জাপান ও নরওয়ে।

ইতিহাস ঘাঁটলে এটা স্পষ্ট, আন্তর্জাতিক ফুটবল বরাবরই আত্মকেন্দ্রিক দেশগুলোকে শাস্তি দিয়েছে; আর পুরস্কৃত করেছে আন্তর্জাতিক মনস্কতাকে। এর কারণও আছে। একটি গণতান্ত্রিক ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন দেশের প্রশাসন অনায়াসেই ফুটবল অবকাঠামো তৈরির জন্য বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে সেরা ব্যক্তিদের এনে জড়ো করতে পারে। তাদের খেলোয়াড়দের জন্যও খোলা থাকে সব দরজা। ফলে মাঠে ও মাঠের বাইরে প্রকৃত জিনিয়াসদের আসার সুযোগ অবারিত হয় সহজেই। এর সঙ্গে যদি পর্যাপ্ত পুঁজির মেলবন্ধন ঘটে, তাহলে তো আর কথাই নেই। বিপরীতে অন্তর্মুখী একটি দেশের প্রশাসন ফুটবলের ক্ষেত্রেও রক্ষণশীল তত্ত্বের প্রয়োগ করে, যা ভালো খেলোয়াড় ও সংগঠকের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। অন্তর্মুখী হওয়ায় পুঁজির সংকটেও ভোগে এসব দেশ। ইতিহাসে এর স্বাক্ষর আছে ভূরি ভূরি। বেশি দূর নয় ২০ বছর আগে বিশ্বজয়ী ফ্রান্সের স্কোয়াডের দিকে তাকালেই এর সত্যতা পাওয়া যাবে। ওই দলের অর্ধেক সদস্যই ছিল অভিবাসী, যা একটি উন্মুক্ত কাঠামো ছাড়া সম্ভব নয়।

স্প্যানিশ সমর্থকদের আবেগটা একটু বেশিই। ছবি: এএফপি
স্প্যানিশ সমর্থকদের আবেগটা একটু বেশিই। ছবি: এএফপি

সবচেয়ে বড় কথা হলো ফুটবল বরাবরই মুক্ত পরিবেশ ও সৃষ্টিশীলতাকেই পুরস্কৃত করে এসেছে। বেগ ও আবেগ—দুটোকেই মূল্য পরিশোধ করেছে ফুটবল শুধু এই সৃষ্টিশীলতা ও মুক্ত পরিবেশের প্রশ্নেই। একাডেমিকেন্দ্রিক ইউরোপীয় ঘরানার পাশাপাশি নন্দন পূজারি লাতিন ফুটবল দুইই নিজের হিস্যা বুঝে নিয়েছে এই বিশেষ শর্ত পূরণ করেই। এমনকি আফ্রিকার দেশগুলোর দিকেও তাকানো যেতে পারে। অভ্যন্তরীণ অবস্থা যা-ই হোক না কেন, ফুটবলের প্রশ্নে আফ্রিকার দেশগুলো নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক মানসিকতার। বিশ্বের বড় বড় লিগে আফ্রিকান খেলোয়াড়দের সরব উপস্থিতিই এর বড় প্রমাণ।

ব্যতিক্রমহীনভাবেই এবারের বিশ্বকাপেও এই আন্তর্জাতিকতাবাদের জয়গান শোনা যাবে। আর এই দিক থেকে জার্মানি থেকে কে আর এগিয়ে আছে। যদিও জীবনের মতোই অননুমেয় এক খেলা ফুটবল। আছে হাজারো সম্ভাব্যতা। রয়েছে অন্তত আরও পাঁচটি যোগ্য দাবিদার।