কর্পূরের শহর চ্যাঙ-শা

এমন নিবিড়ঘন সবুজ কর্পূরবৃক্ষসজ্জিত শহর আমি আগে কখনো দেখিনি; দেখিনি ম্যাগনোলিয়াশোভিত কোনো শহরও। ভরদুপুরে হুনানের রাজধানী চ্যাঙ-শা বিমানবন্দরে নেমে ব্যাগেজ নিয়ে বেরুতেই আমাদের প্রথম চীনা গাইড আমাদের স্বাগত জানালেন। টগবগে, হাসিখুসি তরুণ; নাম বললেন, মাইক। চীনারা এভাবেই তাদের বিদেশি অতিথিদের সঙ্গে পরিচিত হতে পছন্দ করে। নাম হয়তো লি; কিন্তু নিজের পরিচয় বলবে, লিলি বা হেলেন লি। গাড়িতে ব্যাগেজ তুলে আমরা চলেছি চ্যাঙ-শা শহরে। নয়নাভিরাম সবুজে মোড়া এই চ্যাঙ-শা শহর। এত নিবিড়ঘন সবুজ শহর আমি জীবনে দেখিনি। প্রথমেই নজর কাড়ল শত শত ম্যাগনোলিয়া গ্রান্ডিফ্লোরার সারি। বড় বড়, দুধসাদা ফুলে ফুলে ভরপুর। শহরসজ্জায় এত ম্যাগনোলিয়া সারি আমার স্বপ্নাতীত। আর আছে মিষ্টি সবুজ পত্রপল্লবিত বৃ‌ক্ষের সারি। সন্দেহ নিরসনে মাইককে জিজ্ঞেস করলাম, বৃক্ষটির পরিচয়। বললেন, ক্যাম্ফর। কর্পূর! মনে পড়ল, ময়মনসিংহে রাজবাড়িতে আছে কর্পূরবীথি। তাই বলে এত এত কর্পূরবৃ‌ক্ষের সারি! না দেখলে বিশ্বাসই হয় না। 

গোটা শহর ফুলে ফুলে শোভিত। সগৌরবে বিভা ছড়াচ্ছে জারুল। হায়, বাংলার জারুলের কদর নেই জন্মভূমি বাংলাদেশে! আর সারি সারি গোলাপ কিংবা রক্তকরবী। পথের দুধারে, ফ্লাইওভার কিংবা আকাশ-ট্রেনের লাইন ধরে। কত প্রজাতির, কত রঙের ফুল যে প্রতিপার্শ্ব আলো করে আছে, তা বর্ণনাতীত। গোটা শহর যেন ফুলে ফুলে সাজানো এক মনোরম পার্ক! চন্দ্রমল্লিকা চীনের জাতীয় ফুল। কিন্তু এখন গ্রীষ্মকাল। চন্দ্রমল্লিকা শীত ও বসন্তজুড়ে ফোটে। তাই চন্দ্রমল্লিকার বাহার দর্শনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলাম আমরা।

কোথাও কোনো বিলবোর্ড নেই, নেই কোনো নেতার ছবি, রাজনৈতিক দেয়াল লিখন কিংবা বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন। সামান্য ময়লা বা এক টুকরো কাগজও পড়ে নেই কোথাও। ফুট ওভারব্রিজগুলো ঝকঝকে তকতকে। রাতেই শহর সুইপিংয়ের কাজ শেষ হয়। এ জন্য ব্যবহৃত হয় আধুনিক সুইপিং মেশিন। তারপর পানির গাড়ি এসে ধুয়ে দিয়ে যায়। কেউ কোথাও কিছু ফেলে না। এরপরও সারা দিন শহর পরিচ্ছন্ন রাখতে কাজ করে দায়িত্বপ্রাপ্ত সুইপার। নোংরা, দুর্গন্ধভরা শরীর ঘিনঘিন করা বাংলাদেশের করুণ দৃশ্য মনের কোণে উঁকি দিল। আমাদের রাজধানী ঢাকার মতো আবর্জনায় ভরা ফুট ওভারব্রিজ কিংবা রাস্তার পাশে ময়লার স্তূপ বোধ হয় দুনিয়ার কোথাও নেই। হায়, কবে আমরা এমন পরিচ্ছন্ন সুবাসিত শহর গড়ে তুলতে পারব!

চীনে আসার আগে অনেকে বলেছে, এখানে নাকি খাওয়াদাওয়ায় নানা সমস্যা। চীনা খাবার নাকি মুখে দেওয়া যায় না। চীনারা ব্যাঙ, তেলাপোকা, ফড়িং, ইঁদুর, সবই নাকি খায়! প্রথম কোনো চীনা শহরে খেতে তাই আমরা কোনো ম্যাগডোনাল্ড বা কেএফসির খোঁজ করলাম। আমাদের হোটেল থেকে মিনিট পাঁচেক হাঁটাপথেই মিলে গেল চমৎকার এক কেএফসি দোকান। সেখানেই আমরা প্রথম আমাদের দুপুরের আহার সেরে নিলাম। চীনে এখন প্রচুর ম্যাগডোনাল্ড শপ। তবে শর্ত হলো, এসব দোকানের যাবতীয় সামগ্রী উৎপাদিত হতে হবে চীনে, আমেরিকা থেকে এনে বিক্রি করা যাবে না। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, ‘যস্মিন দেশ যদাচার’; রাতে আমরা চীনা খাবারই খাব। মাইককে তা জানিয়ে দিলাম। সে মতোই ব্যবস্থা হলো। আমাদের জন্য আলাদা রান্না হলো। ভেজিটেবল ও চিকেন স্যুপ। শ্রিম্প ফ্রাই, স্যামন ফ্রাই, স্টিমড ফিশ, চায়না ডাক, বিফ। রাইস, চাউমিন বা নুডলস। জুস, কোল্ড ড্রিংক, আইসক্রিম। আপেল, লাল টসটসে তরমুজ। চীনারা প্রচুর সবজি খায়। শসা, গাজর, কপি, ব্রুকলি ইত্যাদি আর সুস্বাদু সালাদ। আমরা আনন্দের সঙ্গে মজা করে চীনা খাবার খেলাম। তবে বাংলাদেশে চায়নিজ খাবার বলে যা চলে, তার সঙ্গে কোনোই মিল নেই।
একটাই অসুবিধা হলো আমাদের। তা হলো, চীনারা কাঠি দিয়ে খায়। আতপ চালের ভাত, একটু আঠালো। সহজেই দুই কাঠি দিয়ে খেতে পারে। কিন্তু আমরা পারলাম না। শুধু বেনজিন জিদ ধরল, সে কাঠি দিয়েই খাবে। খেলোও। প্রথম প্রথম অসুবিধা হলেও পরে রপ্ত করে ফেলল। আর দাউদ ভাই তো পাঁচ আঙুলের বাঙালিয়ানা বহাল রাখলেন।

গতকাল আমরা মাওয়ের জন্মস্থান শাওশান সফর করেছি। আজ আমরা দেখব শিয়াঙ নদীর (Xiang River) পূর্বতীরে চ্যাঙ-শা শহর। যেন ইয়েলু পর্বতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন শহর চ্যাঙ-শা। হুনানের রাজধানী। চীন বিপ্লবে
বে চ্যাঙ-শা শহরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। চেয়ারম্যান মাও এখানে কিছুকাল লেখাপড়া করেছেন, কাটিয়েছেন তাঁর প্রথম জীবন। এখানেই মাওয়ের রাজনীতিতে হাতেখড়ি। এই চ্যাঙ-শাতে অবস্থিত ইয়েলু একাডেমি (Yuelo Academy, অন্য নাম Yuelo Academy of Classical Learning), পরবর্তীকালের বিশ্ববিখ্যাত হুনান বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিটির সঙ্গে মাওয়ের সংগ্রামী জীবন জড়িয়ে আছে। মাও কিছুকাল এই ইয়েলু একাডেমিতে লেখাপড়া করেছেন। প্রাচীন এই বিদ্যাপীঠ নানা কারণে বিখ্যাত। চীনা জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম সূতিকাগার। চিরায়ত জ্ঞান, ঐতিহ্য ও প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে যুক্ত এক বিরল শিক্ষাকেন্দ্র। ‘প্রকৃতিই সকল শিক্ষার উৎস’ হচ্ছে এখানকার শিক্ষার মূল বাণী। উত্তরের সং রাজবংশের সম্রাট কাইবাও (Emperor Kaibao)-এর সহায়তায় ৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে মহামতী কনফুসিয়াসের চার মহান শিষ্য এই গণশিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে শিঙ রাজবংশের (Qing Dynasty) আমলে এখানে ক্রমে ক্রমে দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য, গণিত, অর্থনীতিসহ হাতেকলমে শিক্ষার প্রসার ঘটে। এখানকার স্থাপত্য বিভাগ খুবই প্রাচীন এবং পৃথিবীবিখ্যাত। চার-পাঁচ হাজার বছর আগের চীনা স্থাপত্যের যেসব নিদর্শন এখানে আছে, তা বিস্ময়কর। নিখুঁত জ্যামিতিক মাপ ও সাইজে পাথর কাটা ও নির্মাণশৈলী না দেখলে বিশ্বাস হয় না।

চীনারাই প্রথম কাগজ আবিষ্কার করে। সেই প্রাচীন আমলের কাগজে লেখা বহু গ্রন্থ এখানে সযত্নে সংর‌ক্ষিত আছে এবং তা দর্শনার্থীদের দেখার জন্য উন্মুক্ত করে রাখা হয়েছে। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে ইয়েলু একাডেমি উন্নীত হয় উচ্চশিক্ষাকেন্দ্র বা বিশ্ববিদ্যালয়ে (Hunan Institute of Higher Learning)। চ্যাঙ-শা শহরের অন্যতম আকর্ষণ শিয়াঙ নদীর বুকে পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ৪০ থেকে ১৪০ মিটার প্রশস্ত প্রায় ৩ লাখ ৭০ হাজার ৯০০ বর্গমিটার আয়তনের কমলা দ্বীপ। অপূর্ব সুন্দর। রাতে তা রীতিমতো মোহনীয় হয়ে ওঠে। আমরা টয় ট্রেনের মতো পাঁচ বগির বাসে করে কমলা দ্বীপ পরিভ্রমণ করলাম। কমলা দ্বীপে আছে অজস্র কমলালেবুর গাছ। গাছভর্তি কমলা লেবু।

এই অরেঞ্জ দ্বীপেই নির্মাণ করা হয়েছে ৩২ মিটার উঁচু চেয়ারম্যান মাওয়ের বিশালাকৃতির আবক্ষ মূর্তি। বহু দূর থেকে তা দেখা যায়। ২০০৭ সালে নির্মাণকাজ শুরু হয় এই কংক্রিট মূর্তি। দুই বছর পর ২০০৯ সালে নির্মাণকাজ শেষ হয়। কিছু সংস্কারকাজ চলছে বিধায় এখন ঢেকে রাখা।

চীনা বিপ্লবে হুনান প্রদেশ ও রাজধানী চ্যাঙ-শার বিশেষ অবদান রয়েছে। ১৯১১ সালের চ্যাঙ-শা প্রথম মাঞ্চু অপশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। একই সঙ্গে বিদ্রোহ করে বুচানের লোকেরাও। এই দুই স্থানে বিপ্লব সফল হলে তা অচিরেই অন্যান্য প্রদেশেও ছড়িয়ে পড়ে এবং ২৬০ বছরের মাঞ্চু রাজবংশ উৎখাত হয়। এই বিপ্লবের নেতা ছিলেন জাতীয়তাবাদী ডা. সান ইয়াৎ সেন। তাঁকে চীনের অস্থায়ী সরকারে প্রধান করা হয়। সান ইয়াৎ সেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই জনগণের মঙ্গলের জন্য গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, জনগণের সমৃদ্ধির জন্য অঙ্গীকার করেছিলেন। একটি সংবিধানও রচিত হয়। কিন্তু য়ুবান-শি-কাই নামক এক সেনাপতি জমিদার, বণিক, উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা এবং সরকারি আমলাদের সাথে ষড়যন্ত্র করে সান ইয়াৎ সেনকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য করে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরাও এই পুতুল সরকারকে সমর্থন দেয়। ফলে, মাঞ্চু রাজবংশের পতন হলেও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা হলো না। ব্যর্থ হয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব।

আমিরুল আলম খান, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান