ঈদের শুভেচ্ছায় ভোটের আমেজ

ঈদের দিন ভোটারদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পাশাপাশি নিজেদের মধ্যেও কুশল বিনিময় করেছে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম ও হাসান উদ্দিন সরকার। আনারকলি রোড, টঙ্গি, গাজীপুর, ১৬ জুন। ছবি: আবদুস সালাম
ঈদের দিন ভোটারদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পাশাপাশি নিজেদের মধ্যেও কুশল বিনিময় করেছে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম ও হাসান উদ্দিন সরকার। আনারকলি রোড, টঙ্গি, গাজীপুর, ১৬ জুন। ছবি: আবদুস সালাম

একসময় চিঠিতেই দূরের প্রিয়জনকে ঈদের শুভেচ্ছা জানানো হতো। এরপর দূরালাপনী চালু হলে মানুষ সেটাই ব্যবহার করত প্রিয়জনকে শুভেচ্ছা জানাতে। বিশেষ করে যাঁদের আত্মীয়স্বজন বিদেশে থাকতেন, তাঁরা উৎসব পর্বে টেলিফোনে তাঁদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন। কিন্তু গ্রামে যাঁরা থাকতেন, তাঁদের পক্ষে প্রিয়জনকে সরাসরি ঈদের শুভেচ্ছা জানানো সম্ভব হতো না।

কিন্তু এই সমস্যার সুরাহা করে দিয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি তথা মোবাইল টেলিফোন। কবি নির্মলেন্দু গুণ যার নাম দিয়েছেন, ‘মুঠোফোন’। একটি মুঠোফোন পরকে আপন করতে না পারলেও দূরকে যে নিকট করেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। দশক দুই আগেও টিঅ্যান্ডটির একটি টেলিফোন পেতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উৎকোচ দিতে হতো। ডিমান্ড নোটের টাকা জমা দিয়েও মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হতো একটি টেলিফোন সেটের জন্য। এখন আর ডিমান্ড নোটের জন্য কেউ অপেক্ষা করেন না। চাইলেই তাঁরা হোয়াটসআপ, ভাইবার বা মেসেঞ্জারে দেশে-বিদেশে থাকা স্বজনদের ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে পারেন।

আবার সেই কষ্টটুকু যাঁরা করতে চান না, তাঁরা একটি এসএমএস (শর্ট মেজেস সার্ভিস) বা খুদে বার্তা পাঠিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা জানান। সময়টি এখন খুদে বার্তার। ঈদের সপ্তাহ খানেক আগে থেকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে এসএমএস পাঠানো শুরু হয় এবং সেটি চলে ঈদের কয়েক দিন পরও। নববর্ষে, দুর্গোৎসবেও খুদে বার্তা পাঠানো হয়। তবে সংখ্যায় কম।

এবারের ঈদে খুদে বার্তার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো ভোটের আগাম প্রচার। তবে এই কাজটি যে শুধু রাজনীতিকেরা করেন, তা-ই নয়, পাড়া, সমিতি যেকোনো সংগঠনের নির্বাচনে খুদে বার্তা দিয়ে ভোট চেয়ে থাকেন। আমার মুঠোফোনে কয়েকজন এসএমএস পাঠিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে নিজের পরিচয় দিয়েছেন অমুক নির্বাচনী এলাকার সাংসদ পদপ্রার্থী। দোয়া করবেন। ভোটের রাজনীতিতে একটি অতি পরিচিত স্লোগান ভোট চাই ভোটারের, দোয়া চাই সকলের। প্রার্থীরা যদি ভোটারের ভোটই চাইবেন, তাহলে ভোট নিয়ে এত কাটাকাটি-হানাহানি কেন? দলে দলে এত বিবাদ কেন? খুদে বার্তায় ঈদের শুভেচ্ছা জানানোর মতো খুদে বার্তায় ভোট দেওয়ার যদি কোনো নতুন নিয়ম কখনো চালু হয়ে যায়, তখন আর ভোট কারচুপির সুযোগ থাকবে না। আমরা সেই দিনের অপেক্ষায় আছি।

এত দিন আমরা মন্ত্রী, সাংসদ, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপির চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে পাড়ার ক্লাবের কর্তাব্যক্তিদের ঈদ শুভেচ্ছা পেতে অভ্যস্ত ছিলাম। এখন পদপ্রার্থীরাও হরদম শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। আশা করি, ভোট পর্যন্ত এই শুভেচ্ছার ডালি চলতে থাকবে।

মনে পড়ে আশির দশকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেন, তখন প্রায় সব প্রধান দল সেই নির্বাচন বর্জন করে। এরশাদ ভুঁইফোড় কয়েকজন ব্যক্তিকে প্রার্থী হিসেবে খাড়া করেছিলেন। এর আগে ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের নির্বাচনে জেনারেল এম এ জি উসমানী বিরোধী দলের প্রার্থী হলেও একাধিক ভুঁইফোড় প্রার্থী দাঁড় করানো হয়েছিল, যদি বিরোধী দল শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে না থাকে। সেই ভুঁইফোড় প্রার্থীদের একজন ছিল সিলেটের ছয়ফুর রহমান (সাবেক অর্থমন্ত্রী নন)। নিজের একটি ছবি ও খবর ছাপানোর জন্য তিনি পত্রিকা অফিসে ধরনা দিতেন। এই ভুঁইফোড় ব্যক্তিদের একমাত্র পরিচয় ছিল রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী।

আগে রাজনীতিকেরা যেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন, সেখান থেকেই নির্বাচন করতেন। কিন্তু বর্তমানে সাংসদ থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান পর্যন্ত প্রায় সবাই ঢাকার বাসিন্দা। তাই উৎসব-পর্বে তাঁরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় যান। এবারেও গিয়েছেন। কিন্তু অন্যবারের থেকে এবারের যাওয়াটি আলাদা। আগামী ডিসেম্বরের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বড় দলগুলোর মধ্যে পদপ্রার্থীদের জোর লড়াই শুরু হয়ে গেছে। সব বড় দলেই প্রতিযোগিতা আছে। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকাটি অনেক দীর্ঘ। অনেক আসনে অন্তত ১০-১২ জন স্থানীয় নেতা মনে করেন, তাঁরাই প্রার্থী হওয়া যোগ্য। আবার কেউ কেউ মনে করেন, তাঁকে প্রার্থী না করলে দলের ভরাডুবি হবে। ঈদের সময় এই ভরাডুবি থেকে দলকে উদ্ধারকারীদের ভিড় দেখা যাবে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায়। তাঁরা ভোটারদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন। দোয়া-আশীর্বাদ চাইবেন। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, বিএনপি নির্বাচনে এলে আওয়ামী লীগ শতাধিক আসনের প্রার্থী পরিবর্তনের চিন্তা করছে। কোন কোন আসনে প্রার্থী বদলানো হবে ইতিমধ্যে তার আলামতও পাওয়া গেছে। সেখানে বর্তমান সাংসদ ও সম্ভাব্য পদপ্রার্থীর অনুসারীদের মধ্যে সংঘাত সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।

তাই বলে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরাও বসে নেই। তাঁরা ভেতরে-ভেতরে প্রস্তুতি নিচ্ছেন; যদিও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি না, সে কথা বলার সময় এখনো আসেনি। আসলে বিএনপি বাইরে যা-ই বলুক, এবারে ২০১৪এর পুনরাবৃত্তি হবে না। সব দলের অংশগ্রহণেই নির্বাচন হবে আশা করা যায়।

জাতীয় নির্বাচনের আগে চারটি সিটি করপোরেশনে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। গাজীপুরের তফসিল আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল। ঈদের আগে ১৩ জুন ঘোষিত হলো বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল। শেষের তিন সিটিতে মেয়র প্রার্থী নিয়েও আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে নানামুখী তৎপরতা চলছে। তবে সেই তৎপরতা ছাপিয়ে সারা দেশে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ঈদ-রাজনীতি নিয়েই বেশি আলোচনা লক্ষ করা যাচ্ছে।

নির্বাচনের আগে রাজনীতিকেরা ঘন ঘন এলাকায় যান। সবার সঙ্গে আন্তরিকভাবে কথা বলেন। শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এবারের ঈদ-উৎসবে সেই সুযোগটি তাঁরা পুরোপুরিই কাজে লাগিয়েছেন।

কিন্তু নির্বাচনের পরও কি তাঁদের এই জনপ্রীতি ও গণসংহতির ধারাটি অটুট থাকবে?