'অবরুদ্ধ' মওদুদ, ভ্যানগাড়ি ও পুলিশ সমাচার

এবারের ঈদের ছুটিটা সবার জন্য আনন্দের হলেও বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদের জন্য কিছুটা কষ্টেরই ছিল। তিনি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে গিয়েছিলেন নিজ বাড়িতে স্থানীয় নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে। সকালে জামায়াতে নামাজও পড়েছেন। কিন্তু বিকেলে বাড়ি থেকে বের হতে গিয়েই বাধার মুখোমুখি হন। পুলিশ বাড়ির রাস্তার সামনে একটি ভ্যানগাড়ি আড়াআড়ি করে রেখে দিয়েছেন। বাড়ির চারপাশে কড়া পুলিশ প্রহরা। পুলিশ বলেছেন, ‘বাড়ির বাইরে যাওয়া যাবে না। আপনার নিরাপত্তার সমস্যা হতে পারে।’
বাংলাদেশের পুলিশ এতটা সদয় কখনো ছিলেন না যে বিরোধী দলের একজন নেতার নিরাপত্তার কথা ভেবে তাঁকে বাড়ি থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দেবেন। এ ব্যাপারে মওদুদ আহমদের বক্তব্যটি শোনা যাক। তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘শনিবার বেলা সাড়ে তিনটা থেকে নোয়াখালী কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সিরাজপুর ইউনিয়নের মানিকপুর গ্রামে নিজ বাড়িতে অবরুদ্ধ অবস্থার মধ্যে রয়েছেন তিনি। এ কারণে বিকেলে পূর্বনির্ধারিত ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় ও গণসংযোগ কর্মসূচিতে তিনি অংশ নিতে পারেননি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ অাহম আট দিন ধরে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় অবস্থান করছিলেন। এ সময় দলীয় নেতা-কর্মীরা তাঁর সঙ্গে দেখা করলেও তিনি দলীয় কোনো অনুষ্ঠানে যেতে পারেননি। প্রতিবারই পুলিশ নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে তাঁর পথ আটকে দিয়েছেন। এর মধ্যে একটি ইফতার পার্টিও ছিল। সেখানে পুলিশ আগে ভাগে গিয়ে বলেছেন, ইফতার পার্টি করা যাবে না।
বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা পুলিশের এসব অন্যায় আচরণের প্রতিবাদও করতে পারছেন না। প্রতিবাদ করলেই মামলা হবে। জেল যেতে হবে।
মওদুদ আহমদের অভিযোগ, ‘আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে পুলিশ আমাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। কাদেরের নির্দেশে পুলিশ এসব কাজ করছে।’ তিনি বলেন, ‘ওবায়দুল কাদের যত বড় রাজনৈতিক দলের নেতাই হন না কেন, তিনি তাঁর এলাকায় গণতন্ত্রের কোনো সুযোগ রাখেন নাই। এখানে বিরোধী মত প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই।’ (প্রথম আলো অনলাইন)
তবে ওই খবরে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের কোনো মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া নেই। ফলে আমরা নিশ্চিত নই যে ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশেই কাজটি হয়েছে না পুলিশ অতি উৎসাহ নিয়ে বিএনপি নেতাকে বাড়িতে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছেন, ‘পুলিশের এই পদক্ষেপের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক নেই। আওয়ামী লীগ বিএনপি বা মওদুদ সাহেবের কোনো কর্মসূচিতে বাধা দেয়নি।’
এ বিষয়ে কোম্পানিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদুজ্জামানের ভাষ্যটি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। তাঁর দাবি, ‘মওদুদকে অবরুদ্ধ করা হয়নি। কিন্তু তিনি দেশের একজন জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা। সন্ধ্যার আগমুহূর্তে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে কোথাও গণসংযোগে গেলে তাঁর নিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটতে পারে বিধায় তাঁকে বাড়ি থেকে বের না হওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।’
বিএনপি নেতার নিরাপত্তা নিয়ে অতিশয় বিচলিত পুলিশ। আমরা এতদিন জানতাম সরকারের পুলিশ সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রী সাংসদদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত এবং তাঁদের নিরাপত্তা যাতে বিঘ্নিত না হয়, সে জন্য সদা উদ্‌গ্রীব থাকেন। কিন্তু এবারে দেখলাম বিরোধী দলের নেতাদের নিরাপত্তা রক্ষাকেও তাঁরা ফরজ কাজ হিসেবে নিয়েছেন। ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত বটে।
প্রথম আলোর নোয়াখালী প্রতিনিধি মাহবুবুর রহমান জানান, মওদুদ আহমদ ঈদের দিন বিকেলে কবিরহাটে যেতে চেয়েছিলেন দলীয় দলীয় নেতা-কর্মীসহ স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে। সেই সময় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও সেখানে অবস্থান করছিলেন। দুই প্রধান দলের দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতা একই স্থানে গেলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে, এই বিবেচনা থেকেই নাকি পুলিশ মওদুদকে বাড়ি থেকে বের হতে দেননি।
কোম্পানিগঞ্জে পুলিশের এই ভূমিকা আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। সামনে জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী নেতাদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হলেই যদি আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে তাহলে তো পুরো বাংলাদেশ ভাগ করে এক দিকে আওয়ামী লীগ এবং অন্যদিকে বিএনপি নেতাদের রাখতে হবে। যাতে তাঁদের মধ্যে কখনো দেখা সাক্ষাৎ না হয় সে জন্য লোহার বেড়া দিয়ে রাখতে হবে।
পুলিশ একজন রাজনৈতিক নেতা কিংবা সাধারণ নাগরিককে তাঁর অবাধ চলাচলে বাধা দিতে পারেন না। দিলে সেটি হবে সংবিধান ও আইনবিরুদ্ধ হবে। আইনের রক্ষকেরাই যদি আইনবিরুদ্ধ কাজ করে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়?
প্রথম আলোর নোয়াখালী প্রতিনিধির কাছ থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক একটি সুযোগ হারিয়েছেন কিংবা অতি উৎসাহী পুলিশ তাঁকে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছেন। কবির হাটে ওবায়দুল কাদেরের শুভেচ্ছা বিনিময়ের কর্মসূচির থাকা সত্ত্বেও সেখানে বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদের গেলে সমস্যা কী ছিল? দুই দলের অতি গুরুত্বপূর্ণ নেতার মধ্যে কথাবার্তা ও কুশল বিনিময় হলে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের কাছে এই বার্তাই যেত যে রাজনীতিতে পথ ও পথের বিরোধ থাকলেও তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত সদ্ভাব থাকা সম্ভব।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা খিজির হায়াত খানও জানিয়েছেন, বিএনপির নেতাদের সঙ্গে তাঁদের কোনো সমস্যা নেই। মওদুদ আহমদও বলেছেন, এর আগে নির্বাচনী এলাকায় গেলে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গেও তাঁর দেখা সাক্ষাৎ হয়। কুশল বিনিময় হয়। এটাই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক হলো কোনো নেতাকে ইফতার পার্টিতে যেতে বাধা দেওয়া কিংবা বাড়ির সামনে ভ্যানগাড়ি আড়াআড়ি করে রেখে বাড়িতে অবরুদ্ধ করে রাখা।
সবশেষ খবর হলো মওদুদ আহমদ রোববার সকালে ঢাকার পথে বাড়ি থেকে রওনা হয়ে গেছেন। পুলিশ বাধা দেয়নি।
তাহলে কবিরহাটে যেতে কেন বাধা দিল? এই প্রশ্নের জবাব কী।