নন্দন-নাটকীয়তায় এক অনন্য শিল্প

বিশ্বকাপের সব আলো এখন রোনালদোর। ছবি: রয়টার্স
বিশ্বকাপের সব আলো এখন রোনালদোর। ছবি: রয়টার্স

নায়ক, খলনায়ক, সৃষ্টিশীলতা, উন্মাদনা, মানবিক ভুল; কী নেই এখানে! এখানে শোক ও উল্লাস একই পাটাতনে আলোর মুখ দেখে। এক কথায় সব আছে এখানে। শুধু ধ্বংস নেই। আছে শুধু নির্মাণ। আর সবকিছুর ঊর্ধ্বে একমাত্র সত্য হয়ে আছে উৎসব, যার শেষ দৃশ্য মুছে দেয় সব বেদনার কাব্য। এর নাম ফুটবল। এর নাম বিশ্বকাপ।

ফুটবলের যদি কোনো রাজ্যপাট থাকে, তো তার সম্রাট হলেন পেলে। এই সম্রাটই বিস্ফারিত চোখে দেখেছেন তাঁর বাবাকে কাঁদতে। তখন তাঁর বয়স নয় বছর। সাল ১৯৫০। ফুটবলের নিয়ে একটু-আধটু খোঁজ রাখেন, এমন যে কারওই এতক্ষণে মারাকানাজো-কাণ্ডের কথা মনে পড়ে যাওয়ার কথা। মারাকানা এখনো দুঃখ হয়ে আছে ব্রাজিলের জন্য। ৬৮ বছর কেটে গেছে; কিন্তু সেই প্রতিশোধ হুবহু নিতে পারেনি ব্রাজিল। তবে পেলে কিন্তু নিয়েছিলেন। উরুগুয়ের কাছে ১৯৫০-এর বিশ্বকাপ ফাইনালে হার বাবার চোখে যে জল এনে দিয়েছিল, তা মুছিয়ে দিয়েছিলেন গুনে গুনে ২০ বছর পরের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে। কথা রেখেছিলেন পেলে। মারাকানাজো-কাণ্ডের পর বিশ্বকাপে দুই দল ওইবারই প্রথম মুখোমুখি হয়েছিল। চলছিল হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। ১-১-এ সমতা তখন। এটা সেই মুহূর্ত, যখন জাদুর ঝলক সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত। আর হলোও তাই। মধ্যমাঠ থেকে বলের পেছনে ছুটছেন পেলে। আর উরুগুয়ের গোলরক্ষক বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসছেন বলের দিকেই। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের সেই ক্ষণ, যা পুরো খেলারই সারমর্ম, এমনকি ফুটবলেরই। এ যেন এক নিখুঁত চিত্রনাট্য, যার দেখা একমাত্র বিশ্বকাপের আসরেই মেলে।

ঘটন-অঘটন, আশা-নিরাশা-হতাশা—এই সব মিলিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবল যা তুলে ধরে, তা যেন এক আলাদা ধর্মের নাম, যা বর্ণগোত্র-নির্বিশেষে সর্বজনীন। সর্বতোভাবে বৈশ্বিক এই আসরকে সফট ডিপ্লোমেসি বললেও অত্যুক্তি হবে না। আর্জেন্টিনা-ইসরায়েল প্রস্তুতি ম্যাচ নিয়ে কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া তোলপাড়ের পর অন্তত এ নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। এমন নয় যে এই কূটনীতি শুধু বিশ্বকাপে হাজির ৩২টি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এ এমন এক মিলনমেলা, যেখানে রয়েছে সবার প্রবেশাধিকার। শিরোপার লড়াইয়ে যারা আছে, যারা নেই—সবাই হাজির এখানে।

বিশ্বকাপ নিয়ে আসে এক নতুন সামাজিক মেলবন্ধনের বার্তা। প্রতিটি বিশ্বকাপ অবধারিতভাবেই মনে করিয়ে দেয় আগের বিশ্বকাপটিকে এবং অবিকল্পভাবে সেই বিশ্বকাপের সহদর্শককে। সে হতে পারে বন্ধু, হতে পারে সহকর্মী কিংবা যে কেউ। মনে পড়ে যায় খেলা নিয়ে চলা বচসার কথা। আর এই স্মৃতির সূত্র ধরেই এমনকি শুরু হয়, হারানো বন্ধুর খোঁজও। তাই বিশ্বকাপ ফুটবল এক সুবৃহৎ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও।

ফুটবলের মাঠ কখনো কখনো হয়ে ওঠে ক্যানভাস। ত্রস্ত হরিণের মতো কোনো এক খেলোয়াড়ের চকিত ছুট সে ক্যানভাসে এঁকে দিতে পারে গতির পরম্পরা। কেউ হয়তো স্টেপওভারে দিতে পারেন ব্যালের আস্বাদ।এমনকি মেসি-রোনালদো-নেইমারের মতো ফুটবলারদের প্র্যাকটিসেও কেউ খুঁজে পেতে পারে সার্থক কোরিওগ্রাফির ছন্দ।

ফুটবলে নায়ক থাকে। থাকে খলনায়কও। স্পেনের সঙ্গে ম্যাচের নায়ক যদি হন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, পরের ম্যাচে তাঁর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী লিওনেল মেসিকে তবে আপাত খলনায়ক বলাই যায়। পেনাল্টি মিস করেছেন যে তিনি। শুধু ম্যাচের ফল দিয়ে নয়। ফুটবল মাঠে বিশেষত বিশ্বকাপে প্রতিনিয়ত নায়ক-প্রতিনায়কের চরিত্র বদল হতে থাকে। নব্বই মিনিটজুড়েই।

ফুটবলের শিল্প হয়ে ওঠার জন্য আর কী প্রয়োজন। প্রথাবদ্ধ সমীকরণ দিয়েও এর শিল্পসত্তাকে বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব। ধরা যাক সাহিত্যের কথা। বাইবেল থেকে শুরু করে মহাভারত, কিংবা ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট, অথবা প্যারাডাইস লস্ট, যে মহৎ সাহিত্যের কথাই বলা হোক না কেন, অন্ধকার থেকে আলোর দিকে অভিযাত্রার আখ্যানই তার মর্মকথা। কিংবা চলচ্চিত্র; এক অনিঃশেষ দ্বন্দ্বের ধারা ধরেই এগোয় এর কাহিনি। ফুটবলেও তাই। এখানে উপন্যাস ও চলচ্চিত্রের মতো দ্বন্দ্ব সু ও কু-এর মধ্যে হয় না। এখানে কোনো ভালো ও মন্দ নেই। এখানে আছে প্রতিপক্ষ। এখানে নন্দনের বিপরীতে নন্দনই লড়াই করে আরও উচ্চতর নান্দনিক সমন্বয়ে। আর নেহাতই যদি উপন্যাস কিংবা চলচ্চিত্রের দ্বন্দ্বের দুই চিরায়ত সত্তাকেই সত্য মানতে হয়, তবে তা-ও উপহার দিয়েছে বিশ্বকাপ। তা-ও একটিমাত্র ম্যাচে। এখানে বলতেই হয়, ১৯৮৬ বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনা বনাম ইংল্যান্ড ম্যাচের কথা, যেখানে মাত্র চার মিনিটের ব্যবধানে এক ম্যারাডোনাই উপহার দেন সবচেয়ে বিতর্কিত ও সবচেয়ে সুন্দর গোলের। কী ভর করেছিল সেদিন ম্যারাডোনার ওপর। হাত দিয়ে দেওয়া গোলটি নিয়ে সমালোচনার মুখ বন্ধ করতে নিজের হাতকে তিনি সেদিন বলেছিলেন হ্যান্ড অব গড। আর পরের গোলটি তো ইতিহাস। হ্যাঁ ইতিহাস। সেই ম্যাচটির সঙ্গে ইতিহাস লেপ্টে আছে ঠিকই। তবে তা যুদ্ধের, যেখানে খেলার মাঠের মার্জিত নিয়ম খাটে না। গোলাবারুদের সে যুদ্ধ ১৯৮২ সালের, যেখানে যুক্তরাজ্য পরাজিত করেছিল আর্জেন্টিনাকে।

পেনাল্টি থেকে গোল করতে পারলেন না মেসি। ছবি: রয়টার্স
পেনাল্টি থেকে গোল করতে পারলেন না মেসি। ছবি: রয়টার্স

শিল্পের অভিধা পেতে যদি অভাবনীয় কিছু করাটা বাধ্যতামূলক হয়, তবে তা বিশ্বকাপে তো অহরহই ঘটে। স্পেনের বিপক্ষে রোনালদোর ৮৭ মিনিটে নেওয়া ফ্রি-কিক, কিংবা গত বিশ্বকাপের ফাইনালে চরম উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচে হঠাৎ চকিত ঝলকে দেওয়া গোটশের গোল—এই সবই সেই অভাবনীয় মুহূর্তের নির্মাতা। বিশ্বকাপ ফুটবলে তার অভাব হয়নি কখনো।

ফুটবল যেমন নায়কের জন্ম দেয়, তেমনি জন্ম দেয় বিয়োগান্ত নাটকের অঙ্কও, যেখানে শেষ দৃশ্যে নায়কের পরাজয়ই দস্তুর। আর এমন দৃশ্য, বলার অপেক্ষা রাখে না ফুটবল বিশ্বকাপ দেখেছে বিস্তর। শুধু দুটি উদাহরণই যথেষ্ট এখানে। প্রথমটি অতি অবশ্যই ম্যারাডোনা, ১৯৯০ বিশ্বকাপের ফাইনাল থেকে যার বিয়োগান্ত দৃশ্যের শুরু; আর পরিণতি পরের বিশ্বকাপের ডোপ টেস্টে ধরা পড়ার মধ্য দিয়ে। আর দ্বিতীয়টি বলার অপেক্ষা রাখে না জিনেদিন জিদান। ১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপ এনে দেওয়া জিদান ২০০৬ বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলছিলেন নিজের শেষ ম্যাচ হিসেবেই। আবারও নায়ক হয়ে ওঠার জন্য তাবৎ আয়োজন প্রস্তুতই হয়েছিল। কিন্তু লহমার ভুলে সব এলোমেলো। ঢুস-কাণ্ডে লাল কার্ড দেখে মাঠছাড়া জিদান। নিখাদ ট্র্যাজেডি।

এই হলো ফুটবল। নন্দনতত্ত্বের সব উপকরণ নিয়ে হাজির, যার বৈশ্বিক আয়োজন। আনন্দের পাশেই যেখানে দৃশ্যায়ন হতে পারে বিয়োগান্ত অঙ্কের। হাসির পাশেই কান্না। আর এমনই এক নাটকীয়তায় ঠাসা যে শেষ দৃশ্য অবধি টেনে নিয়ে যাবেই। এমনকি মুখ ফিরিয়ে নিলেও, পার্শ্ববর্তী জনের কথায়, ধারাভাষ্যে। এ শিল্প নয় তো শিল্প কী?