ঈদ আনন্দ, ফুটবল উন্মাদনা ও রাজনীতি

ঈদে শুভেচ্ছা জানাতে কার্ড পাঠানোর চল এখনো আছে। তবে সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে ডিজিটাল ঈদ শুভেচ্ছা। তবে ঈদে এবার অনেক বাড়তি আনন্দেরও উপাদান আছে। আশা করি সবাই এসব উপাদানের কিছু না কিছু উপভোগ করতে পারবেন।

এবারের ঈদের বাড়তি আনন্দের উপকরণের মধ্যে অবধারিতভাবেই আছে বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর। বাঙালির মতো ফুটবলপ্রেমী সারা বিশ্বে বিরল। জমি বেচে পছন্দের দলের পতাকা বানানো কিংবা সংসারে বছরের বাজার খরচের টাকা দিয়ে পুরো ছয়-সাততলা ভবন অন্য একটি দেশের পতাকার রঙে রাঙানোর দৃশ্য আর কোথায় দেখা যাবে বলুন।

ফুটবলের আগে আনন্দে ভাসিয়েছে আমাদের নারী ক্রিকেটাররা। ছেলেরা এত দিন ধরে ক্রিকেট খেলে খেলাটিকে আমাদের দেশে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপাটি মেয়েরাই এনে দিয়েছে। তা–ও আবার মেয়েদের ক্রিকেটের এশিয়ার মুকুট যাদের কাছে ছিল, সেই ভারতকে টুর্নামেন্টে দু-দুবার হারিয়ে দিয়ে। এখানেও বাড়তি পাওনা আনন্দ-উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত জাতি এত দিনে নারী-পুরুষের আয়বৈষম্যের বিষয়েও সচেতন হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, নারী ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক কম কেন?

খেলার আনন্দে দেশ মাতোয়ারা থাকলে সরকারেরও সুবিধা অনেক, রাজনীতির টানাপোড়েন নিয়ে দুর্ভাবনার চাপটা কম থাকে।

২.

ঈদের সময় বাড়িমুখী মানুষের ভোগান্তি সবারই একটা বড় মাথাব্যথার কারণ হয়। সাম্প্রতিক কালে রাজধানীর রাস্তাঘাট ছাড়াও মহাসড়কেও যে দুঃসহ যানজটের বিবরণ প্রকাশিত হচ্ছিল, তাতে সবার মধ্যে একধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। সম্ভবত সে কারণেই দুদিন আগে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বললেন, সড়কের চিন্তায় তাঁর অর্ধেক রাত ঘুম হয় না (প্রথম আলো অনলাইন, ৯ জুন, ২০১৮)। সড়ক পরিবহনমন্ত্রীর ঘুম না হওয়া খুবই চিন্তার বিষয়। তিনি তো শুধু গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী নন, একই সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলেরও সাধারণ সম্পাদক। সড়কের জন্য অর্ধেক ঘুম নষ্ট হলে দলের জন্যও যে বাকি অর্ধেক নষ্ট হবে না, এমন কথা তো জোর দিয়ে বলা যায় না। বিশেষ করে যখন দলের একজন সাংসদের বিরুদ্ধে মাদক কারবারের অভিযোগ থাকলেও তিনি নির্বিঘ্নে দেশ-বিদেশ করতে পারেন, অথচ তাঁরই এলাকার আরেকজন জনপ্রতিনিধি ‘মাদকবিরোধী অভিযানে ভুল হওয়ায়’ প্রাণ হারান। সড়ক পরিবহনমন্ত্রী অবশ্য একই সঙ্গে বলেছেন, ‘ঈদ উপলক্ষে ঘরমুখী মানুষের সড়কপথে রাস্তার কারণে কোনো দুর্ভোগ হবে না। আমি আশ্বস্ত করে বলছি, সংকট হলে আমি নিজেই গিয়ে দাঁড়াব।’ ভোগান্তিমুক্ত ঈদ যে কত আনন্দের, তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মন্ত্রীর আশ্বাসও যে সেই বাড়তি আনন্দের উপাদান, সে কথা তো মানতেই হবে!

৩.

ঈদের সময় রাজনীতিও বাড়তি আনন্দের কারণ হতে পারে, বিশেষ করে নির্বাচনের বছরে। ভোটের বছরে ভোটারদের কদর বাড়ে, রাজনীতিকেরা তাঁদের খোঁজখবর করেন, সেটাই বা কম কী! রাজনীতিতে অনেক দিন ধরেই বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে নির্বাচনটা ঠিকমতো হবে তো? ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির পুনরাবৃত্তি ঘটে কি না, তা নিয়ে ভাবনার অন্ত নেই। সেই উদ্বেগ কিছুটা লাঘব করেছেন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা ও ১৪ দলের সমন্বয়কারী মোহাম্মদ নাসিম। প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন এবং বিএনপিও নির্বাচনে আসবে। রাজনীতির অন্দরমহলের সব খবর সব সময় পাওয়া যায় না। সুতরাং ধরে নেওয়া অন্যায় হবে না যে তাঁর এই জোরালো আশাবাদ তৈরির বিষয়টি ফাঁপা নয়। খালেদা জিয়া যাতে মুক্তি না পান, সে জন্য রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তার যতটা উদ্যমী তৎপরতা দেখা গেছে, তাতে একটু ঢিলে দেওয়ার বিষয়টি তো সরকারেরই হাতে।

জিয়া অরফানেজের দুর্নীতির মামলায় জামিনের বিরুদ্ধে আপিলের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়েও সরকারের বিশেষ উৎসাহের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আদেশে বলা হয়েছে, ‘তাঁরা এই বাস্তবতাকে বিচারিক বিবেচনায় নিচ্ছেন যে ডেথ রেফারেন্সসহ বিপুলসংখ্যায় আপিল হাইকোর্ট ডিভিশনে অপেক্ষমাণ রয়েছে, কেননা সেগুলোর পেপারবুক তৈরি হয়নি (খালেদা’স গ্রাফট কেস: পেপার বুকস প্রিপেয়ারড ইন হ্যাস্টে: সুপ্রিম কোর্ট, ডেইলি স্টার, ১২ জুন, ২০১৮)। সাধারণভাবে ডেথ রেফারেন্সগুলোর অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা বলেও আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার মামলাকে সরকার রাজনৈতিক কারণে অগ্রাধিকার দিচ্ছে বলে বিএনপির এত দিনের দাবির একটা সমর্থন এখানে মেলে।

ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া কিংবা আবদুর রহমান বদির মতো ক্ষমতাসীন দলের ডজনখানেক নেতার মামলায় গত কয়েক বছরে আপিল শুনানির প্রশ্নে দুর্নীতি দমন কমিশনের নিষ্ক্রিয়তার নজিরও এ ক্ষেত্রে তাদের সহায়ক হবে। মামলার বাদী দুদক হলেও তার আপিল এবং জামিনের বিরোধিতায় রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ উৎসাহ এবং অতিসক্রিয়তাও যে বিষয়টিতে রাজনীতি টেনে এনেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং বিএনপি যে নিজেদের রাজনৈতিক আক্রোশের শিকার হিসেবে দেখাতে চায়, তাদের সেই আশা পূরণ হওয়া তো তাদের জন্য মন্দের ভালো! উপরন্তু খালেদা জিয়ার চিকিৎসা-প্রশ্নে সরকারের অবস্থানটিও এখন রাজনীতির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইব্রাহিম কার্ডিয়াকের মতো বেসরকারি হাসপাতালে অন্য কারাবন্দীদের চিকিৎসার রেকর্ড থাকলেও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা কারাবিধিতে নেই বলে কর্তৃপক্ষের দাবিই এই টানাপোড়েনের কারণ।

বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত এখনো নেয়নি। এর আগে দলটি একাধিকবার বলেছিল, তারা তাদের দলীয় প্রধানকে জেলে রেখে নির্বাচনে অংশ নেবে না। এবারে অন্তত নির্বাচনে যাওয়ার সম্ভাবনা তিনি একেবারে নাকচ করে দেননি। আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার মুক্তি যে প্রায় অসম্ভব, সেটি এখন মোটামুটি স্পষ্ট। একটি মামলায় জামিন হলেও আরও অন্তত ৩৩টি মামলায় তাঁর জামিন না-ও হতে পারে। আবার যে মামলায় সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে জামিন দিয়েছেন, সেই মামলায় দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল জুলাই মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টের প্রতি নির্দেশনাও আছে। তারপরও নির্বাচনে অংশগ্রহণের সম্ভাবনা জিইয়ে রাখার বিষয়টিও নিশ্চয় অনেকের জন্য স্বস্তিদায়ক!

ঈদের বাড়তি আনন্দের অবশ্য আরেকটি উপাদান হচ্ছে বিশ্বশান্তির প্রসারে দুই খ্যাপাটে রাষ্ট্রনেতার সমঝোতা। পূর্ব এশিয়ার কোরীয় উপদ্বীপকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার দুই নেতার ঐতিহাসিক শীর্ষ বৈঠক কিছুদিন আগেও ছিল অসম্ভব। ‘লিটল রকেটম্যান’ এবং ‘ভীমরতিগ্রস্ত বুড়ো’ বলে একে অপরকে হেয় করা এবং কার পারমাণবিক বোমার বোতাম বড়, তা নিয়ে হাস্যকর বাহাসের পর এত অল্প সময়ে এ ধরনের একটি বৈঠককে তাঁরা নিজেরাই ফ্যান্টাসির সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁদের বৈঠকের ফলে এখন দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ সামরিক মহড়াও স্থগিত হয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এই শান্তি উদ্যোগের সাফল্য নিয়ে সবার মনে সন্দেহ থাকলেও সাময়িক স্বস্তিটার মূল্যও তো কম নয়।

অবশ্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঠাট্টাচ্ছলে দেওয়া স্বীকারোক্তির কথাটিও আমাদের মনে রাখা দরকার। কিমের বাবা এবং দাদা এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একই রকম চুক্তি করলেও তা যেহেতু তাঁরা মেনে চলেননি, সেহেতু এই চুক্তির গ্যারান্টি কী? এই প্রশ্নের উত্তরে ট্রাম্প প্রথমে বললেন, ছয় মাস পরে যদি তেমনটি দেখি, তাহলে বলব ভুল হয়ে গেছে। আবার সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ভুল অবশ্য আমি স্বীকার করি না। একটা কিছু অজুহাত দিয়ে দেব। ঈদের সময়টা সবাই ভালো কাটাবেন, সেই কামনা করলেও শুধু এটুকু মনে রাখা ভালো যে রাজনীতিকেরা কিন্তু সব দেশেই এক রকম!

কামাল আহমেদ সাংবাদিক