ভবিষ্যদ্বাণী যেখানে সহজে খাটে না

অক্টোপাস পল ২০০৮–২০১০ সালের মধ্যে ইউরো ও বিশ্বকাপ নিয়ে ১৪টি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। ছবি: রয়টার্স
অক্টোপাস পল ২০০৮–২০১০ সালের মধ্যে ইউরো ও বিশ্বকাপ নিয়ে ১৪টি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। ছবি: রয়টার্স

ফুটবল বিশ্বকাপ আসতেই খোঁজ পড়ে গুনিনের। টানো দাগ, পড়ো মন্ত্র, দেখাও তোমার কেরামতি। ক্রীড়া পরিসংখ্যানবিদদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুম নেই গণিতবিদদেরও। এ সময় সাবেক খেলোয়াড়দের কদর বেড়ে যায় বহুগুণে। কারণ একটাই, বিজয়ীর পূর্ব তালাশ। সবকিছুতেই যেন পাওয়া যায় ত্রিকালদর্শী টিরেসিয়াসের অবয়ব। উত্তেজনার পারদ এতই উঁচুতে থাকে যে মানুষ একটু অবলম্বন চায়, চায় একটু নির্ভরতা। নিজ দলের পক্ষে ভবিষ্যদ্বাণী পেলে একটু যেন শ্বাস ফেলতে পারে সে।

কিন্তু হায়, এই পৃথিবীতে এমন কোনো দক্ষ গুনিন নেই। অবশ্য অক্টোপাস পলের কথা আলাদা। ২০০৮ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ইউরো ও বিশ্বকাপ নিয়ে মোট ১৪টি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল পল, যার ১২টিই সত্যি হয়েছিল। সে এখন শুধুই স্মৃতি। অকালেই ঝরে গেছে সে। তার সঙ্গে সঙ্গে সলিলসমাধি হয়েছে গোপন বিদ্যারও। এরপর প্রাণিকুল থেকে বহু সদস্য পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছে ভবিষ্যদ্বক্তা হিসেবে। কিন্তু কেউই রাজ্যপাট গুছিয়ে উঠতে পারেনি।

এবারের বিশ্বকাপেও এমন অনেক ভবিষ্যদ্বক্তার দেখা মিলছে। পাড়ায়-মহল্লায় চায়ের কাপের তর্কে কেউ হয়তো বলে বসেছে, ‘আরে, ঈদের দিনে আর্জেন্টিনা হারছে কখনো?’ কিংবা কোনো ব্রাজিল-সমর্থক হয়তো বলেছে, ‘রোববারে ব্রাজিলই জেতে।’ এসব অকাট্য যুক্তির (!) বিপরীতে কিছুই বলার থাকে না। কে খুঁজবে ব্রাজিলের রোববারের ম্যাচের খতিয়ান। এগুলো নিত্য চলে। আর যদি মূল মঞ্চের কথা বলা হয়, তবে সেখানে এরই মধ্যে হাজির অ্যাকিলিস নামের এক বধির বিড়াল। টাইম ম্যাগাজিনের তথ্যমতে, কনফেডারেশনস কাপের ফল গণনায় ব্যাপক দক্ষতা দেখানোর পর এই রুশ বিড়ালের ওপরই এখন সবার নজর। এই বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচের ভবিষ্যদ্বাণীর সফলভাবেই করেছে অ্যাকিলিস। চূড়ান্ত ফল গণনায় শেষ পর্যন্ত কতটা বীরত্ব সে দেখাবে, তা সময়ই বলে দেবে।

রয়েছে গণিতবিদ সাম্পটার নির্মিত অব্যর্থ ‘সকারবট মডেল’। এখন পর্যন্ত এই বিশেষ প্রযুক্তির মাধ্যমেই নাকি ফুটবলে সবচেয়ে ভালো ভবিষ্যদ্বাণী পাওয়া গেছে। মজার বিষয় হচ্ছে, বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত হওয়া চারটি বড় দলের ম্যাচে কিন্তু এই ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণিত হয়েছে। অব্যর্থ মডেলটিকে ভুল প্রমাণ করে স্পেনকে ড্র করতে বাধ্য করেছে পর্তুগাল, জার্মান-দম্ভ চুরমার করে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে মেক্সিকো, আর দুই ফেবারিট ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনাকে জয়বঞ্চিত করেছে আইসল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ড।

বাদ রইলেন ফুটবল বোদ্ধা ও বিশ্লেষকেরা। বলার অপেক্ষা রাখে না, তাঁদের অধিকাংশেরই প্রাক-ম্যাচ ভবিষ্যদ্বাণী মুখ থুবড়ে পড়ছে শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে। এত সবের পরও বসে নেই বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো। গোল্ডম্যানস্যাকসই যেমন এবারের বিশ্বকাপ বিজয়ী হিসেবে বেছে নিল ব্রাজিলকে। আর নেদারল্যান্ডস ও সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আর্থিক ও বিনিয়োগ পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান আইএনজি ও ইউবিএস বেছে নিয়েছে যথাক্রমে স্পেন ও জার্মানিকে। এদিকে জাপানভিত্তিক একই ধরনের আরেক প্রতিষ্ঠান সম্ভাব্য বিজয়ী হিসেবে বলছে ফ্রান্সের নাম। এ যেন এক বিচিত্র ক্যালিডোস্কোপ, যেখানে হাত ঘোরালেই বদলে যায় বিজয়ীর নাম।

বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে এমন হাজারো ভবিষ্যদ্বাণী শোনা যায়। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে হাজির হন শত শত পরিসংখ্যানবিদ। নানা খতিয়ান খুলে তাঁরা দেখাতে থাকেন নিজের পক্ষে শত শত যুক্তি। কিন্তু একই পরিসংখ্যান বই থেকে তথ্য তুলে একেক বিশারদ হাজির করেন একেক বিজয়ীর নাম। ফলে সাধারণ মানুষ তাতে খুব একটা আশ্বস্ত হতে পারে না। এতে তাদের দোষ দেওয়াও চলে না। বরং পরিসংখ্যানবিদের ভাষ্যে সন্দেহ রাখাটাই উচিত। কারণ এই যে এত এত মডেল, এত এত যোগ-বিয়োগ অঙ্কের কারিকুরি, এসবের কোনোটিতেই হয়তো বিশ্বকাপের আগমুহূর্তে স্পেনের কোচ বরখাস্ত হওয়া কিংবা মোহাম্মদ সালাহর আহত হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এমনকি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে ছবি তোলার কারণে সমর্থকদের কাছ থেকে মেসুত ওজিলের দুয়ো শোনা কিংবা আগের ম্যাচে রোনালদোর হ্যাটট্রিকে মেসির ওপর তৈরি হওয়া পাহাড়সম চাপ—এর কোনোটিই এসব পরিসংখ্যান ও দলীয় শক্তিমত্তার বিচারে তৈরি ভবিষ্যদ্বাণীতে বিবেচনা করা হয়নি। এদিক থেকে গণিতবিদদের তুলনায় কিছুটা হলেও এগিয়ে আছে বাজিকরেরা। তারা অন্তত মোহাম্মদ সালাহর ইনজুরিকে ধর্তব্যে নিয়েছিল।

বেটফেয়ার এক্সচেঞ্জের বরাত দিয়ে ইকোনমিস্ট বলছে, মোহম্মদ সালাহর ইনজুরির খবর নিশ্চিত হওয়ার পর বিশ্বকাপে মিসরের দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠার সম্ভাব্যতা তারা ৪০ শতাংশ থেকে নামিয়ে ৩০ শতাংশ করেছিল। আর তার সেরে ওঠার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা আবার বেড়ে ৪০ শতাংশ হয়েছিল। জার্মানির যতটা অবনমন হয়েছে, তা প্রস্তুতি ম্যাচের ফলের হিসাবে। মেসুত ওজিল কিংবা গুনদোগানের মানসিক অবস্থার কারণে নয়। অথচ এটিই মাঠে পার্থক্য গড়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু কোচ বরখাস্তের ঘটনার পরও বাজিকরেরা স্পেনের শিরোপা জয়ের সম্ভাব্যতায় কোনো নড়চড় করেনি। এদিক থেকে বাজিকরদের সঙ্গে পরিসংখ্যানবিদদের কোনো পার্থক্য নেই। দুই দলই শিরোপা জয়ের ক্ষেত্রে অর্কেস্ট্রা প্রধান কোচদের কোনো ভূমিকাই দেখতে পায় না।

এই বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচের ভবিষ্যদ্বাণী সফলভাবেই করেছে অ্যাকিলিস। ছবি: রয়টার্স
এই বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচের ভবিষ্যদ্বাণী সফলভাবেই করেছে অ্যাকিলিস। ছবি: রয়টার্স

বিশ্বকাপ আসরের ৬৪ ম্যাচের প্রতিটিই অনিশ্চয়তায় ভরা। এখানে এমনকি বহুল কথিত ‘ফর্ম ইস টেম্পোরারি, বাট ক্লাস ইস পারমানেন্ট’ বাক্য আউড়েও কোনো লাভ নেই। থাকলে দুবারের বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা হাঙ্গেরির ১৯৮৬ সালের পর আর বিশ্বকাপ মূল পর্বে ঠাঁই না পাওয়ার কোনো উত্তর মেলে না। এমনকি ফিফা র‍্যাঙ্কিংও এখানে নীরব। গুণীজনেরা বরং ফিফার র‍্যাঙ্কিং থেকে এগিয়ে রাখেন ইএলও (ইলো) ফর্মুলাকে। মূলত, দাবার জন্য তৈরি করা এই ফর্মুলা পরে প্রায় সব খেলার ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা হয়। এতে রেটিং পয়েন্টের ভিত্তিতে র‍্যাঙ্কিং করা হয়। আর রেটিং পয়েন্টের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয় ঘরের মাঠ ও প্রতিপক্ষের মাঠের পারফরম্যান্সকে। প্রতিটি খেলার পরই এতে পরিবর্তন আসে। ফুটবলের ক্ষেত্রে এই ধরনের র‍্যাঙ্কিং দেয় ইলোর‍্যাঙ্কিং ডটনেট। দেরিতে হলেও ফিফা অবশেষে এই পদ্ধতির কার্যকারিতাটি অনুধাবন করতে পেরেছে। বিশ্বকাপের পরপরই ইলো ফর্মুলা অনুসারে র‍্যাঙ্কিং করতে শুরু করবে বলে জানিয়েছে ফিফা।

তবে এত যার গ্রহণযোগ্যতা, তারও রয়েছে খাদ। ইকোনমিস্টের তথ্যমতে, পরিসংখ্যানবিদেরা এই পদ্ধতির একটি বড় গলদ বের করেছেন। তাঁদের মতে, এই পদ্ধতিতে প্রতিটি দলের ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এতে ১৮৭২ সালের হিসাবও বিবেচনায় নেওয়া হয়। কিন্তু বর্তমানে আগের তুলনায় অনেক কম গোল হয়। আগে যেখানে একটি ম্যাচে গড়ে গোল হতো সাড়ে চারটি, এখন তা নেমে এসেছে আড়াইটিতে। ফলে ইলো পন্থায় একই সঙ্গে জয়-পরাজয় ও গোলের হিসাব নেওয়ায় র‍্যাঙ্কিংয়ে গড়বড় হতে পারে।

আবার আরেক দল গণিতবিদ আছেন, যাঁরা ফুটবলে জয়-পরাজয়ের হিসাবটি পুরোপুরি বাদ দিয়ে সেখানে শুধু গোল, লাল কার্ড ও ঘরের মাঠের সুবিধার বিভিন্ন হিসাব নিয়ে কাজ করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করেন। এই পন্থার অনুসরণকে অধিকতর যৌক্তিক বলে দাবি করে ফুটবল পরামর্শক সংস্থা টুয়েন্টি ফার্স্ট ক্লাব। তাদের তালিকায় সবচেয়ে ওপরের স্থানটি রয়েছে ব্রাজিলের দখলে। কারণ, দলটি গত দুই বছরে মাত্র পাঁচটি গোল খেয়েছে। বিপরীতে দিয়েছে ৪৭টি গোল। এই ক্লাবের হিসাবে ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জয়ের সম্ভাবনা ৩২ শতাংশ। কিন্তু এদের পরের ভাষ্যটিই এই গণনা ও রেটিং নিয়ে সন্দেহ তৈরি করে। কারণ, তারা জার্মানির বিশ্বকাপ জয়ের সম্ভাবনা বলছে মাত্র ৫ শতাংশ।

হুস্কোরড ডটকম নামের আরেক পরিসংখ্যান ওয়েবসাইট আছে, যারা প্রতিটি দলের খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত দক্ষতা বিচার করে একটি র‍্যাঙ্কিং করার চেষ্টা করেছে। এই ক্ষেত্রে তারা খেলোয়াড়েরা কতবার বল স্পর্শ করলেন কিংবা কটি সফল পাস দিলেন বা বিপরীত পক্ষের পা থেকে কতবার বল কেড়ে নিলেন—এসবের একটি হিসাব করে। সে এক বিরাট যজ্ঞ! এতে সারা মাঠ দাপিয়ে বেড়ানো খেলোয়াড়টিকেই দলের সবচেয়ে দক্ষ ও নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় বলে মনে হওয়ার কথা। কিন্তু এ তো জানা কথাই যে দলের সেরা খেলোয়াড়টি এমনকি বল ছাড়াই ম্যাচে ছড়ি ঘোরাতে পারেন।

ফুটবল এমনিতেই এক ঘোর অনিশ্চয়তার খেলা। কে ভেবেছিল এই বিশ্বকাপ খেলবে না দুই পরাশক্তি ইতালি ও নেদারল্যান্ডস। কিংবা ২০০২ বিশ্বকাপে কে ভেবেছিল আগের টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স বাদ পড়বে প্রথম রাউন্ড থেকেই। এমন অন্তত তিনটি বিশ্বকাপ পৃথিবী দেখেছে, যেখানে আগের টুর্নামেন্টের বিজয়ী দল পৌঁছাতে পারেনি দ্বিতীয় রাউন্ডে। গেল বিশ্বকাপেই এ ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছিল স্পেন। তাই যা-ই বলা হোক না কেন, বিশ্বকাপে সহজ বলে কিছু নেই। আগে থেকে ফল জেনে নেওয়ার কোনো সহজ অঙ্ক নেই এখানে। কিছু ভবিষ্যদ্বাণীর কাকতালীয় মিল থাকতে পারে শুধু, যা হতে পারে সমর্থকের উত্তেজনা প্রশমনের সহজ আশ্রয়। সেও মিলবে ভূরি ভূরি। এই গুনিন মনের কথাটি না বললে বয়েই গেল, অন্য গুনিন আছে না! আর তাও না মিললে কাছের শিশুটির কাছেই যাওয়া ভালো। দুই আঙুল বাড়িয়ে ভবিষ্যৎ জানার পুরোনো কৌশলে। মিলে গেল তো বেশ। না মিললেও ক্ষতি কী, সরল হাসির সান্ত্বনা পুরস্কার তো আগেই পাওয়া হয়ে গেছে।
অারও পড়ুন :-