ফুঁসছে মনু, খোয়াই, সুরমা, কুশিয়ারা!

প্রথম আলাে ফাইল ছবি
প্রথম আলাে ফাইল ছবি

ঈদ আর ফুটবলের আনন্দে মনু-খোয়াই-সুরমার খবর, বন্যার দুঃসংবাদ হারিয়ে গেছে। গত বছর হাওরের ফসল শেষ করা চৈত্র-বৈশাখের বন্যা ছিল খেতখামারের বন্যা, মানুষের বাড়িঘর-রাস্তা সয়লাব হয়নি সেই প্রথম ধাক্কার বানে। ঘরবাড়ি ভাসানো বন্যা আসে আষাঢ়ের শেষ ভাগে আর জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে। এবার মনু, খোয়াই, সুরমা, কুশিয়ারা যখন ফুঁসে উঠেছে, সে সময় আসতে প্রায় ২০-২২ দিন বাকি।
মৌলভীবাজারে মনু নদের হুট করে আসা বন্যা বা ফ্ল্যাশ ফ্লাড নতুন কিছু নয়। তবে মৌলভীবাজার শহর ১৯৮৮ সালের পর এবারের মতো আর হুমকির মুখে পড়েনি। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জনসাধারণকে সতর্ক থাকতে ঈদের আগের দিন শুক্রবার দুপুর থেকে শহরে মাইকিং করা হয়।
মৌলভীবাজার শহরের কাছে মনু নদের পানি অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকায় শহরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। একপর্যায়ে শহর প্রতিরক্ষা বাঁধ চুইয়ে শহরের দিকে পানি প্রবেশ করায় এম সাইফুর রহমান (সাবেক সেন্ট্রাল রোড) সড়ক দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ঈদের সব আনন্দ ভুলে, আতঙ্কিত মানুষ ঈদের চাঁদ দেখার বদলে মনু নদের পাড়ে পানির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। এর মধ্যেই রাত দুইটার দিকে রাজনগর উপজেলার টেংরা ইউনিয়নের কোনাগাঁও ও মনসুরনগর ইউনিয়নের প্রেমনগরে বাঁধ ভেঙে এলাকার পাঁচ-ছয়টি গ্রাম নতুন করে পানিতে তলিয়ে যাওয়ার খবর আসে। এতে মানুষ আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। মৌলভীবাজারের পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তাদের ধারণা ছিল, শহর রক্ষা বাঁধ টিকে যাবে, শহরে পানি ঢুকলে বাঁধ উপচে পানি ঢুকবে। এর মধ্যে শহরের পশ্চিম দিকে বারাইকন এলাকার বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। আশার কথা, পানি আর বাড়ছে না।
মৌলভীবাজার শহর সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় কোনোমতে আপদ রক্ষা করা সম্ভব হলেও ভারতের মেঘালয় ও আসামের সীমান্ত ঘেঁষা জকিগঞ্জের পরিস্থিতি প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে, সেখানে এখন দেড় লাখের বেশি মানুষ জলবন্দী হয়ে পড়েছে, সিলেট-জকিগঞ্জ সড়কের নানা জায়গা পানিতে ডুবে যাওয়ায় এই সড়কে ঈদের দিন বিকেল থেকে গাড়ি চলাচল বন্ধ রয়েছে। জকিগঞ্জ সদর, মানিকপুর, বারঠাকুরি, বারহাল, বীরশ্রী, কসকনপুর, কাজলসার, ইউনিয়ন পুরোপুরি ও পৌর এলাকার একাধিক ওয়ার্ড, সুলতানপুর ও খলাছড়া ইউনিয়নের কিছু অংশ এখন পানির নিচে।
জকিগঞ্জের পরিস্থিতি এত অবনতির কারণ কী?
জনপদকে বন্যামুক্ত রাখা বা বন্যাকে সহনীয় মাত্রায় আটকে রাখার জন্য সুরমা-কুশিয়ারা নদীতে যেসব বাঁধ দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো টেকেনি। অন্তত ২৫টি স্থান দিয়ে বাঁধভাঙা পানি হু হু করে ঢুকেছে লোকালয়ে। উপজেলার বারঠাকুরি ইউনিয়নের মিনাপাড়ায় মাহতাবের বাড়ির সামনে সুরমা নদীর বাঁধের প্রায় ২০০ ফুট ভেঙে পানি ঢুকে যায়। পিল্লাকান্দি গ্রামের মনু মিয়ার বাড়ির সামনে কুশিয়ারা নদীর বাঁধেও ভাঙন দেখা দিয়েছে।
বাঁধভাঙা ছাড়াও জকিগঞ্জের আমলশীদ, শাহশরীফসহ একাধিক স্থানে ডাইক উপচে পানি ঢুকছে। ডাইক উপচানো ঢল কি এবার এসেছে?
প্রবল বৃষ্টির সঙ্গে আসাম আর মেঘালয়ের বরাক ও লোভা নদীর পানির ঢলে সুরমা, কুশিয়ারা ফুলে উঠলেও ডাইক উপচানো পানি সেটা ছিল না। আসলে সুরমা ও কুশিয়ারা নদী থেকে হাওরের সংযোগকারী ৩৭টি খালনালা বন্ধ থাকায় এই কৃত্রিম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অভিযোগ আছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড সব কটি স্লুইসগেট বসিয়ে ঠিকাদারের পাওনা পরিশোধ করলেও নির্মাণের এক বছরের মধ্যেই সব স্লুইসগেট অকার্যকর হয়ে পড়ে।
শুধু তা-ই নয়, চলতি বছর পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ মেরামতের প্রকল্প হাতে নিলেও বাস্তবে কোনো কাজ হয়নি। তা ছাড়া স্লুইসগেট বা জলকপাট রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সার্বক্ষণিক কর্মীর ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এরশাদের আমলে গঠিত প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস বা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিফরম কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী স্কুল-কলেজের লাইব্রেরিয়ান পদ বিলোপের সময় স্লুইসগেট কর্মীদের পদও বিনাশ করে দেওয়া হয়। যুক্তি ছিল গ্রামবাসী স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে স্লুইসগেটের দেখাশোনা করবে। বলা বাহুল্য সেটা হয়নি, পরিণামে আমরা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে পাচ্ছি অকার্যকর জলকপাট আর বন্যা জলাবদ্ধতার অশেষ ভোগান্তি।
জলকপাট বা স্লুইসগেট কাজ না করায় এবার কোনো কোনো জায়গায় পানির তোড় এত বেশি ছিল যে গবাদিপশুর সঙ্গে অনেক মানুষও ভেসে গেছে। এর মধ্যে কমলগঞ্জে বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয়। ঈদের দিন শনিবার সকাল আটটার দিকে শমশেরনগর ইউনিয়নের হাজীনগর গ্রামে সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় রমজান আলী ভেসে যান। একই সময় আলীনগর ইউনিয়নের হালিমা বাজার এলাকায় স্রোতে ভেসে যান সেলিম মিয়া। ওই দিন সকালে কমলগঞ্জ-মৌলভীবাজার সড়কের মান্দারীবন এলাকায় সড়কে ওঠা পানির মধ্য দিয়ে চলাচলের সময় যাত্রীসহ একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভেসে যায়। চালকসহ পাঁচ যাত্রীকে উদ্ধার করা গেলেও অজ্ঞাত পরিচয়ের এক যাত্রীকে এখনো উদ্ধার করা যায়নি। এ ছাড়া শুক্রবার সন্ধ্যায় আলীনগর ইউনিয়নে লাঘাটা ছড়ায় পানিতে ভেসে গেছেন অজ্ঞাত পরিচয় আরেক নারী।
এখনো সব খবর আমরা জানি না। তবে ধারণা করা যায়, এই বন্যা আমাদের অনেক কাঁদাবে। আমরা জানতাম, এবার মৌসুমি বায়ু সময়ের আগেই আসবে, বৃষ্টি হবে পাহাড়ের ঢল নামবে—শুধু এসব তথ্য নয়, আমরা বাঁধ বেঁধেছিলাম পানি হাওরে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য জলকপাট বসানো হয়েছিল। অর্থাৎ পূর্বাভাস আর বন্যার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তি আর টাকা সবই ছিল, আছে; তবু মানুষ কেন মরে। চাঁদের রাতে কেন তাঁদের বাঁধের দিকে তাকিয়ে নির্ঘুম দুশ্চিন্তায় কাটাতে হয় রাত?