এবারের বাজেট কী বার্তা দিচ্ছে?

সংসদে ২০১৮–১৯ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত
সংসদে ২০১৮–১৯ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত

ব্যক্তি বা পারিবারিক ক্ষেত্রে বাজেট একটি নির্দিষ্ট সময়ের আয়-ব্যয়ের হিসাব। কিন্তু একটি জাতির জন্য বাজেটের ভূমিকা আরও অনেক বড়। আয়-ব্যয়ের হিসাবের বাইরে এটি একটি অগ্রাধিকারেরও দলিল। তাই জাতীয় বাজেট ভবিষ্যতের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির সুস্পষ্ট বার্তা বহন করে। ৭ জুন জাতীয় সংসদে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর পেশ করা ২০১৮-১৯ সালের বাজেট কী বার্তা বহন করছে?

সার্বিকভাবে বাংলাদেশের জন্য একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য বিনিয়োগ আবশ্যক। বিনিয়োগ আবশ্যক কল-কারখানা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খাতে, যাতে কর্মসংস্থান হয়। বর্তমানে কর্মসংস্থান আমাদের জন্য একটি পর্বতপ্রমাণ সমস্যা। আমাদের গড় প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের মতো হলেও এ প্রবৃদ্ধি বলতে গেলে কর্মসংস্থানশূন্য। ফলে দেশে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা দুই কোটির ওপরে, যার অধিকাংশই তরুণ। আর স্নাতক ডিগ্রিধারীদের মধ্যে ৪৭ শতাংশই বেকার। উপরন্তু প্রতিবছর ২০ লাখের মতো তরুণ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে, যাদের কর্মসংস্থানের জন্য উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু অনেক দিন থেকেই আমাদের বিনিয়োগ জিডিপির ২৩ শতাংশের মধ্যে স্থবির হয়ে আছে।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা সম্পূর্ণরূপে অবাস্তব। আঙ্কটাডের হিসাবমতে, ২০১৬-এর তুলনায় ২০১৭ সালে বিদেশি বিনিয়োগের হার ৭ দশমিক ৮ শতাংশ কমেছে। আমাদের সংঘাতময়, আত্মঘাতী রাজনীতির কারণে দেশি বিনিয়োগকারীদের অনেকেই ইতিমধ্যেই দেশে বিনিয়োগের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। বস্তুত বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবর্তে তাঁরা বিদেশে অর্থ পাচার করছেন। উদাহরণস্বরূপ, ‘গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি’র তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫-১৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ৬১ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে, যার মধ্যে ২০১৩ সালে হয়েছে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থমন্ত্রীর বাজেটে পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার এবং দেশে বিনিয়োগ কার্যকরভাবে উৎসাহিত করার কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেই, যা কোনোভাবেই একটি ইতিবাচক বার্তা নয়।

বাংলাদেশের বড় সম্পদ আমাদের উঠতি বয়সের জনগোষ্ঠী। আমাদের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের বয়স ২৪ বছর এবং তার নিচে। জনসংখ্যায় এ ধরনের অবস্থাকে অর্থনীতির ভাষায় ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ বলা হয়। এর কারণ হলো, উঠতি বয়সের জনগোষ্ঠী মূলত ভোক্তা না হয়ে উত্পাদক হয়। তারা সাধারণত কর্মক্ষম, সৃজনশীল ও উদ্যমী। তাই জনসংখ্যাজনিত এ সুযোগ কার্যকরভাবে কাজে লাগানোর ওপর একটি দেশের আর্থসামাজিক ভবিষ্যৎ বহুলাংশে নির্ভর করে। প্রসঙ্গত, এ ধরনের সুযোগ চিরস্থায়ী হয় না। তাই এটিকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কাজে লাগানো আবশ্যক।

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে কাজে লাগাতে হলে আমাদের তরুণদের জন্য মানসম্মত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের জন্য যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। একই সঙ্গে তাদের জন্য সুযোগ, বিশেষত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। তা না হলে অর্থবহ কাজে সম্পৃক্ত না হওয়ার কারণে আমাদের তরুণেরা বিপথগামী হতে পারে-এরই মধ্যে অনেকেই ইয়াবা আসক্ত ও বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড আমাদের জন্য ডেমোগ্রাফিক ‘নাইটমেয়ারে’ বা দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে পারে। তরুণেরা আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে বাসের অযোগ্য করে তুলতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের অর্থমন্ত্রীর বাজেটে তরুণদের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের জন্য বিনিয়োগের কোনো বাড়তি ব্যবস্থা নেই। বস্তুত শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক খাতে আমাদের বিনিয়োগ ক্রমাগতভাবে কমেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১০-১১ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ যেখানে ছিল ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ, তা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসে দাঁড়িয়েছে মোট বরাদ্দের ১২ দশমিক ৬ শতাংশ এবং আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১১ দশমিক ৪১ শতাংশ। একইভাবে স্বাস্থ্য খাতে গত অর্থবছরের মোট বরাদ্দের ৫ দশমিক ৩৯ শতাংশের তুলনায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৫ শতাংশে।

আন্তর্জাতিক মান বিবেচনায় নিলে আমাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের চিত্র অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। যেমন আন্তর্জাতিকভাবে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের হার যেখানে জিডিপির ৬ শতাংশ এবং মোট বাজেটের ২০ শতাংশ, আমাদের দেশে তা যথাক্রমে মাত্র ২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ ও ১১ দশমিক ২ শতাংশ। একইভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ যেখানে জিডিপির ৫ শতাংশ, বাংলাদেশে তা শূন্য দশমিক ৯২ শতাংশ। অভূতপূর্ব সম্ভাবনাময় সামাজিক খাতে অপ্রতুল বিনিয়োগের মাধ্যমে আমাদের অর্থমন্ত্রী কী বার্তা আমাদের দিচ্ছেন?

অর্থনৈতিক বৈষম্যের ক্ষেত্রে আসা যাক। বৈষম্যের সূচক গিনি অনুপাত ২০১০-এর শূন্য দশমিক ৪৫৮-এর পরিবর্তে ২০১৬-তে শূন্য দশমিক ৪৮৩-এ এসে দাঁড়িয়েছে, যা আমাদের সমাজে ক্রমবর্ধমান আয় ও সুযোগের বৈষম্যেরই প্রতিফলন। তাই তো ২০১৬ সালের তুলনায় আমাদের সমাজের ৫ শতাংশ শীর্ষ ধনীর আয় বেড়েছে সর্বনিম্ন ৫ শতাংশের আয়ের তুলনায় ১২১ গুণ, যা ২০১০ সালে ছিল ৩১ গুণ। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আমাদের সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু আমাদের প্রস্তাবিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে এ বৈষম্য সহনীয় পর্যায়ে আনার কোনোরূপ দিকনির্দেশনা নেই। বরং আমাদের সমাজে, বিশেষত আর্থিক খাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যে লাগামহীন লুটপাটের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে, তাতে এ বৈষম্য আরও প্রকট হতে পারে। শীর্ষ ব্যবসায়িক সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের মতে, আমাদের ব্যাংকগুলোতে ডাকাত পড়েছে। সরকার এ ডাকাতির সুযোগ করে দিয়েছে এবং ডাকাতদের ডাকাতি করে পার পেয়ে যেতেও দিচ্ছে। এমনকি তাদের ডাকাতি করতে উত্সাহিতও করছে।

আমাদের অর্থমন্ত্রীর আমলেই সরকার ক্ষমতাসীন দলের নেতা বা অনুগতদের ফায়দা প্রদানের লক্ষ্যে সরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে বসিয়েছে। এ বছরের শুরুতে লুটপাটের সুবিধার জন্য একই পরিবারের চারজনকে একনাগাড়ে নয় বছর ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য থাকার আইনি বিধানের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানে পরিবারতন্ত্র কায়েমের সুযোগ সরকার করে দিয়েছে। সম্প্রতি সরকার বেসরকারি ব্যাংকে সরকারি আমানতের হার ৫০ শতাংশে উন্নীত করেছে। লুটপাটের কারণে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে অতীতের মতো সরকার এবারও ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছে। এসব কারণে আগে শুধু সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের সমস্যা থাকলেও বর্তমানে বেসরকারি ব্যাংকগুলোও একই সমস্যায় নিপতিত। এমতাবস্থায় লুটেরাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা না নিয়ে, তাদের মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য আরও বরাদ্দ দিয়ে এবং ব্যাংকিং খাতের জন্য আয়করের হার কমিয়ে অর্থমন্ত্রী আমাদের কী বার্তা দিচ্ছেন? তিনি কি বিশৃঙ্খলা, লুটপাট ও বিচারহীনতাকেই উৎসাহিত করতে চাইছেন? উল্লেখ্য, এ ধরনের সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে ব্যাংকমালিকদের পকেটে সম্পদ হস্তান্তর করা হয়, যা সমাজের বৈষম্য বাড়াতেই সহায়তা করবে। দুর্ভাগ্যবশত ব্যাংকমালিকদের এ ধরনের অযাচিত সুবিধা দিলেও কয়েক শ কোটি টাকা ব্যয়ে শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির ঘোষণা দিতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন, যার জন্য শিক্ষকেরা আন্দোলনে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর জন্য ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ৫৪ হাজার ২০৬ কোটি (বা বাজেটের ১৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ) থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬৪ হাজার ৬৫৬ কোটিতে (বা বাজেটের ১৩ দশমিক ৯২ শতাংশে) বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা সাধারণ মানুষের জন্য সুখবর বলে দাবি করা হয়। কিন্তু এখানেও একটি শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। কারণ, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর ৩৫ দশমিক ২ ভাগ ব্যয় হয় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন বাবদ, আর এঁদের খুব কমই নিম্নবিত্তের কাতারে পড়েন। এটি সুস্পষ্ট যে অর্থমন্ত্রী তাঁর প্রস্তাবিত বাজেটে সমাজে নিম্নবিত্তদের, বিশেষত দরিদ্রদের প্রতি অবিচারই করেছেন। একই সঙ্গে তুষ্ট করেছেন কোটারি স্বার্থকে। নিম্নবিত্তদের প্রতি অবিচারের আরেকটি সুস্পষ্ট উদাহরণ হলো করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ টাকাই রাখা।

অর্থমন্ত্রী একজন বয়োজ্যেষ্ঠ, অতি অভিজ্ঞ এবং প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি। এবার তিনি তাঁর ১২তম বাজেট উত্থাপন করেছেন। আমরা আশা করেছিলাম যে তিনি এ বাজেটে কোটারি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠবেন, কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের প্রস্তাব করবেন এবং আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেবেন। একই সঙ্গে আমাদের বাজেট প্রণয়ন-প্রক্রিয়া যে মান্ধাতার আমলের ছকের মধ্যে আটকা পড়ে গিয়েছে, তা পরিহার করে ভবিষ্যতের জন্য কতগুলো বলিষ্ঠ অগ্রাধিকার নির্ধারণ করবেন। দুর্ভাগ্যবশত আমরা হতাশ হয়েছি।

ড. বদিউল আলম মজুমদার: সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক