'আলু কি গুল কইরা কাটুম, না লাম্বা?'

আমার বাসায় যে নারী গৃহকর্মীটি আছেন, তাঁকে থালাবাসন ধুতে ধুতে কাঁধ আর কানের সংযোগস্থলে বেশ কায়দা করে মোবাইল ফোন চেপে গ্রামে তাঁর মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে শুনি। কোনো দিন তিনি বলেন, ‘বকরিডারে এট্টু মাড় খাতি দিসিত?’ কোনো দিন বলেন, ‘বেগুন আর আলু দি বেশ কইরে ঝোল করিস। জ্বরের থন উডার পর নাতিনডার মুখোত বোলে স্বাদ নাই।’ একদিকে অর্থ উপার্জন, অন্যদিকে সংসারের চিন্তা দুটোই তাঁকে করতে হচ্ছে।

ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রে পোস্ট ডক করা মেয়ে ঘোড়ায় জিন চাপিয়ে দেশে স্কাইপেতে মায়ের কাছে জানতে চায়,
‘মা, কাজে বেরোচ্ছি। দ্রুত কোপ্তা কারির রেসিপিটা বলো। তোমার জামাই ওটা খেতে চায়।’ মায়ের ঝটপট উত্তর, ‘আজকাল ইউটিউব খুললেই তো সব মেলে।’
মেয়ে বলে, ‘না, সে তোমারটা পছন্দ করে।’ এখানেও
মেয়ে কাজের জন্য বেরোলেও সংসারের চিন্তাটা ঠিকই
মাথায় থেকে যাচ্ছে।

বিশ্বজুড়েই কর্মজীবী নারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশেও তাই। একটি গবেষণামতে, গত কয়েক
দশকে দেশে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি হয়েছে। ১৯৯৯ সালে এ হার যেখানে
ছিল ২৫ শতাংশ, ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায়
৩৬ শতাংশে। পোশাকশিল্পেও ৪৪ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ৮০ শতাংশই নারী।

একজন পুরুষের একার আয়ে যেমন একটি সংসার চালানো সহজ নয়, তেমনি এ পুঁজির দুনিয়ায় জীবনযাত্রা সহজ ও সুন্দর করার জন্য হরেক পদের পণ্যের প্রলোভন থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখারও উপায় নেই। তাই শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত ও নিরক্ষর সব ধরনের নারীকে বাধ্য হয়ে ঘরের বাইরে পা রাখতে হচ্ছে। এতে একদিকে তাদের অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে সংসার-সন্তানের ব্যয় নির্বাহের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে, অন্যদিকে সংসারের যাবতীয় কাজও সারতে হচ্ছে।

এতে নারীর পরিশ্রম দ্বিগুণ, কখনো তিন গুণ হয়ে যাচ্ছে। এ দুদিক সামলাতে গিয়ে পেশাজীবী নারীর অবসর মেলে না বললেই চলে। তার ওপর এ দোটানায় থেকে নিজের পেশার ক্ষেত্রে যোগ্যতার উন্নয়নে ও দক্ষতা অর্জনেও পিছিয়ে পড়ছেন তঁারা। কয়েক দিন আগে একজন কর্মজীবী নারী দুঃখ করে বলছিলেন, ‘আর বলবেন না, শুধু নিজের মতো রেঁধেবেড়ে টেবিলে সাজিয়ে দিলেই হবে না, কোন মাছে কোন সবজি, ডাল ঘন না পাতলা, মুরগি ঝোল না কষা—এসবও মাথায় রাখতে হয়।’

আরেক কর্মজীবী নারীর গল্প বলি। সরকারের উচ্চ পদে চাকরি করেন। কোনো একটা মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির মিটিংয়ে মন্ত্রী-এমপিসহ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলছে। সবার মোবাইল বন্ধ। নারী তাঁরটা শুধু ভাইব্রেশনে রেখেছেন, কারণ বাসায় তাঁর শাশুড়ি শয্যাশায়ী। মাঝেমধ্যেই খবরাখবর নিতে হচ্ছে। গৃহপরিচারিকার ফোন। তিনি মাথা ঝুঁকিয়ে হাতের তালুতে ফোনসেট আড়াল করে শুনলেন গৃহপরিচারিকা তাঁর স্বভাবজাত সুউচ্চ কণ্ঠে জানতে চাচ্ছেন, ‘খালাম্মা, আলু কি গুল কইরা কাটুম, না লাম্বা?’ এই হচ্ছে আমাদের কর্মজীবী নারীদের অবস্থা।
সংসার আর চাকরি দুটো একসঙ্গে সামলাতে গিয়ে জেরবার হলেও তঁাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয় খুব কমই। অথচ তঁাদের সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা দরকার। এ সহযোগিতা আসতে হবে বাড়ি ও কর্মক্ষেত্র দুদিক থেকেই।

আমাদের দেশের নারীদের পেশাগত জীবনে পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হয়। অনেক সময় দেখা যায় সন্তানের জন্ম ও লালন–পালনের জন্য অনেক নারী কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। অনেক চাকরিতে বিভিন্ন স্থানে যেতে হয়, নারীর পক্ষে অনেক সময় তা করা সম্ভব হয় না বলে ছেড়ে দিতে হয়। আর যঁারা ছাড়েন না তঁাদের অনেক ধরনের হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়।
বাসার শিশু বা বয়স্করা অসুস্থ হলে নারীকেই বারবার ছুটির দরখাস্ত করতে হয়। এ ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলে, ‘আপনারা নারীর সমান অধিকার দাবি করেন, আবার অফিসের কাজ ফাঁকি দেওয়ার মওকা খোঁজেন।’ অথচ সহযোগিতা পেলে তঁাদের এমন পরিস্থিতির মুখে
পড়তে হয় না।

অনেকে আবার নারীকে দশভুজা মা দুর্গা বলেও সব ধরনের কাজ করিয়ে নেন। ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’ বলে নারীকে উৎসাহ দেওয়া হয়। মানে, এ হচ্ছে নারীকে দিয়ে ঘরে-বাইরের সব কাজ করিয়ে নেওয়ার টোপ। অথচ পুরুষের জন্য এমন কোনো প্রবাদ নেই।

একই সঙ্গে অনেক দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া একজন নারীর করুণ মৃত্যুর স্মৃতি মনে পড়ে। মেয়ের বিয়ের তোড়জোড়, ছেলের বিদেশে পড়তে যাওয়া, এক বাড়ি অতিথির খাওয়াদাওয়া, তাদের সেবাযত্নের ভার নেওয়া, এমনকি ভাড়াটের মেয়ের সন্তান প্রসবের জন্য ক্লিনিকে দৌড়াদৌড়ি করা—সব একা হাতে করছিলেন তিনি। ওরই মধ্যে একটা কষ্ট পুষে রেখে ভেতরে-ভেতরে মনোবেদনায় কাহিল হয়ে পড়ছিলেন। সেটা হচ্ছে তাঁর স্বামী তাঁকে ছাড়া একাই হজে যাচ্ছিলেন।

অথচ ওই নারীর অনেক দিনের শখ ছিল স্বামীর সঙ্গে একত্রে পবিত্র হজ পালন করা। তিনি আড়ালে চোখ মুছছিলেন কিন্তু কাউকে তা বুঝতে দেননি। অতিরিক্ত শারীরিক ও মানসিক চাপেই কি না, যেদিন বিকেলে তাঁর স্বামীর ফ্লাইট, নারী সকালে রান্না করতে করতে পড়ে গিয়ে আর
উঠলেন না। দুঃখজনক হলেও যা সত্যি তা হলো তাঁর দাফনের আগেই স্বামী দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে পবিত্র ভূমির উদ্দেশে উড়াল দেন।
নারীর দক্ষতা, যোগ্যতাকে খাটো করে দেখার সুযোগ আসলে কারোরই নেই। পুরুষদের বুঝতে হবে নারীদের দক্ষতা, যোগ্যতা, মেধা তাদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। নারী পারে না এমন কাজের উদাহরণ বিরল। এশিয়া কাপে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ভারতীয় দলকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশের মেয়েরা। ফেসবুকে প্রচারিত একটা ভিডিওতে তামিম-মাশরাফিসহ ছেলেদের একটি দলকে টিভিতে আমাদের মেয়েদের বিজয় দেখে যে রকম উল্লাস প্রকাশ করতে দেখা গেল, তা নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক। নারীর সাফল্যে ঈর্ষান্বিত না হয়ে তাঁদের পথচলাকে মসৃণ করার এ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
যাঁরা সংসার-সমাজ-দেশ-জাতির জন্য অবদান রেখে চলেছেন বা প্রস্তুতি নিচ্ছেন, সেসব নারীর কাজের বোঝা ভাগাভাগি করে নেওয়ার সময় হয়েছে। জেন্ডার সংবেদনশীল পুরুষেরাই আধুনিক কালের যোগ্য। বাদবাকিরা গোঁড়া, অনাধুনিক, পরিত্যাজ্য।

উম্মে মুসলিমা কথাসাহিত্যিক
[email protected]