আইডি কার্ড প্রকল্পে দুর্নীতি

গণতান্ত্রিক দেশে স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দায়িত্বশীলতার প্রত্যাশা অনেক উঁচু হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের নির্বাচন কমিশনের (ইসি) একটি কাজের বিষয়ে যেসব অভিযোগের খবর পাওয়া গেল, তাতে এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলতার সম্পর্কে হতাশ হতে হয়। ১৯ জুন প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত সরেজমিন প্রতিবেদনে জানা গেল, ৯৩ লাখ ভোটারের কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র যথাসময়ে হস্তান্তরের কাজে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার পেছনের কারণ হিসেবে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তাতেই প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ববোধ সম্পর্কে হতাশা জাগে, এর জবাবদিহি নিশ্চিত করার প্রশ্ন ওঠে।

ইসি ৯ কোটি ভোটারের জাতীয় পরিচয়ের স্মার্ট কার্ড তৈরি ও হস্তান্তরের জন্য ২০১১ সালের জুলাইয়ে আইডিয়া নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বব্যাংক থেকে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা ছিল ২০১৬ সালের জুন। কিন্তু ইসি দরপত্র আহ্বানে বিলম্ব করেছে, তারপর দরপত্র ডেকে যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দিয়ে ফ্রান্সের এক দেউলিয়া প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়েছে। ওবার্থুর নামের সেই প্রতিষ্ঠান কয়েক দফায় সময় বাড়ানোর পরও কাজ শেষ করতে পারেনি। অবশেষে ইসি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে দেনা-পাওনা নিয়ে মামলায় জড়িয়েছে।

এই সময়ের মধ্যে ভোটার আরও প্রায় এক কোটি বেড়ে গেছে। ফলে ইসি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ২০১২ সালের পর ভোটার হয়েছেন, এমন ৯৩ লাখ ভোটারকে স্মার্ট কার্ডের পরিবর্তে কাগজে ছাপানো ও লেমিনেট করা সাধারণ মানের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হবে। আইডিয়া প্রকল্পের আওতায় এই কাজও সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন ৫ কোটি ৩১ লাখ টাকা ও দ্বিতীয় সর্বনিম্ন ৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা দর প্রস্তাবকারী দুই প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে কাজটি দেওয়া হয় ৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা দর প্রস্তাবকারী তৃতীয় দরদাতা স্মার্ট টেকনোলজিস বিডি নামের এক প্রতিষ্ঠানকে। শর্ত ছিল, এই প্রতিষ্ঠান ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ৯৩ লাখ জাতীয় পরিচয়পত্র ইসিকে হস্তান্তর করবে। কিন্তু তারা তা করতে পারেনি।

প্রথম আলো সরেজমিনে খবর নিয়েছে জানতে পেরেছে, স্মার্ট টেকনোলজিস বিডি জাতীয় পরিচয়পত্র ছাপার কাজ শেষ করেছে গত ফেব্রুয়ারিতে, কিন্তু সেসব কার্ড ছাপা হয়েছে অতি নিম্নমানের কাগজে, লেমিনেটিংয়ের পরিবর্তে কার্ডগুলো মোড়ানো হয়েছে সস্তা পলিথিনে। অর্থাৎ কার্ডগুলো এতই নিম্নমানের হয়েছে যে ইসি সেগুলো গ্রহণ করতে আপত্তি জানাতে বাধ্য হয়েছে।

স্মার্ট কার্ড তৈরি ও সাধারণ মানের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি—উভয় কাজের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে ইসি কী দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিল? কিসের ভিত্তিতে ফ্রান্সের দেউলিয়া প্রতিষ্ঠানকে ৯ কোটি স্মার্ট কার্ড তৈরির কাজ দেওয়া হয়েছিল? কোন যুক্তিতে ৯৩ লাখ সাধারণ মানের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির কাজ দেওয়া হয়েছে স্মার্ট টেকনোলজিস বিডি নামের প্রতিষ্ঠানটিকে, যাদের নিজেদের ছাপার যন্ত্র পর্যন্ত নেই? প্রথম আলো সরেজমিন তদন্ত করে জেনেছে, এই প্রতিষ্ঠান কার্ডগুলো ছেপেছে আগারগাঁওয়ে পাসপোর্ট অফিসকে ঘিরে বিভিন্ন বস্তি ও গলির ঝুপড়িঘরে গড়ে ওঠা কম্পিউটার কম্পোজ ও লেমিনেটিংয়ের দোকানে। কিছু কার্ড ছাপা হয়েছে নির্বাচন কমিশন ভবনের সপ্তম ও অষ্টম তলায় আইডিয়া প্রকল্পের কর্মকর্তাদের কক্ষে। অভিযোগ উঠেছে, স্মার্ট টেকনোলজিস বিডি সাইনবোর্ডসর্বস্ব একটি প্রতিষ্ঠান। বাস্তবে ইসি এই প্রতিষ্ঠানের নামে তাদের আইডিয়া প্রকল্পের কিছু কর্মকর্তাকে কার্ড ছাপার কাজ দিয়েছে।

এসব অভিযোগ গুরুতর। ঋণ করে আনা বিপুল অঙ্কের টাকা কিছু লোকের হাতে নয়ছয় হবে, কিন্তু তার কোনো জবাবদিহি থাকবে না—এ অবস্থা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখে আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত জরুরি। আমরা দুদকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।