হাজার বছরের ইতিহাসে আমরা

কথায় বলে, যার নয়ে হয় না, তার নব্বইয়েও হয় না। আমাদের ইতিহাস যেন এই প্রবচনের উল্টোরথ। নয় মাসের গৌরবে যেন হাজার বছর খাবি যাচ্ছে। খণ্ডের আবর্তে অখণ্ডের শোভাযাত্রা ট্রাফিক জ্যামে আটকে পড়া গাড়ির বহরের মতো থমকে গেছে।

পাল ও সেনদের শাসনামল গুনলে বাঙালির ইতিহাস দাঁড়ায় প্রায় ১ হাজার ২৫০ বছর। শশাঙ্কের রাজ্যশাসন যোগ দিলে তা হবে প্রায় ১ হাজার ৪০০ বছর। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, বিজয় সিংয়ের সিংহল বিজয় গোনায় ধরলে বাঙালির ইতিহাস হতে পারে দীর্ঘতর। কিন্তু রাজনৈতিক বুলি, বচন ও বুদ্ধিজীবীদের বাচন বিবেচনায় মোটা দাগে বাঙালির ইতিহাস হাজার বছরের কথা বলা হয়।

মূলত চর্যাপদের সহজিয়া বুদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের পদচারণে মুখরিত অলিন্দ থেকে এই ইতিহাসের মহাযাত্রা শুরু; সেখান থেকেই হাজার বছরের হিসাব ধরা হয়। কিন্তু কোথায় সেই হাজার বছরের ব্যঞ্জনা? কতজন বাঙালি জানেন সেই হিসাবের কথা? কোথায় আলোচিত হয় সেই সুপ্রশস্ত ইতিহাসের কথা? বরং বিত্তভিক্ষু লুটেরাদের পদভারে সে ইতিহাস আজ প্রায় বিস্মৃত। মজুতদার, মুনাফাখোর ও কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্যে আমাদের ইতিহাস যেন ঘুরপাক খাচ্ছে এক অচলায়তনের ঘূর্ণিপাকে। যেন এই ঘূর্ণিপাকের আগেও কিছু ছিল না, পরেও কিছু থাকতে পারে না।

আমাদের জাতীয় জীবনে নয় মাসের গুরুত্ব অপরিসীম। অনস্বীকার্যও বটে। কিন্তু বাকি নয়শত নিরানব্বই বছর তিন মাসের ইতিহাস যেন খোয়া গেছে অথবা খোয়া যেতে বসেছে বিস্মরণের অতল গহ্বরে। বইয়ের পাতায় বন্দী ইতিহাসের এই বিশাল ব্যাপ্তির কোনো অনুরণন নেই সাধারণ বাংলাদেশিদের মনে। আমরা যেন ভুলে গেছি আমাদের পূর্বপুরুষদের সংগ্রামের কথা, তাঁদের সাফল্যের কথা। যেন স্মৃতিভ্রংশে ঝরে গেছে সেই সব দিনের গর্বগাথা—দেশপ্রেম, বীরত্ব ও আত্মত্যাগের কথা। উন্নত দেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ আমরা ভুলে গেছি নিজের দেশের হিরণ্ময় অতীতের কথা।

আমরা অনেকেই জানি না যে মোগল আমলে বাংলা সুবাহ সমস্ত সাম্রাজ্যের ৫০ শতাংশ জিডিপি সরবরাহ করত, যা ছিল বিশ্ব জিডিপির ১২ শতাংশ। বস্ত্রশিল্প, শিল্পোৎপাদন ও জাহাজ নির্মাণে এই সুবাহ ছিল বিশ্ববাজারে বহুলাংশে অগ্রসর। আমরা এ–ও জানতে চাই না যে আমাদের এই তল্লাটে যখন গণতন্ত্রের মাহেন্দ্র পদার্পণ ঘটে, তার অনেক পরে একই চেতনার আবির্ভাব ঘটে আজকের যত উন্নত দেশে। অষ্টম শতাব্দীতে গোপালকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে যখন দেশের মানুষ বাংলার সিংহাসনে বসান, তার প্রায় আট শতাব্দী পর ইংল্যান্ডের মানুষ উইলিয়াম ও মেরিকে তাঁদের দেশের সিংহাসনে বসান। রাশিয়ায় সপ্তদশ শতাব্দীতে মাইকেল রোমানভকে সে দেশের মানুষ রাজার মুকুট পরান। অষ্টাদশ শতাব্দীতে জাপানে মেইজি সম্রাটকে জনসমর্থনের ভিত্তিতে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফরাসি বিপ্লবের চরম ব্যর্থতার মুখে ফরাসি জনগণ নেপোলিয়ন বোনাপার্টকে সম্রাট হিসেবে বেছে নেন।

ইতিহাসে অগ্রগামী আমাদের এই অঞ্চলসহ সমগ্র ভারতবর্ষে যখন এক উচ্চতর সভ্যতা বিরাজ করছিল, ইংল্যান্ড তখন বিভিন্ন জার্মান গোত্রের আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যস্ত। ফ্রান্স তখনো কেরোলিঞ্জিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ এবং আলাদা রাজ্য হিসেবে আবির্ভূত হয়নি। রাশিয়া সে সময় স্লাভ উপনিবেশবাদের প্রারম্ভে এবং জাপান তখনো চীনের বলয় থেকে বেরিয়ে একটি আলাদা সত্তা হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। খোদ চীন সে সময় তাং (T’ang) রাজত্বের পৌনঃপুনিক গোলযোগের পরবর্তী দেড় শতাব্দীর জন্য তৈরি হচ্ছিল। আজকের পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তত দিনেও রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পায়নি।

আমাদের ইতিহাসে একাত্তরের নয় মাসের গুরুত্ব অনতিক্রম্য। হাজার বছরের ইতিহাসে এই নয় মাস নিজেই এক স্বর্ণযুগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এই সময়ের স্মৃতিকে হৃদয়ে ধারণ ও লালন করা প্রত্যেক বাংলাদেশি নাগরিকের ঐতিহাসিক ও নৈতিক দায়িত্ব-কর্তব্য। কিন্তু সেই স্মৃতির মণিকাঞ্চন যেন ঔজ্জ্বল্য না ছড়িয়ে বৃত্তবন্দী করে রেখেছে।

যেকোনো দেশের লড়াইয়ের ইতিহাস, নিঃসন্দেহে সে দেশের বড়াইয়েরও ইতিহাস। তারপরও কথা থাকে। শুধু লড়াই করে কোনো জাতি যেমন টিকতে পারে না, তেমনি শুধু বড়াই করেও নয়। একটি জাতি মানবশরীরের মতো, যার পরিশ্রমের পাশাপাশি পুষ্টিরও প্রয়োজন হয়। এই দুয়ের মধ্যে সাযুজ্য থাকা দরকার। সেই সাযুজ্যের বড় অভাব আজ। পুষ্টির ব্যাপারটা যেন চাপা পড়ে যাচ্ছে। অহংকার–হুংকারে পরিণত হয়েছে। উল্লাস–উত্তাল–উত্তেজনায় রূপান্তরিত হয়েছে। ইতিহাসের মহাসড়ক ছেড়ে বিভ্রান্তির কানাগলিতে জাতি হাতড়ে বেড়াচ্ছে। যে জাতি ইতিহাস থেকে চুরি করে, ইতিহাসও সে জাতির কাছ থেকে চুরি করে। দলমত-নির্বিশেষে সর্বজনগ্রাহ্য ইতিহাস রচনায় ব্যর্থ আমরা একে অপরের ওপর দোষ চাপাতে ব্যস্ত। এটা হতে পারে ইতিহাসের অভিশাপ। ইতিহাস আমাদের হাজার বছরে যেসব শিক্ষা দিয়েছে, সেসব শিক্ষা বিসর্জন দিয়ে আমরা বিভেদ-বিবাদে মত্ত রয়েছি। আমরা কী করে ভুলে গেলাম ঝগড়া-ফ্যাসাদে শান্তি থাকে না। ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়।

পঞ্চদশ শতাব্দীতে সুলতানি আমলের অন্ধযুগের অবসান হলে বাংলায় শান্তি ফিরে আসে এবং বাঙালির চৈতন্যে সৃজনশীলতার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে নানা ক্ষেত্রে। সে সময় গৌরাঙ্গের প্রেম ও ক্ষমার বাণী ছড়িয়ে পড়ে হতাশাগ্রস্ত মানুষের মনে। হানাহানি ও সংঘাতের বিভীষিকায় বিচলিত বাঙালি জাতি আধ্যাত্মিক মুক্তির সন্ধানে উন্মুখ হয়ে ওঠে। প্রায় তিন শতাব্দী পর ভিন্ন প্রেক্ষাপটে হলেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে বাংলায় রুপার প্রচলন শুরু হয়। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে মজুরি বৃদ্ধি এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে এক ভুঁইফোড় শ্রেণির উত্থান ঘটে। সরকারি কর্মচারীরা, বিশেষ করে রাজস্ব আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারীরা প্রভূত অর্থসম্পদের মালিক হন এবং তাঁদের বিলাসবহুল ও আয়েশি জীবনযাপনের জন্য বিদেশ থেকে ভোগ্যপণ্য আমদানি করা হতো, যা বর্তমানের সঙ্গে তুলনীয়। ভোগবাদের এই আধিক্য সাধারণ মানুষের মনে যে হতাশার সৃষ্টি করে, তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য লাখ লাখ মানুষ বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়। একই সঙ্গে ফারসি ভাষাকে রাজদরবারের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে সুফিবাদের প্রভাবও বিস্তার লাভ করে। হাজার বছরের ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় যে ভোগের পথে সমাধান আসে না। বরং তা বাঙালির ক্লেশিত অন্তর্জগৎকে পরিত্রাণ লাভের জন্য মরিয়া করে তোলে।

হাজার বছরের ইতিহাসের ঝুড়ি থেকে নেওয়া কেবল দু-একটি মাধুকরী ঘটনার কথা বলা হলো, যা আমাদের জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে দিকনির্দেশনার প্রতিশ্রুতি দেয়। নয় মাসের ইতিহাসের আলোর ঝলকানিতে আমাদের পথ দেখানোর আশা দেয়। বর্তমানের সংকটে পর্যুদস্ত ও ঐতিহ্যময় অতীত থেকে ছিটকে পড়া জাতির সংবিৎ ফেরানোর সম্ভাবনার হাতছানি দেয়। ইতিহাস আমাদের জাতীয় সত্তাকে একীভূত না করে বিভক্তির আস্ফালনে নিক্ষেপ করেছে, যা ক্রমশ পরস্পরের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি করে চলেছে। ইতিহাসের এক অনুপম অধ্যায় যেন এর মহিমাকে গ্রাস করে চলেছে। সমষ্টির ওপর ব্যক্তির আধিপত্য বিস্তার বেড়ে চলেছে। সমষ্টিকে বাদ দিয়ে ব্যক্তির অভিলাষ ও অভিমান প্রাধান্য পাচ্ছে। মনোবলের জায়গায় ঠাঁই পাচ্ছে লিপ্সা। ধৈর্যের জায়গায় ঠাঁই পাচ্ছে অসহিষ্ণুতা। উদ্যম থেকে কেউ আর উত্তরণের জন্য ধৈর্য ধরতে রাজি নন। সবাই চান উৎক্ষেপণ। সিঁড়ি না ভেঙে এক লাফে চূড়ায় উঠে যেতে চান সবাই। বিবর্তনের তর সয় না কারও। বিবর্ধনের ত্বরাই এখন সবার কাম্য।

 ইতিহাসের বিস্তীর্ণ অঙ্গনকে আলিঙ্গন করার সময় এসেছে আমাদের। ত্যাগ ও সাধনার অমোঘ অনুশীলনের মধ্য দিয়ে এবং বিবাদ, বিভেদ ও বৈষম্যের চৌকাঠ ডিঙিয়ে সংকীর্ণতার পথ পরিহার করার আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সামনে তাকানোর জন্য পেছন ফিরে দেখার তাগিদ দেওয়া দরকারি হয়ে পড়েছে।

হলিউডের চলচ্চিত্র নির্মাতা স্টিভেন স্পিলবার্গ ১৯৯৭ সালে অ্যামিসটাড নামক চলচ্চিত্র তৈরি করেন। ১৮৩৯ সালে ক্রীতদাস বহনকারী জাহাজ লা অ্যামিসটাডে সংঘটিত ক্রীতদাস বিদ্রোহের ওপর ভিত্তি করে এই ছবি তৈরি হয়। ক্রীতদাসদের পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চতম আদালতে ওকালতি করেন সে দেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট জন কুইন্সি এডামস। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন যে বিচারাধীন ক্রীতদাসেরা আফ্রিকার মেন্ডে গোত্রের সদস্য, যাঁরা বিশ্বাস করেন যে তাঁরা তাঁদের পূর্বপুরুষদের চাইলেই স্মরণ করতে পারেন; কেননা, পূর্বপুরুষেরা কখনোই তাঁদের ছেড়ে যান না। বিপদে-আপদে তাঁদের গোত্রের লোকদের সাহস, সহায়তা ও বুদ্ধি জোগান।

নয় মাসের ইতিহাসের অনেক প্রবাদপুরুষ আজও আমাদের মধ্যে বেঁচে আছেন। কিন্তু তাঁদের কেউ কেউ সুযোগসন্ধানী, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে ব্যস্ত। তাই পূর্বপুরুষদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করা দরকার। ইতিহাসের চলাচলে তাঁদের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। কান পাতলেই শুনতে পাব কোত্থেকে এসেছি, কোথায় আছি এবং কোথায় যাওয়া প্রয়োজন।

মোহাম্মদ বদরুল আহসান কলাম লেখক, অধুনালুপ্ত ইংরেজি সাপ্তাহিক ফার্স্ট নিউজ–এর সম্পাদক