উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে নয়ছয়

বাঙালির কথা ও কাজের অমিলের কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না।’ তাঁর এই শ্লেষাত্মক বাণীর যথাযথ প্রতিফলন ঘটল বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের আমলনামায়।

প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, গত অর্থবছরের জুন মাসে যেখানে সরকার ৪২ হাজার ৯১ কোটি টাকা খরচ করেছিল, এবারে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৮ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। এটা অবনতিরই বহিঃপ্রকাশ। প্রতিবারই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন করতে না পেরে বছরের শেষে এসে অর্থমন্ত্রী বাজেট কাটছাঁট করেন। অনেক প্রকল্পই ‘কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’ অবস্থা। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) খরচ হয়েছে ৯৮ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। আর শেষ এক মাসে কিনা খরচ করতে হবে গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সর্বশেষ হিসাবমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে সংশোধিত এডিপির ৬২ দশমিক ৮১ শতাংশ বা ৯৮ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। গতবার একই সময়ে এই হার ছিল ৬৪ দশমিক ৭২ শতাংশ।

মানুষ সামনে এগোয়। আর আমাদের প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তারা দক্ষতা ও যোগ্যতার বিচারে পিছিয়ে যাচ্ছি। বছর তিনেক আগে যখন সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করা হলো; তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বেশি বেতন পেলে তাঁরা কাজের প্রতি অধিক মনোযোগী হবেন এবং দুর্নীতি-অনিয়ম কম করবেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে দুটোই উল্টোরথে চলছে।

পীড়াদায়ক বিষয় হলো উন্নয়ন প্রকল্পের কর্তাব্যক্তিরা সারা বছর সময়ক্ষেপণ করে শেষ মুহূর্তে তাড়াহুড়া করে কাজ শেষ করেন। এতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ঠিকাদারেরা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেবাপ্রার্থী জনগণ। অনেক সময় প্রকল্প কর্মকর্তারা ইচ্ছে করেই এটি করেন, যাতে জবাবদিহি করতে না হয়। আবার দেখা গেছে, প্রকল্পের সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যয়ও বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের ১১ মাস পেরিয়ে গেলেও ১৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তাদের সংশোধিত বরাদ্দের অর্ধেক খরচ করতে না পারা কেবল দুর্ভাগ্যজনক নয়, অমার্জনীয়ও। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে খারাপ রেকর্ড সৃষ্টিকারীদের মধ্যে রয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, সেতু বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, জননিরাপত্তা বিভাগ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, অর্থ বিভাগ, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি), জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাহলে আর বাকি থাকল কারা?

জাতীয় সংসদে এই বাজেট যাঁরা অনুমোদন করেন, সেই জনপ্রতিনিধিরা বিষয়টি সম্পর্কে কতটা ওয়াকিবহাল সে বিষয়েও সংশয় আছে। অনেক মন্ত্রীও নিজের মন্ত্রণালয়ের সমস্যা নিয়ে কথা না বলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কাজে ব্যস্ত থাকেন। মন্ত্রীরা অবশ্যই রাজনৈতিক বক্তব্য দেবেন। কিন্তু নিজের মন্ত্রণালয়কে বাদ দিয়ে নয়। অর্থমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন, দুই বছরে প্রকল্প পরিচালকদের পুল করার চেষ্টা করে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। সে ক্ষেত্রে বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে যে অনিয়ম ও অরাজকতা চলছে, তার দায়িত্ব নীতিনির্ধারক ও আমলাতন্ত্র উভয়কেই নিতে হবে। জনপ্রশাসনে ভালো কাজের পুরস্কার ও মন্দ কাজের তিরস্কার বা শাস্তি না থাকলে সরকারের কোনো কর্মসূচি বা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন আশা করা যায় না।