নির্মাণশ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতা

বাংলাদেশে শ্রমিকদের অধিকার একটি অবহেলিত বিষয়। ‘যুক্তিসংগত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থান’ আমাদের সংবিধানের নির্দেশিত মৌলিক রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত; কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, যুক্তিসংগত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার নিশ্চিত করার কথাও সংবিধানে বলা হয়েছে। এগুলো শ্রমিকদের সংবিধানপ্রদত্ত ও আইন দ্বারা সুরক্ষিত অধিকার। কিন্তু আমাদের দেশে জাতীয় অর্থনীতির প্রায় সব খাতের শ্রমিকদের এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।

শ্রমিকদের মজুরি ও কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিয়ে যেসব কথাবার্তা ও দাবিদাওয়া বিভিন্ন সময়ে উচ্চারিত হয়, সেগুলো সীমাবদ্ধ থাকে প্রধানত তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের ক্ষেত্রে। কিন্তু এর বাইরেও বিভিন্ন খাতে যে শ্রমিকেরা আছেন, তাঁদের দিকেও দৃষ্টি দেওয়া জরুরি। এবং মজুরির পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়গুলোও আলোচিত হওয়া উচিত। অনেক খাতের শ্রমিকেরা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করেন; প্রতিবছর কর্মক্ষেত্রে প্রচুর শ্রমিক মারা যান কিংবা আহত হন। এ বিষয়ে গৃহনির্মাণ খাতের শ্রমিকদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, কেননা কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনায় তাঁদের মৃত্যু হলে তাঁরা সাধারণত সংবাদ শিরোনাম হন না। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) পরিসংখ্যান বলছে, ২০০২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে ১ হাজার ৩৭৭ জন নির্মাণশ্রমিক নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও কয়েক হাজার।

অথচ ইমারত নির্মাণ আইন-১৯৫২, জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৬, ঢাকা মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা-২০০৮ প্রভৃতি আইন ও বিধানে নির্মাণশ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্ব নির্ধারণ করা আছে। এ ছাড়া শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ভবন নির্মাণের সময় চারপাশে নিরাপত্তাবেষ্টনী দিতে হবে। উঁচু স্থানে কাজ করার সময় লিফট, সেফটি বেল্ট, শক্ত দড়ি-মাচা ব্যবহার; কাজের সময় মাথায় হেলমেট, পায়ে গামবুট ও মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। বিদ্যুতের তারের কাছে ভেজা রড ওঠানো-নামানো থেকে বিরত থাকা উচিত।

কিন্তু কার্যত এসব আইনবিধান-নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না। সাউথ এশিয়ান ইয়ুথ রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট (সেরিড) নামের এক বেসরকারি গবেষণা সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪৯ শতাংশ নির্মাণশ্রমিক কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করেন না। নিরাপত্তা-ঝুঁকি সম্পর্কে তাঁদের সচেতনতার অভাব আছে; অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ ছাড়াই তাঁদের নিয়োগ করা হয়। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় হতাহত শ্রমিকদের পরিবারগুলো সাধারণত ক্ষতিপূরণ পায় না।

যাঁদের শ্রমে নগর-মহানগর গড়ে উঠছে, সেই নির্মাণশ্রমিকদের এমন দুরবস্থা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এভাবে আর চলতে দেওয়া উচিত নয়। ব্যক্তি বা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, যারা নির্মাণশ্রমিকদের নিয়োগ করে, তাদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আন্তরিক উদ্যোগ নিতে হবে; সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিবিধানগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। এটা নিশ্চিত করতে তাঁদের ওপর সরকারি নজরদারি বাড়াতে হবে। আইন লঙ্ঘনকারীদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তবে এটা শুধু আইনি বিষয়ই নয়, নৈতিকতা ও মানবিকতার বিষয়ও বটে।