ভুট্টো বংশের নতুন 'রাজপুত্র' বিলাওয়াল

বিলাওয়াল ভুট্টো হলেন পাকিস্তানের অন্যতম শাসক বংশ ভুট্টো ডাইনেস্টির তৃতীয় প্রজন্ম। দেশটির সাম্প্রতিক নির্বাচনী প্রচারণায় পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) মূল ‘তলোয়ার’ তিনি।

দক্ষিণ এশিয়ার জ্যেষ্ঠ প্রজন্মের কাছে সবচেয়ে আলোচিত জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল যখন ফাঁসি দেওয়া হয়, তখন তাঁর পরিবারের সরাসরি সদস্য ছিলেন পাঁচজন। স্ত্রী নুসরাত ইস্পাহানি এবং চার সন্তান মর্তুজা, সনম, শাহনেওয়াজ ও বেনজির।

প্রথম স্ত্রী শিরিন আমির বেগমের (মৃত্যু: জানুয়ারি ২০০৯) কোনো সন্তান না থাকায় উপরিউক্ত পাঁচজনকেই জুলফিকার আলীর উত্তরাধিকারী বলা যায়। এর মধ্যে চারজনই রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন এবং স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল কেবল তাঁদের একজনের। দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক ডাইনেস্টিগুলোর আত্মবলিদানের এ যেন এক চিরায়ত ট্র্যাজেডি। সৌভাগ্য বলতে হবে, জুলফিকার আলীর ছোট সনম ভুট্টো কেবল রাজনীতির বাইরে ছিলেন এবং সে কারণেই হয়তো ৬১ বছর বয়সী এই নারী লন্ডনে অতি নিভৃতে বেঁচে থাকতে পারছেন। অন্যদের মধ্যে জুলফিকারের বড় ছেলে মর্তুজা করাচিতে নিজ বাড়ির কাছেই ছয় সহযোগীসহ নিহত হন ১৯৯৬ সালে। তার আগেই শাহনেওয়াজকে মৃত পাওয়া যায় ফ্রান্সে ১৯৮৫ সালে। বেনজিরকে হত্যা করা হয় ২০০৭ সালের রাওয়ালপিন্ডিতে। এই তিনজনের মা—জাতিতে ইরানি কুর্দি—নুসরাত ইম্পাহানি মারা যান ২০১১ সালের অক্টোবরে।

আজকের বিলাওয়াল হলেন বেনজিরের তিন সন্তানের জ্যেষ্ঠজন। যথারীতি দক্ষিণ এশিয়ার সামন্তীয় রাজনীতির প্রথা অনুযায়ী জুলফিকার আলী ভুট্টো কর্তৃক ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পিপিপির বর্তমান প্রেসিডেন্ট তিনি। তাঁর নানার পর যে দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন নানি নুসরাত ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত, এরপর মা বেনজির ২০০৭ সাল পর্যন্ত এবং কিছুদিন বাবা আসিফ আলী জারদারি। পিপিপিতে বোনের সঙ্গে পেরে না উঠে মর্তুজা ‘আল-জুলফিকার’ নামে এক সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন একদা। সেই ধারাবাহিকতা থেকেই মর্তুজার বিধবা স্ত্রী লেবানিজ বংশোদ্ভূত গিনওয়া ভুট্টো এবং মর্তুজার মেয়ে ফাতিমা গত জাতীয় নির্বাচনের আগে ‘পিপলস পার্টি’ (শহীদ ভুট্টো) নামে একটি দলের গোড়াপত্তন করেছিলেন। রাজনৈতিক আদর্শে অনেক র‍্যাডিক্যাল হলেও গিনওয়া-ফাতিমার এই উদ্যোগকে ভোটাররা পারিবারিক মনোমালিন্য হিসেবেই নিয়েছিলেন এবং ভোটে ভুট্টো বংশের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বিলাওয়ালকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে।

নির্বাচনে দ্বিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভুট্টো ডাইনেস্টি
৩০ বছর বয়সী বিলাওয়াল রাজনৈতিক কার্যক্রমে যুক্ত প্রায় ১১ বছর হলো। পিপিপির সভাপতি হন ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে। পাকিস্তানের এলিট পরিমণ্ডলে নামের শেষে বাবার বংশপদবি ধারণের রেওয়াজ থাকলেও বোধগম্য রাজনৈতিক প্রয়োজনেই ‘বিলাওয়াল জারদারি’ মায়ের বংশলতিকাও যুক্ত করেছেন নামের একাংশ হিসেবে। প্রায় ১০ বছর হলো তিনি ‘বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারি’ পরিচয় ব্যবহার করছেন।

জুলফিকার আলী ভুট্টো যখন পিপিপি প্রতিষ্ঠা করেন, তখন পশ্চিম পাকিস্তানে তাঁকে লড়তে হচ্ছিল শক্তিশালী সেনা আমলাতন্ত্রের প্রতিভূ জেনারেল আইয়ুব খানের বিপক্ষে। পরে আরেক জেনারেল জিয়া-উল-হক তাঁকে ফাঁসিতে হত্যা করেন। বাবার মতোই বেনজিরকেও জেনারেল জিয়ার প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়েছে এবং অপর জেনারেল-শাসক পারভেজ মোশাররফের সময়ে প্রকাশ্যেই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন তিনি।

বেনজিরপুত্র বিলাওয়াল উপরিউক্ত ধারাবাহিকতায় ভিন্ন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি বলা যায়। তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছে ইমরান খানের পিটিআই (পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ) এবং শরিফ ডাইনেস্টির মুসলিম লিগের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। এই দুই দলের প্রথমটিকে এ মুহূর্তে পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনা আমলাতন্ত্রের বিশেষ পছন্দের বলে মনে করা হয়। একদা যেরূপ পছন্দের ছিল শরিফদের দলও। সেই তুলনায় ভুট্টো পরিবারকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম দেশটির ‘ডিপ স্টেট’-এর সঙ্গে সংঘাতের মূল্য দিতে হয়েছে রক্ত ও জীবন দিয়ে। তবে ভুট্টোদের তৃতীয় প্রজন্মে এসে পিপিপি আগের মতো আর শক্তিশালী নেই। দলটি মূলত সিন্ধুকেন্দ্রিক এখন।

২০১৩ সালের পূর্ববর্তী জাতীয় নির্বাচনে ভুট্টোদের দলটি বিলাওয়ালের বাবা আফিস আলী জারদারির নেতৃত্বে লড়ে। ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে ৩৪২ আসনের মধ্যে তারা পায় ৪২ আসন। আসনের হিসাবে এটা দ্বিতীয় অবস্থান। তবে প্রদত্ত ভোটের হিস্যায় (১৫ শতাংশ) পিপিপি তৃতীয় স্থানে চয়ে যায়, যদিও যথারীতি সিন্ধুতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গড়তে সমর্থ হয়েছিল।

ভুট্টোদের পিপির আজকের বড় দুর্বলতা পাঞ্জাব ও বেলুচিস্তানে তারা নড়বড়ে। খাইবার অঞ্চলে পিপিপির ঐতিহাসিক মিত্র বামপন্থী ওয়ালি খানদের আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টিও পুরোনো ভিত্তি হারিয়েছে। ওই অঞ্চল এখন রয়েছে প্রায় পুরোপুরি ইমরানের সঙ্গে।

বরাবরই পাকিস্তানে নির্বাচনী ভরকেন্দ্র বলা হয় পাঞ্জাবকে। দেশটির রাজনীতিতে পাঞ্জাব একটি প্রদেশের চেয়েও বেশি কিছু। ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লির প্রায় অর্ধেক (৫১ শতাংশ) জনপ্রতিনিধি এই প্রদেশ থেকে নির্বাচিত হন। সিন্ধুর পাশাপাশি দক্ষিণ পাঞ্জাবে (যে অঞ্চলে রয়েছে প্রায় ৬০টি আসন) একদা ভুট্টোদের প্রতি সংহতি ছিল। কিন্তু স্থানীয় পিপিপি নেতারা অনেকেই যোগ দিয়েছেন ইমরানের পিটিআইয়ে। কেন্দ্রীয় পাঞ্জাব রয়ে গেছে শরিফ ডাইনেস্টির অধীনে। গত নির্বাচনে পিপিপি পাঞ্জাবে মাত্র তিনটি আসন পায়। ফল হয়েছে এই, ২০০৮ সালে যে পিপিপি জাতীয় পরিষদে ১১৮টি আসন পেয়েছিল, ২০১৩ সালে তাদের আসন নেমে আসে এক-তৃতীয়াংশে। তবে দলটির জন্য আশার কথা, সিন্ধুতে তাদের অন্যতম আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম) নানান উপদলে বিভক্ত এখন। ফলে সিন্ধুর অনেক আসনই এবার তারা পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

প্রচারণায় পিপিপির একটি বাড়তি সুবিধার দিক হলো নওয়াজ শরিফ ও ইমরান খানের চেয়ে বিলাওয়াল অনেক তরুণ। দেশটির প্রায় ১০ কোটি ভোটারের অর্ধেকেরই বয়স বিলাওয়ালের মতোই ত্রিশের কোঠায়। সুপরিচিত দৈনিক ডন ইঙ্গিত দিয়েছে, ৩৫ বছরের কম বয়সী (মোট ভোটারের ৪৪ শতাংশ) তরুণ ভোটাররাই ২৫ জুলাইয়ের নির্বাচনে নির্ধারক ভূমিকা রাখবেন। জাতীয় পরিসরে এই তরুণদের বড় অংশই ইমরানের অনুরাগী। তবে সিন্ধুতে সুদর্শন নতুন ‘ভুট্টো’ হিসেবে বিলাওয়ালের প্রতিও নজর থাকবে অনেকের। দাঁড়িয়েছেনও তিনি লারাকানা (বর্তমানে আসন নম্বর ২০০) ও লেয়ারি (আসন নম্বর ২৪৬) থেকে। জুলফিকার ও বেনজিরও বরাবরই লারাকানা থেকে নির্বাচন করতেন। লেয়ারি থেকেও একবার নির্বাচন করেছিলেন বেনজির। ইমরান খান ও শাহবাজ শরিফ যেমন দেশজুড়ে তিন-চার প্রদেশ থেকে দাঁড়াচ্ছেন, তেমন সিন্ধুর বাইরে ঝুঁকি নিতে চাইছেন না নতুন ভুট্টো।

যে কারণে বিলাওয়াল সম্ভাবনা দেখছেন
যদিও তাঁর আবেদন আপাতত শুধু অঞ্চলভিত্তিক, কিন্তু বিলাওয়াল কেন্দ্রে ক্ষমতার সমীকরণে পিছিয়ে নেই। রাজনীতি বরাবরই অসম্ভবের শিল্প। পাকিস্তানে এই মুহূর্তে মূল রাজনৈতিক যুদ্ধ চলছে ইমরানের পিটিআই ও শরিফদের মুসলিম লিগের মধ্যে। নির্বাচনে এই দুই দলই প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান পাবে। তবে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক এত তিক্ত ও বৈরী যে সরকার গঠনের মতো আসন না পেলে এই দুই দল পরস্পরকে ক্ষমতার বাইরে রাখতে তৃতীয় পক্ষ পিপিপির যেকোনো শর্তে রাজি হয়ে যাবে। রেষারেষিতে ভরা এরূপ ‘ঝুলন্ত পার্লামেন্ট’ দেশটির শক্তিধর ‘ডিপ স্টেট’-এর জন্যও স্বস্তিকর। বস্তুত, এখানে এসেই ভুট্টো রাজবংশের সামনে আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার হাতছানি দেখা যাচ্ছে; যে বংশ ইতিমধ্যে দেশটিতে চারবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছে।

রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে পাকিস্তানের নির্বাচনী যুদ্ধের উপরিউক্ত গতি-প্রকৃতি বিলাওয়ালের অজানা থাকার কথা নয়। সে কারণেই হয়তো নির্বাচনী প্রচারণায় মুসলিম লিগ ও পিটিআইয়ের চেয়ে পিছিয়ে থেকেও তাঁর মাঝে হীনম্মন্যতা দেখা যাচ্ছে না; বরং পরিবারের পূর্ব ‘গৌরব’কে ভালোভাবে পুঁজি করতে দলের প্রতীক হিসেবে ‘তির’ বদল করে ‘তলোয়ার’ নিয়েছেন তিনি এবার। এ নিয়ে অনেক আইনি লড়াই হয়েছে সেখানে।

বাংলাদেশেও নিশ্চয়ই অনেকের স্মরণ রয়েছে, রাজনীতিবিদ হিসেবে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নির্বাচনী উত্থান তলোয়ার প্রতীক দিয়েই। অবিভক্ত পাকিস্তানে সত্তরের নির্বাচনে পিপিপি তলোয়ার নিয়েই অবতীর্ণ হয়েছিল। ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়া তাদের সেই প্রতীক কেড়ে নিয়েছিলেন।

যদিও পিপি জোটের নির্বাচনী প্রতীক ২০১৩-এর মতো এবারও ‘তির’ই থাকছে, কিন্তু নানার আমলের দলীয় প্রতীকে দখল নিতে বিলাওয়ালের প্রচেষ্টা এই বার্তাই দিল যে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ডাইনেস্টিগুলোর নবীন প্রজন্ম এখনো পেছনের ‘ঐতিহ্যে’ই আটকে থাকতে চাইছে এবং বিস্ময়করভাবে ‘ক্ষমতা’ও তাদের কাছেই ফিরে ফিরে আসছে।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক