নোঙর আঁকড়ে থাকা এক মানুষ

যে দেশে চিন্তার দরকার নাই, চকমকে স্লোগান দিয়ে মানুষের টুঁটি চেপে রাখার দরকার, সেরকম এক দেশে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কলম থামাননি। যখন বিদ্বান, বুদ্ধিজীবী, লেখকেরা দলে দলে জনতাকে ছেড়ে ক্ষমতার রশি ধরে ঝুলে পড়ছেন, তখন তিনি মামলা খাচ্ছেন ভূমিরক্ষার আন্দোলনে জড়িত হওয়ার ‘অপরাধে’। ক্ষমতার ঝোল-মধুর সারিতেই বেশির ভাগ লেখক। তরুণেরা দুরারোগ্য আত্মপ্রেমে নিমজ্জিত। বিশেষজ্ঞদের বেশি পাওয়া যায় ক্ষমতার ঝালরের তলেই। তখন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতো আঙুলে গোনা কয়েকজন মানুষ ভেড়ার ছাল গায়ে জড়িয়ে নিরীহ হয়ে যাননি। সেই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তিরাশিতে পড়লেন আজ শনিবার।

সেবার খুব বন্যা হয়েছিল, সম্ভবত ১৯৯৮ সাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যাকাশে উড়ছি আর গোত্তা খেয়ে পড়ছি। সেরকম এক দিনে, বলা ভালো বিকাল বেলায়, ঢাকা থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফিরতে ফিরতে পড়ছিলাম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘আমার পিতার মুখ’। আরিচা সড়ক ডুবে গিয়েছিল বলে বাস চলছিল আশুলিয়া দিয়ে। বন্যার পানিতে সেই রাস্তাও ডুবুডুবু। সম্ভবত, ওখানেই বইটা পড়া শেষ হয়। আর রেখে যায় বুকচাপা বিষণ্নতা। বাইরের জলাশয়ের ঢেউ ছলছল পানি, আর নীলক্ষেত থেকে কেনা মলিন পুরোনো বইটা থেকে উপচানো কান্না একাকার হয়ে যেতে চাইছিল। অনেকটা ব্যক্তিগত আলেখ্যের ঢঙে লেখা বলেই হয়তো, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মনের সকল আর্দ্রতা তাঁর গদ্যভাষাকেও ভিজিয়ে রেখেছিল। এই লেখক তেমন একজন, যাঁকে শনাক্ত করতে হয় তাঁর ভাষা আর তার মধ্যে মিশিয়ে রাখা সংবেদনশীল মনের নিরিখ দিয়ে।

প্রথম তারুণ্যে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। মফস্বলে বসে সেই বেকনের মৌমাছিরা, বৃত্তের ভাঙাগড়া, নিরাশ্রয়ী গৃহ, কুমুর বন্ধন পড়ার রোমাঞ্চিত দিনগুলি মনে পড়ে। সেই জগতের মানুষ তিনি, যে জগতে স্বপ্ন ছিল, মুক্তির প্রতিশ্রুতি জনসমাজে প্রতিধ্বনি তুলত, মনে হচ্ছিল ইতিহাসের চাকা ঘুরছে। বর্তমানের থেকে আরও মানবিক আরও উচ্চতর সমাজের সম্ভাবনায় ভরসা ছিল। সমাজতন্ত্র তখনো কল্যাণের ইউটোপিয়া হিসেবে হলেও দারুণ সক্রিয় ও সবল ছিল। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর যাবতীয় কাজকর্ম সেই স্বপ্নের মাধ্যাকর্ষণে আজও বাঁধা।

আজকের পৃথিবী চলছে ‘উইদাউট এনি অলটারনেটিভ’। মানে পৃথিবীও অত্যাচার-দূষণে ধ্বংস হতে পারে, চরম অন্যায়ের শিকার হতে পারে কোটি কোটি মানুষ, দেশ হারিয়ে উদ্বাস্তু হতে পারে অসংখ্য মানুষ, তবুও পুঁজিবাদের কোনো বিকল্প নেই—এমন মৌলবাদ চলছে। এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে নৈতিক দুঃসাহস ও চিন্তার দূরদর্শিতা লাগে। সামাজিক সম্পর্ক ও পাবলিক পরিসর যখন দখল হয়ে যাচ্ছে, তখন সৎ বুদ্ধিজীবী তো ‘বাহিরের লোক’। এডওয়ার্ড সাঈদ নিজেকে সবসময় ‘নির্বাসিত’ মনে করতেন। তাঁর কাছে বুদ্ধিজীবী তিনি, যিনি মানুষের মুক্তি ও জ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যান। আর এ জন্য তাঁকে প্রায়শই সমাজ ও তার প্রতিষ্ঠানের বাইরে দাঁড়িয়ে সক্রিয়ভাবে কায়েমি ব্যবস্থাকে জ্বালাতন করতে হয়। সাঈদের বুদ্ধিজীবী একই সঙ্গে সমাজের অংশ আবার সমাজের রসাতলের বাইরে দাঁড়ানো লোক। এমন লেখকের কাজ হলো যত বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করা।

দীর্ঘসময় ‘সংবাদ’ পত্রিকায় ‘গাছপাথর’ কলামের মাধ্যমে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কেবল ক্ষমতাকেই প্রশ্ন করে যাননি, গড়পড়তা পাঠকের চিন্তাশীলতার শুশ্রুষাও করে গেছেন। শিক্ষক হিসেবে, গবেষক হিসেবে, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, সম্পাদক, অনুবাদক এবং সমাজ-সংগঠক হিসেবে এই কাজই করে গেছেন গত চার দশক ধরে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ যে কয়েক’জন মৌলিক চিন্তক পেয়েছে—তিনি তাঁদের সামনের সারির একজন। কিন্তু দরবারি ডাঁট আর ক্ষমতার ঠাঁটবাটের সঙ্গে তিনি কদাচ যান না। ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেও তিনি যে বাংলাকেই লিখবার-বলবার মাধ্যম করলেন, সেটা অবশ্যই তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ। তাঁর গদ্যের স্থিতিস্থাপক পেশি আর কোমল সংবেদন দিয়ে তিনি বুদ্ধিবৃত্তির মানবিকায়ন ঘটান। এর আস্বাদন সাহিত্য পাঠের অভিজ্ঞতার সমান। তাঁর এই শিল্পী মনের গহনপুরের খোঁজ মেলে তাঁর কথাসাহিত্যে। হয়তো প্রাবন্ধিকের ছদ্মবেশে তিনি একজন শিল্পীই, অথবা শিল্পীর সমান্তরালে একজন সমাজ-গবেষক।

তিনিও মধ্যবিত্ত শ্রেণির একজন। তাঁর আজীবনের কাজও প্রমাণ করে, চিন্তায় ও কাজে তিনি এই শ্রেণিটিকে ফেলেও দেননি আবার মাথায়ও তোলেননি। এই বাঙালি মধ্যবিত্তের জগৎকে তিনি যেভাবে ছিঁড়ে-কুটে দেখেছেন, দেখেছেন তার সীমা ও সংকট; তাতে তিনি নিজেই পরিণত হন এই শ্রেণির অন্তর্যামী সমালোচকে। ‘উনিশ শতকে বাংলা গদ্যের সামাজিক ব্যাকরণ’ বা ‘শরৎচন্দ্র ও সামন্তবাদ’ নামক অভিসন্দর্ভে তিনি এই শ্রেণিটির মানস-ব্যাকরণের সাংস্কৃতিক সুলুক-সন্ধান করেন। যে মহিমা ও আত্মতুষ্টির বলয়ে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক মহাশয় নিজেকে বহুগুণে বিম্বিত করে দেখে আরাম পায়, সেই বলয় ছিন্ন করা ছাড়া মধ্যবিত্তের ঔপনিবেশিক নাড়িবন্ধন কাটা যেত না। কলকাতার বিনয় ঘোষ ও ঢাকার বদরুদ্দীন উমরের ধারাবাহিকতায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আহমদ ছফা, আনু মুহাম্মদেরা সেই কাজ একটানা করে গিয়েছেন এবং যাচ্ছেন। তাঁর সর্বশেষ বাঙালির জাতীয়তাবাদ গ্রন্থটি তারই আরেক দলিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের সীমা ও সংকটের এমন ঐতিহাসিক আলোচনায় সাহস যেমন লাগে, তেমনি দরকার পড়ে নিজ দেশ ও জাতির প্রতি গভীর নিষ্ঠার।

খেয়াল করলে দেখা যায় তাঁর সকল রচনাই এক লক্ষ্যের দিকে ধাবিত। তা হলো চেতনার বিউপনিবেশীকরণ। দীর্ঘ পরাধীনতা ও উপনিবেশিকতার এই সাংস্কৃতিক নির্মাণকে আলজেরিয় মুক্তিবাদী ফ্রাঞ্জ ফ্যানোর ভাষায় ‘আন-লার্ন’ বা বিশিক্ষা করা ছাড়া যে চিত্তের স্বাধীনতা আসবে না, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সেই জরুরতই জানিয়ে গেছেন। তুলনায় নয়, গুণে তিনি বাংলা ভাষিক জগতে সেই কর্ম সাধন করেছেন, এডওয়ার্ড সাঈদ যা করেছেন প্রাচ্যতত্ত্বের পর্যালোচনায়।

বিদ্বানের নিঃসঙ্গ নির্জনতা ও বুদ্ধিজীবীর সরব বলা-লেখার ঐতিহ্য তাঁর মধ্যে জীবন্ত। হারানো মানবিকতার সন্ধান আর মানবের আত্মার নবায়নের এই দায়িত্ব ছাড়া লেখালেখি তো ফরমায়েশি কাজ। কিন্তু যে জগৎ দ্রুতই বদলে যাচ্ছে, মানুষ যখন আরও বেশি উন্মূল ও ছিন্ন মস্তিষ্ক, যখন ব্যক্তিস্বার্থ সমষ্ঠি স্বার্থকে ঝেঁটিয়ে সরাচ্ছে, সেরকম এক সময়ে ইতিহাসের গতিসন্ধান, ভাষার মধ্যে মানবিকতার প্রতিষ্ঠা, জনগণের সংগ্রামের মধ্যে ইতিহাসের আশাবাদ খুঁজে দেখার সাধনা করা দুরূহ বৈকি। হয়তো এ রকম বদলের সময়ে অবিকল থাকবার জেদই হতে পারে বাস্তবতায় গাঁথা নোঙর। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সেই আপসহীনতার নোঙর আঁকড়ে আছেন, সেটা এই তরল সময়ে এক কঠিন উদাহরণ বটে।

জরুরি প্রতিবাদে তিনি পিছপা হননি। ওসমানি উদ্যান রক্ষার আন্দোলন থেকে শুরু করে আড়িয়ল বিল রক্ষা আন্দোলনে বাংলাদেশের সংগ্রামী বুদ্ধিজীবীতার ধারাকে তিনি জীবন্ত রেখেছেন। বদলে যাওয়া এই সময়ে সমাজতন্ত্র, বামপন্থা, প্রগতিশীলতার সংগ্রামী আত্মত্যাগ ও অবদান যেমন সত্য, তেমনি এসবের মধ্যে যে আত্মতুষ্টি, সুবিধাবাদ এবং জনবিচ্ছিন্নতার গাদ জমেছে তার কঠোর সমালোচনা করাও জরুরি। উনিশ ও বিশ শতকের প্রথম দিকের অনেক ধারণা ও মতবাদে আর আগের কায়দায় আস্থা রাখা যাচ্ছে না। সমাজতন্ত্র ও সেক্যুলারিজম অন্তর্গত সংকটের দিকে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দৃষ্টি ফেরাবেন; এই আশা তাই রাখছি।

সময়ের সীমান্তে দাঁড়িয়ে, বৃত্তের পর বৃত্তের ভাঙা-গড়ার সাক্ষী হয়ে এখনো তিনি লিখে চলেছেন। তিনি এবং তার মতো আরো ক’জন মিলে বাঁচিয়ে রেখেছেন জনতার হয়ে ক্ষমতার দরবারে সওয়াল-জবাবের ঐতিহ্য। সতের বছর ধরে সম্পাদনা করে যাচ্ছেন নতুন দিগন্ত নামের ত্রৈমাসিক পত্রিকা। কলাম ও টকশোগুলো যখন পাবলিক পরিসরকে ছিনতাই করে নিয়ে যাচ্ছে, তখনো সিরাজ স্যার পাবলিক বুদ্ধিজীবিতা আর বিদ্বানের মনীষা নিয়ে সজাগ আছেন; এটাই প্রেরণা। মার্কিন কবি এমারসন মনে করতেন, বুদ্ধিজীবী সর্বোপরি একজন পূর্ণ মানুষ। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জীবনে সেই পূর্ণতার বিনয়ী প্রকাশ দেখতে পাই।

অনেকেই যখন ডানপিটে ডানপন্থী, তখন একজন পিতৃপ্রতিম, বামের পথে অমোচনীয় মানবিকতার চলাচল জারি রেখেছেন; জন্মদিবসে তাঁকে অভিবাদন।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]