একটু জাপানি হতে চাওয়া

ভারতের কোনো কাগজে খবরটা দেখিনি। বাংলাদেশের অনেকগুলো ই-পেপারও প্রতিদিন দেখি। নাহ্, কোথাও খবরটা পড়েছি বলে মনে পড়ছে না। খবরটা রিপোর্ট করেছেন বিবিসির সাংবাদিক আঁদ্রেয়া ইলমার। রাশিয়া থেকে। পড়ার পর বেশ খানিকটা সময় কেমন যেন হয়ে গেলাম। তারপর আবার পড়লাম। পড়তে পড়তে ভাবলাম, একটা জাতি এমনি এমনি বড় হয় না। বড় হতে গেলে চরিত্র প্রয়োজন। প্রয়োজন চারিত্রিক দৃঢ়তার।
খবরটা সংক্ষেপে এই রকম—বিশ্বকাপের গ্রুপ লিগের খেলায় জাপান ২-১ গোলে হারিয়ে দিল কলম্বিয়াকে। এশিয়ার কোনো দেশ লাতিন আমেরিকার কোনো দেশকে বিশ্বকাপের আসরে হারিয়ে দিচ্ছে, এমন ঘটনা আগে কোনো দিন ঘটেনি। জাপান সেই বিরল সম্মানের প্রথম অধিকারী।
কিন্তু এটা কোনো খবরই নয়। তিন দিনের বাসি। ফেবারিট কলম্বিয়াকে জাপান যে হারিয়ে দিয়েছে, তা ওই খেলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গোটা বিশ্ব জেনে গেছে। বিবিসির ওই খবরটার শুরু খেলা শেষের পর থেকে। স্টেডিয়ামে বসে-দাঁড়িয়ে যেখানে জাপানি সমর্থকেরা ভিড় করে সারাক্ষণ নিজের দেশকে সমর্থন করে গেলেন, খেলা শেষের পর আর সবার মতো তাঁরা স্টেডিয়াম ছেড়ে চলে গেলেন না।
আনন্দ-উত্তেজনা থিতিয়ে গেলে তাঁরা সঙ্গে নিয়ে যাওয়া পেল্লাই পেল্লাই ‘রাবিশ ব্যাগে’ ভরতে লাগলেন স্টেডিয়ামে ফেলে দেওয়া বিয়ারের গ্লাস, খাবারের প্যাকেট, কাগজের টুকরা ও আরও অনেক কিছু, যা তাঁরা সেখানে ফেলেছিলেন। ঢোকার সময় স্টেডিয়াম যেমন ঝকঝকে-তকতকে ছিল, চলে যাওয়ার আগে তেমনটাই তাঁরা করে দিলেন।
ওই কাজ করতে কেউ তাঁদের বলেনি। বাধ্যও করেনি। করেছেন নিজেদের তাগিদে। খবরটায় জাপানে বসবাস করা এক ফুটবল সাংবাদিকের উদ্ধৃতি দিয়েছে বিবিসি। তিনি বলেছেন, এটা শুধু জাপানি ফুটবল নয়, এটা সার্বিক জাপানি সংস্কৃতির অঙ্গ।
জাপানে বসবাসরত ওই সাংবাদিক আরও বলেন, এমন বলা হয় যে ফুটবলের মধ্য দিয়ে নাকি একটা দেশের
সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটে। কিন্তু জাপানি সমাজের উল্লেখযোগ্য দিক এটাই যে তারা যা কিছু করে, সুন্দরভাবে করে। পরিচ্ছন্নভাবে করে। ফেলে-টেলে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে করে না। আর সেই সংস্কৃতি শুধু ফুটবল নয়, সব ধরনের খেলাতেই ছড়িয়ে গেছে।
পড়তে পড়তে ভেবে দেখলাম, আমাদের চেয়ে ওরা কত আলাদা। ওই চরিত্র তাদের কীভাবে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে। চরিত্র আছে বলেই ওইটুকু একটা দেশ আজ পৃথিবীর অন্যতম সেরা অর্থনৈতিক শক্তি। আমাদের কোনো চরিত্র আছে কি? থাকলে কেন আমরা এখনো অথই অতলে?
জাপানের রাজা-রানি অথবা প্রধানমন্ত্রী কাউকে ঘটা করে কোনো দিন পরিচ্ছন্ন থাকা ও রাখার অভিযানে নামতে হয়েছিল কি না, জানি না। অভ্যাসটি তাঁরা মজ্জাগত করে ফেলেছেন। আমাদের দেশে বহু বহু বছর আগে পরিচ্ছন্নতার প্রয়োজনীয়তার কথা শুনিয়েছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, ব্রিটিশরা যাঁকে ‘নাঙ্গা ফকির’ বলত। তাঁর মৃত্যুর বহু বহু বছর পর ঘটা করে সেই পরিচ্ছন্নতার অভিযান চালাতে দেখলাম প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে।
ক্রমে সেটা হয়ে দাঁড়াল ছবি তোলার উপলক্ষ। ‘ফটো অপ’। ইদানীং ঝাড়ু হাতে নেতাদের রাস্তা ঝাঁট দেওয়ার ছবি দেখা যায় না। কারণ, তাতে আর অভিনবত্ব নেই। বরং স্বচ্ছতার সরকারি অভিযানে খরচ হচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। জল আছে কি নেই, বিচার না করেই তৈরি হচ্ছে পাকা পায়খানা ও কলঘর। শহর ও গ্রামে। কাজের কাজ কতটা হচ্ছে না হচ্ছে, কী এসে যায় তাতে। নেতার নামে জয়ধ্বনি তো হচ্ছে। কাড়া-নাকাড়ায় নেতা-বন্দনায় দিগ্‌বিদিক আচ্ছন্ন তো হচ্ছে। ওটাই তো সব! এটাই তো ভোটে জেতার ছল!
এই চালাকিই আমাদের চরিত্র। আমরা না হতে পেরেছি একটা জাতি, না গড়ে উঠেছে আমাদের চরিত্র।
সেদিন বিরাট কোহলির নববিবাহিত স্ত্রী অভিনেত্রী আনুশকা শর্মা গাড়ি থামিয়ে এক যাত্রীকে মৃদু ধমক দিলেন রাস্তা নোংরা করার জন্য। কতবার দেখেছি রাজধানীর নামীদামি স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এসি বাসের জানালা খুলে চিপসের খালি প্যাকেট রাস্তায় ফেলছে।
অমিতাভ বচ্চন একবার এমনই একজনের গাড়ি
দাঁড় করিয়ে ফেলে দেওয়া ঠোঙা হাতে ধরিয়ে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। সেই গাড়ির যাত্রীরা বিগলিত হয়ে বচ্চনকে সেলফি তোলার অনুরোধ জানিয়েছিলেন।
তাঁরা কিন্তু কেউই অশিক্ষিত, গ্রাম্য নন। সবাই এলিট শ্রেণির মানুষ। সমাজের ‘ক্রিমি লেয়ার’। তাঁদের অধিকাংশের কাছে পরিচ্ছন্নতার সংজ্ঞা আজও নিজ গৃহের চৌহদ্দির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তার বাইরে কোনো দায়বদ্ধতা নেই!
আজ বহুদিন ধরেই বাংলাদেশ আমার দ্বিতীয় গৃহ। একই ভাষা, একই খাদ্যাভ্যাস, একই পরিধান, একই জল-হাওয়া আমাদের। অভ্যাসও যে একই হবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! প্রতিবার ঢাকায় যাই, দেখি পথচলতি মানুষজনের মধ্যে রাস্তায় থুতু ফেলার এক অঘোষিত প্রতিযোগিতা যেন অনন্তকাল ধরে চলছে! এয়ারপোর্টে এক উর্দিধারী একদিন এক মুখ কফ ফেলে জুতো দিয়ে ঘষে দিলেন! আমি দেখে ফেলেছি বুঝে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হাঁটা দিলেন। উনি বুঝলেন না, এয়ারপোর্ট দেশে ঢোকার সদর। দেশ সম্পর্কে প্রথম ধারণার সৃষ্টি হয় ওখানেই!
জাপানের জয় দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, ষাট বছর আগে এই ভারত এশিয়ার সেরা ছিল। বাষট্টির মারদেকা ফুটবলে চ্যাম্পিয়নও হয়েছিলাম আমরা। আজ এশিয়ায়
প্রথম দশটা দেশের মধ্যে ভারত নেই! ভাবছিলাম, এই
জাপান শেষ ষোলোয় যেতে না পারলে দুঃখ হয়তো হবে,
কিন্তু পরিচ্ছন্ন সংস্কৃতির নজির সৃষ্টিতে তো প্রথম! তা কি
কম গর্বের?
ফুটবলের বিশ্বকাপ আমাদের কাছে এখনো বহু আলোকবর্ষ দূরে। কিন্তু অন্য রকম নজিরও কি আমরা গড়তে পারি না? জাপানিদের মতো?

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি