বাংলাদেশের বিষধর সাপ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি

বাংলাদেশে আবহাওয়ার যে প্রকৃতি, তাতে এ দেশে সরীসৃপজাতীয় শীতল রক্তের প্রাণীদের জীবনযাপনের জন্য একেবারে উপযুক্ত বলা যেতে পারে। বছরে মাত্র চার মাস হালকা শীতকাল, বাকি আট মাস গরমকাল—তারও অধিকাংশ সময় বৃষ্টিপাত হয়। ফলে এ দেশে নানা জাতের গাছপালা জন্মায়, রয়েছে হাজারো প্রজাতির কীটপতঙ্গ। এমন পরিবেশ সাপের বসবাস ও বিকাশের জন্য আদর্শ। বাংলাদেশ ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটারের ছোট দেশ হলেও এখানে বিকশিত হয়েছে ৯৪ প্রজাতির সাপ। এদের মধ্যে ২৬টি প্রজাতি মারণ বিষের অধিকারী। বাকিগুলোর মধ্যে অন্তত ৬টি প্রজাতির সাপ খুব ভালোভাবে কামড়ালে মানুষ মারা পড়বে।

বাংলাদেশে এতগুলো বিষধর সাপ রয়েছে, শুনে অনেকেই নিশ্চয়ই চমকে উঠবেন। একটু খবর নিলেই দেখতে পাবেন, বিষয়টি এত ভয়ংকর নয়। ২৬ প্রজাতির মারণ বিষের সাপের মধ্যে ১২ প্রজাতিই হচ্ছে সামুদ্রিক সাপ। এদের সঙ্গে আপনার সংঘাত হওয়ার আশঙ্কা খুব কম। এগুলোর মধ্যে অনেক জেলেদের জালে ধরা পড়ে। জেলেরা অবহেলায় এদের লেজে ধরে তুলে জাল থেকে জলে ছুড়ে মারেন। তাঁরা জানেন না, হাইড্রোকিডি গোত্রের এই সাপগুলোর বিষের তীব্রতা গোখরার বিষের তীব্রতার চেয়ে বেশি।

বাকি ১৪টি বিষধর সাপের মধ্যে ম্যাকলেলোন্ডের প্রবাল সাপ ও ক্যালিওফিশ মেলানারাস প্রবাল সাপ খুবই দুর্লভ। এরা চট্টগ্রাম ও সিলেটের মিশ্র বৃষ্টিপাতের জঙ্গলে পচা পাতার মধ্যে লুকিয়ে থাকে। কিন্তু লোকালয়ের বাইরে থাকে বলে কেউ খুব কমই এদের কামড় খায়। আরেকটি মারাত্মক বিষধর সাপ হচ্ছে শঙ্খচূড়। এটা জঙ্গলের সাপ। সহসা লোকালয়ে আসে না। তাই এই সাপের কামড়ের দুর্ভাগ্য খুব কম মানুষের হয়। কিন্তু কালাজ, শঙ্খিনী, কালো কালাজ, ছোট কালো কালাজ, ওয়ালের কালাজ, খইয়া গোখরা ও কেউটে সম্পর্কে সাবধান হতেই হয়। কেননা এগুলো শুধু মানুষের বসতির কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে না, এগুলো আপনার ঘরেই ঘর বাঁধতে পারে, রাতে বিছানায় হামলা করতে পারে। বোড়া গোত্রের আরও তিনটি সাপকে সমঝে চলা দরকার। এরা হলো চন্দ্রবোড়া, সাদা ঠোঁট সবুজবোড়া ও লাল লেজ সবুজবোড়া।

বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমের এই সময়ে মানুষের সঙ্গে সাপের সংঘাত চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। বাংলাদেশের পশ্চিম–দক্ষিণের জেলাগুলো ও ভারতের নদীয়া, ২৪ পরগনা পৃথিবীর সবচেয়ে সাপে কাটাপ্রবণ এলাকা। বাংলাদেশে প্রতিবছর ৬০ হাজার মানুষ সাপের ছোবল খায়, (অধিকাংশই নির্বিষ সাপের। অথবা বিষধরের শুকনো কামড়)। সাপের কামড়ে মারা যায় ৬ হাজার মানুষ।

দেশে যত সাপ আছে, তার সামান্যই আমরা দেখতে পাই। সাপ গর্তনিবাসী, চিবানোর দাঁত না থাকার কারণে আস্ত শিকার গিলে খায়। পেটে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড থাকায় খাবার গলে যায়, সাপের বিষ খাদ্যের টিস্যু ভাঙার কাজ করে। প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ ও সাপের মেটাবলিজমের মাত্রা ধীর হওয়ায় সাপের খাবার লাগে খুব কম। ফলে শিকার ধরা, মিলনাকাঙ্ক্ষায় বাইরে আসতে হয় খুব কম। সাপের দেহ নাজুক, হাত–পা নেই, খাবারের জন্য লড়াই কম করতে হয়। তাই সাপের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ তেমন হয়নি। তার ওপর কানে শুনতে পায় না, দূরের দৃষ্টিও খারাপ। ফলে সাপের সবই প্রবৃত্তিনির্ভর। প্রবৃত্তির বশে তারা বুঝতে পারে বাইরে খোলা এলাকা তাদের জন্য নিরাপদ না।

আগেকার দিনে গ্রামীণ ঝোপঝাড় বিস্তর থাকায় সাপ তার বংশবৃদ্ধি সেখানে করতে পারত। এখন আমাদের চাষের জমির চাহিদা এত বেড়েছে যে সাপ বাধ্য হয়ে ঘরের ভেতর, রান্নাঘরে ও গোয়ালঘরে গর্ত পেলেই সেখানে বসবাসের চেষ্টা করে। গোটা তিন–চারেক প্রজাতির নির্বিষ সাপ ছাড়া আর কোনো সাপই মানুষের ঘরবাড়ি পছন্দ করে না। কিন্তু গোখরা, কেউটে ও কালাজ লোকালয় ও মানুষের বসতবাড়ি পছন্দ করে। মানব বসতিতে থাকে ইঁদুর। আর
ইঁদুরের টানে এসব মারাত্মক বিষধর প্রাণী লোকালয়ে বসতি গাড়ে।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা পড়ে কালকেউটের কামড়ে। বাংলাদেশের সর্বত্র এই সাপ পাওয়া যায়। দক্ষিণবঙ্গে কেউটে, বরিশালে কালিঞ্জিরি, চট্টগ্রাম হানাস, উত্তরে জাতিসাপ নামের এই সাপ লম্বায় তিন থেকে পাঁচ ফুট পর্যন্ত হয়। এরা জলে অথবা জলের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। এদের বিষে নিউবোটক্সিন থাকায় কামড়ালে ও বিষ প্রয়োগ করলে মানুষ বাঁচানো প্রায় অসম্ভব।

পদ্ম গোখরা, খয়ে গোখরা, খরিশ ইলপিডি গোত্রের একটি অতিপরিচিত সাপের নাম। কেউটের মতো সাপুড়েদের কাছে এদের বিস্তর দেখা যায়। এরা প্রধানত শুকনো এলাকা পছন্দ করে। বাড়ির কাছে ইটের পাঁজা, পুরোনো বাড়ির ধ্বংসাবশেষ, গাছের কোটর ও ইঁদুরের গর্ত পেলে এরা সহজে সেখানে বসতি গড়ে। এরা ভোরবেলা ও সন্ধ্যারাতে বেশি তৎপর থাকে। দিনের বেলা বাইরেই আসে না।

কেউটের মতো এরাও অন্যান্য সাপ খেতে পছন্দ করে। নিউবোটক্সিন বিষের অধিকারী গোখরা লম্বায় চার–পাঁচ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। গোখরা, কেউটেদের চেয়ে কড়া বিষের অধিকারী কালাজ সাপের তিনটি উপপ্রজাতি অনেক মানুষের জীবন ধ্বংসের কারণ। সাপুড়েরা এদের একটি উপপ্রজাতিই শুধু কাছে রাখেন। সেটি হচ্ছে শঙ্খিনী। এটা আড়াই থেকে তিন ফুট লম্বাও হয়। দেশে মারা পড়া ২০ শতাংশ মানুষ এদের কামড়ে মারা যায়।

সাপের বিষ হচ্ছে ঘনীভূত রূপান্তরিত লালা। সাপের চোখ আর ওপরের মাড়ির মাঝ বরাবর একটি গ্রন্থিতে বিষ থাকে। সাপের বিষ প্রধানত সাপের শিকারকে চলাচলের শক্তিহীন করতে আর হজমের কাজে ব্যবহারের জন্য। সাপের বিষ হালকা হলুদ বর্ণের চটচটে পদার্থ। এতে প্রায় কুড়ি ধরনের উপাদান আছে। মূল উপাদান প্রোটিন, পলিপেপটিটেড, এনজাইম, টক্সিন ও অন্যান্য উপাদান। সাপ জানে, তার বিষ খুব মহার্ঘ্য। তাই সে বুঝেসুঝে সেটা খরচ করে।

সাপের কাছাকাছি মানুষের হাত–পা চলে এলে সাপ অনেক সময় ভয় পেয়ে ছোবল মারে। উত্ত্যক্ত না করলে বা খুব ভয় না পেলে সাপ প্রতি ছোবলে বিষ প্রয়োগ করে না। এই ধরনের বিষহীন কামড়কে ইংরেজিতে ড্রাই বাইট বলা হয়।

কেউটে, গোখরা ও কালাজ গোত্রের বিষের ধরন নিউরোফিজিক্যাল। এদের কামড়ের প্রতিক্রিয়া ৭ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে দেখা যায়। উপসর্গ হচ্ছে খিঁচুনি, বমি, তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা, চেতনা হারানো, চোখের দৃষ্টি বিভ্রান্ত, পেশি-চোয়াল–ঘাড় অবশ, চোখের পেশি কাজ না করা, গিলতে না পারা, লালা ঝরা, নাকি স্বরে কথা বলা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। চন্দ্রবোড়া, সবুজবোড়াদের বিষের ধরন হিমোটোজিক্যাল। উপসর্গ শুরু হয় পাঁচ মিনিটের মধ্যে। ক্ষতস্থান থেকে অনবরত রক্তপাত, মাড়ি থেকে রক্তপাত, রক্তবমি, কাশতে কাশতে বমি, শরীরের বিভিন্ন অংশে ফুসকুড়ি ওঠা ইত্যাদি।

সাপে কামড়ালে আর বিষ ঢাললে কোনো ওঝা–বদ্যিই রোগীকে সুস্থ করে তুলতে পারে না। রোগীদের মধ্যে একটা বড় অংশ মারা যায় হার্ট অ্যাটাকে। সাপে কাটা রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব সেই হেলথ সেন্টারে নিয়ে যেতে হবে, যেখানে অ্যান্টিভেনম আছে। অ্যান্টিভেনম দেওয়ার উপযুক্ত চিকিৎসকও সেখানে থাকতে হবে। রোগী বেশি নাড়াচাড়া করলে বিষ দেহে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যেসব অ্যান্টিভেনম আমদানি করে, তার মেয়াদকাল থাকে ৪ বছর। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো বিতরণ করা হয় ৩ বছর পর। অধিকাংশ চিকিৎসকই সাপের বিষের চিকিৎসা জানেন না। সাপ চেনেন না। উপসর্গ বোঝেন না। তাঁরা রোগীর আত্মীয়দের বোঝান, তাঁদের কাছে সিরাম নেই। অন্য হাসপাতালে নিয়ে যান। পথেই রোগীর মৃত্যু হয়। স্বাস্থ্য বিভাগের উচিত, সাপে কামড়ানোর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া আর দেশেই সিরাম উৎপাদনের ব্যবস্থা করা।


খসরু চৌধুরী সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ এবং এ বিষয়ের লেখক