আগামীকাল কী হবে গাজীপুরে?

নির্বাচনী প্রচারে দুই প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম ও হাসান উদ্দিন সরকার
নির্বাচনী প্রচারে দুই প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম ও হাসান উদ্দিন সরকার

: ভোট নিয়ে কী ভাবছেন?

: ভোট নিয়ে ভাবছি না।

: কেন ভাবছেন না। ভোট দেওয়া তো আপনার অধিকার।

: ভোট হলেও যা, না হলেও তা।

গাজীপুর চৌরাস্তার ভাস্কর্য জাগ্রত চৌরঙ্গী পেছনে ফেলে বেবিট্যাক্সিতে রাজবাড়ীর দিকে যেতে যেতে কথা হচ্ছিল চালকের সঙ্গে। খানাখন্দে ভরা সড়কটি সামান্য বৃষ্টিতেই বেসামাল। চালকের বিরক্তিরই প্রকাশ পায় তাঁর কথায়।

শুধু এই সড়ক নয়, গাজীপুরের প্রায় সব সড়কেরই বেহাল দশা। সেই সঙ্গে জলাবদ্ধতা সমস্যা প্রকট। শনিবার দেখলাম কোথাও কোথাও হাঁটুপানিতে মানুষ রাস্তা পার হচ্ছে।

ভাওয়াল রাজা মেজো কুমার রামেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর মামলার কল্যাণে একদা সারা ভারতে জয়দেবপুরের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। পাকিস্তান আমলে জয়দেবপুর ছিল মহকুমা। স্বাধীন বাংলাদেশে জয়দেবপুর বদলে গাজীপুর জেলা হলো। জয়দেবপুর রাজবাড়ি এখন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। পাশের চায়ের দোকানে আলাপ হয় কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দার সঙ্গে। জানতে চাইলাম, নির্বাচন কেমন হবে বলে মনে করেন? একজন বললেন, নির্বাচন কেমন হবে জানি না। তবে ভাবগতিক ভালো দেখছি না। ধরপাকড় শুরু হয়ে গেছে। আরেকজন যোগ করলেন, ‘নির্বাচন হলেও যে ফল হবে, না হলেও সেই ফল হবে। এ নিয়ে আমরা খুব একটা ভাবছি না।’

শনিবার গাজীপুর ও টঙ্গীর বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলি, যঁাদের বেশির ভাগই নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে গভীর সংশয় প্রকাশ করেছেন। আবার কেউ কেউ হতাশার বিপরীতে আশার ক্ষীণ আলোর আভাসও দিলেন। বলেছেন, গাজীপুরে খুলনার মতো আতঙ্কজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। অবস্থানগত কারণে গাজীপুরের প্রতি সবার চোখ থাকবে।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে প্রথম আলোর গাজীপুর প্রতিনিধি মাসুদ রানাকে নিয়ে পাশের একটি মার্কেটে যাই। দেখি, মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে দল বেঁধে তরুণেরা প্রচার চালাচ্ছেন। লিফলেট বিতরণ করছেন। রাস্তায় মাইকেও কেউ কেউ পছন্দসই প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন। মেয়র পদে সাতজন প্রার্থী হলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আওয়ামী লীগের জাহাঙ্গীর আলম ও বিএনপির হাসান উদ্দিন সরকারের মধ্যে। মার্কেটের দোকানদার ও ক্রেতাদের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে কথা বলি। তাঁরা পছন্দ-অপছন্দের কথা খোলাখুলি বললেন। একজন জাহাঙ্গীর আলমের প্রশংসায় পঞ্চমুখ তো অন্যজন হাসান সরকার ছাড়া কিছু বোঝেন না।

একটি বইয়ের দোকানে বসা ছিলেন তিন তরুণ। জিজ্ঞেস করি, নির্বাচন কেমন হবে বলে মনে করেন? একজন বললেন, ‘সত্য কথা বললে সমস্যা আছে। আপনারা কি বলতে পারেন?’ জানতে চাই, ভোট দিতে যাবেন তো। আরেকজন জবাব দিলেন, ‘ভোট দিতে যাব। তবে দিতে পারব কি না জানি না।’ মার্কেটের পাশে ডাব বিক্রি করছিলেন শ্মশ্রুধারী এক বয়স্ক লোক। বললেন, সুষ্ঠু ভোট হলে ধানের শীষই জিতবে। সেই সঙ্গে তিনি এও জানালেন, ২০১৪ সালে বিএনপির না যাওয়া ছিল আহাম্মকি। গরিব ডাবওয়ালার মুখে এ ধরনের রাজনৈতিক কথা শুনে বিস্মিত হই।

তবে বিস্ময়টা বেড়ে যায় যখন সেখান থেকে আরেকটি মার্কেটে ঢুকি। ডাবওয়ালা যতটা জোর দিয়ে ধানের শীষের পক্ষে বললেন, মোবাইল দোকানের তরুণ মালিক তাঁর চেয়েও বেশি জোর দিয়ে জানালেন, জাহাঙ্গীর আলমকে কেউ হারাতে পারবেন না। পুরো গাজীপুরবাসী তাঁর পক্ষে আছে।

প্রশ্ন করি, কেন তাঁর পক্ষে থাকবে? তাঁর জবাব, জাহাঙ্গীর আলম হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দিয়ে পড়াচ্ছেন। গরিব মানুষকে বিপদে-আপদে সাহায্য করছেন। গাজীপুরের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে নিজে ৩০০ সদস্যের একটি কর্মী দল বানিয়েছেন।

শহরের রাজবাড়ী সড়কের এপারে-ওপারে জেলা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অফিস। দুটোতেই এখন নিজ নিজ দলের নির্বাচনী অফিস । আমরা প্রথমে যাই বিএনপির জেলা কার্যালয়ে। ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন সেখানে নির্বাচনী কাজ তদারক করছিলেন। জানতে চাই, ভোটের পরিবেশ কেমন? স্থানীয় নেতারা জানান, ‘জনগণ তো আমাদের পক্ষে আছে। কিন্তু পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়াই বড় সমস্যা। সরকারি দল ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে।’ বলি খুলনার চেয়ে এখানকার অবস্থা তো ভালো। একজন বললেন, ১৫ মে নির্বাচন হলে তাদের জয় কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারত না। এ কারণেই নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।

জবাবে বললাম, আপনাদের প্রার্থী তো নির্বিঘ্নে প্রচার চালাতে পারছেন, তাহলে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা কেন? বললেন, বাইরে থেকে পরিবেশ ভালো মনে হলেও দলের নেতা-কর্মীদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। গত কয়েক দিনে অনেককে আটক করে গাজীপুরের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। নেতা-কর্মীর বাড়িতে ডিবি হানা দিচ্ছে। এসবের পরও সরকার প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করবে না বলে প্রধানমন্ত্রী যে আশ্বাস দিয়েছেন, তার প্রতি আস্থা রাখতে চান তঁারা। বিএনপি নেতাদের দাবি, খুলনা স্টাইলের নির্বাচন হলে মানুষ মানবে না, রাস্তায় নামবে।

এরপর আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়ে দেখলাম, সরাসরি গণভবন থেকে টিভিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ প্রচার হচ্ছে। কিন্তু অফিসে দু-একজন তরুণ ছাড়া কেউ নেই। ওই তরুণদের একজন প্রথম আলোর পরিচয় জেনে কিছুটা উষ্মার সঙ্গে বললেন, আপনাদের কাগজে কয়েক দিন আগে রিপোর্ট করেছে, গাজীপুর আওয়ামী লীগে বিভেদ আছে। তাঁকে সবিনয়ে জিজ্ঞেস করি, রিপোর্টের ভুল কোথায়। কাউন্সিলর পদে তো আপনারা কোথাও একক প্রার্থী দিতে পারেননি। তিনি বললেন, কাউন্সিলর প্রার্থীর কথা আলাদা। জাহাঙ্গীর আলমের পক্ষে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। সত্যিই জাগরণ হয়েছে কি না ২৬ জুনই জানা যাবে।

আওয়ামী লীগ অফিস থেকে যাই জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেনের বাসায়। সেখানে আরও কয়েকজন সাংবাদিক বন্ধু ছিলেন। ভোটের হালচাল সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি স্মিত হেসে বলেন, ভালো নির্বাচন হবে। দেখুন কোথাও গোলমাল নেই। সংঘাত নেই। বললাম, বিএনপির বেশ কজন নেতা-কর্মীকে তো গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জবাবে আওয়ামী লীগের এই নেতা জানান, গাজীপুরে ১১ লাখ ভোটার। এর মধ্যে ৮ জন গ্রেপ্তার হলে তাতে নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট হয়েছে বলা যাবে না।

তিনি আরও যোগ করলেন, ‘আমার মনে হয়, বিএনপি নির্বাচনের বিষয়ে আন্তরিক নয়। আন্তরিক হলে তারা অভিযোগ না করে প্রচারকাজে মনোযোগী হতো।’ তবে এই নেতাও স্বীকার করেন, ১৫ মে নির্বাচন হলে দলের জন্য সমস্যা হতো। তখন দল গোছানো ছিল না। তিনি মে মাসে প্রথম আলোর একটি রিপোর্টের উল্লেখ করে বলেন, ওই রিপোর্টে গাজীপুরের নির্বাচন ও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে যা লেখা হয়েছিল, শতভাগ সত্য। তখনো দলে বিভেদ ছিল। কিন্তু এখন সবাই জাহাঙ্গীরের পক্ষে মাঠে নেমেছেন। বিদায়ের সময় তিনি একটি মনোবেদনার কথাও জানালেন আমাদের। ২৩ জুন গণভবনে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় অন্যান্য জেলার নেতারা গেলেও গাজীপুরের নেতারা যেতে পারেননি। আগের রাতে কেন্দ্র থেকে বারণ করা হয়েছে। কেননা বর্ধিত সভার চেয়ে সিটি নির্বাচন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব দল ইশতেহার ঘোষণা করেছে। এসব ঘোষণায় গাজীপুরকে শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর সুন্দরতম শহর করা এবং সর্বোত্তম নাগরিক সেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আছে। কিন্তু গাজীপুরের মানুষ এসব কথা আমলে নিয়েছেন বলে মনে হয় না।
তাঁরা চিন্তিত ভোটটি কেমন হবে, ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোটাধিকারটি প্রয়োগ করতে পারবেন কি না ইত্যাদি নিয়ে।

গাজীপুরের ভোট নিয়ে পণ্ডিতজনেরা নানা রকম ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু আমরা সাদা চোখে দেখি, নিজ নিজ জোটসহ আওয়ামী লীগ ও
বিএনপির ভোট প্রায় সমান সমান। কমবেশি ৪০ শতাংশ। বাকি ২০ শতাংশ ভোটার যেদিকে ঝুঁকবেন, সেই দলই জয়ী হবে।

তবে সে জন্য নির্বাচনটি অবশ্যই সুষ্ঠু ও অবাধ হতে হবে।


সোহরাব হাসান:
প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি