বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস: বাংলাদেশ পরিস্থিতি

>

২০ জুন ২০১৮, প্রথম আলোর আয়োজনে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সহযোগিতায় ‘বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস: বাংলাদেশ পরিস্থিতি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশিত হলো।

আলোচনায় সুপারিশ

* অভিভাবকের সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে

* শিশুর আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার

* ঝুঁকিপূর্ণ ও গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের জরিপ প্রয়োজন

* গবেষণার মাধ্যমে শিশুদের শ্রমে নিযুক্ত হওয়ার কারণ নির্ধারণ করতে হবে

* শিশুর অধিকার রক্ষায় আইনের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিত

* বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজের সমন্বয় করা প্রয়োজন

* শ্রমজীবী শিশুদের স্কুলে ভর্তি করানোর পর যথাযথ নজরদারি করতে হবে

* সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে িশশুশ্রম সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম

শিশুশ্রম নিরসন বিশ্বব্যাপী আলোচিত বিষয়। একটি উন্নত জাতি গঠনে শিশুশ্রম নিরসনের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশে িশশুশ্রম উদ্বেগজনক। এটা কমিয়ে আনা জরুরি। কীভাবে শিশুশ্রমের হার কমিয়ে আনা যায়, সে বিষয়ে মতবিনিময়ের জন্য আজকের আলোচনা। এখন এ বিষয়ে বলবেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক।

মো. মুজিবুল হক
মো. মুজিবুল হক

মো. মুজিবুল হক

বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য কারণে দীর্ঘদিন ধরেই শিশুশ্রম বাংলাদেশে বিরাজমান। দেশের সার্বিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে এটি দৃষ্টিকটু। আমরা ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনের ঘোষণা দিয়েছি। ২০২৫ সালের মধ্যে চূড়ান্তভাবে শিশুশ্রম নিরসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

শিশুশ্রমকে কেন্দ্র করে নতুন আইন প্রণয়ন করেছে সরকার। বর্তমানে গার্মেন্টস সেক্টর শিশুশ্রমমুক্ত। এরপরও গোটা দেশে শিশুশ্রম সন্দেহাতীতভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিশুশ্রমকে দ্রুত নিরসন সম্ভব না হলেও সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে কমিয়ে আনা সম্ভব।

২০১৩ সালের আগে বাংলাদেশে কায়িক শ্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিশুর সংখ্যা ছিল ৩৪ লাখ। বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে সেই সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে।

শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শিশুদের দিয়ে কাজ করানোর অপরাধে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানার মালিকের বিপক্ষে ৭০টি মামলা হয়েছে।

৪০টি মামলার রায় হয়েছে। তবে কেবল আইন করলে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। প্রয়োজন সচেতনতা। সচেতনতার মাধ্যমে সমাজ থেকে শিশুশ্রমকে চিরতরে বিদায় করা সম্ভব।

সালমা আলী
সালমা আলী

সালমা আলী

শিশুশ্রম নিরসনে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কাজের তুলনায় ফলাফল পাচ্ছে না। আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে, তবে তা খুবই ধীরগতিতে। বাংলাদেশে অনেক ভালো আইন রয়েছে। আইনের কার্যকর প্রয়োগ হয় না বলে সমাজের প্রায় প্রতিটি সেক্টরে অবাধে শিশুশ্রম রয়েছে।

আন্তর্জাতিক অনেক প্রতিষ্ঠান শিশুশ্রম বন্ধের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। সরকার শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্যে কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কিন্তু প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত তত্ত্বাবধান করা হয় না। এ জন্য প্রকল্প তত্ত্বাবধানের জন্য একটি ছোটখাটো কমিটি থাকা উচিত।

অনেক পরিবার থেকে শিশুকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে না। শিশু বাধ্য হয় লেখাপড়া ছেড়ে কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার।

শিশুশ্রমকে নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। শিশুর শ্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণগুলো খোঁজা প্রয়োজন। কারণ িচহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

শাহীন আনাম
শাহীন আনাম

শাহীন আনাম

শিশুশ্রম নিরসনে এ সরকার অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারের পাশাপাশি ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ শিশুশ্রম বন্ধে নিরলসভাবে কাজ করছে। অনেকগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে এবং ইতিবাচক ফলও পেয়েছে।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন গত পাঁচ বছরে প্রায় ৯০ হাজার শ্রমজীবী শিশুকে স্কুলে ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করেছে। আমরা প্রতিবছর শিশুদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করি। এ িবষয়ে সরকারের কাছে বিভিন্ন সুপারিশ প্রদান করি।

গত বছর ২৫২টি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে ৮২ শতাংশ শিশুশ্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সাতজনকে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে।

পরিসংখ্যানটি আমাদের আশাহত করে। শিশুশ্রম বন্ধে অভিভাবকদের সচেতনতাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে কেবল বাবা-মাকে সচেতন করেই ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে।

 শিশুশ্রমবিষয়ক আইনের সংস্কার করা জরুরি। আইনের সঠিক বাস্তবায়নের জন্য প্রত্যেক সচেতন ব্যক্তিকে নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

মো. রাব্বি
মো. রাব্বি

মো. রাব্বি

আমি গাবতলী থেকে মহাখালী লাইনে কাজ করি। বাবা-মায়ের আর্থিক সমস্যার জন্য তৃতীয় শ্রেণির বেশি পড়াশোনা করার সুযোগ হয়নি। পরিবারের সঙ্গে গাবতলীর মাজার রোডের একটি বস্তিতে থাকি।

সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। আমার বেতন দিনে ১৫০-২০০ টাকা। কাজ করলে লেগুনামালিক খাবারের টাকা দেন।

কাজ করার সময় বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হয়। ন্যায্য ভাড়া দাবি করলেও অনেক যাত্রী খারাপ আচরণ করেন। ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে নিচে ফেলে দেন। বাবা-মাকে নিয়ে গালিগালাজ করেন। মুখ বুজে এসব সহ্য করতে হয়। নিজেকে অসহায় মনে হয়। এসব কাজ করতে ভালো লাগে না। আমার পড়াশোনা করতে ইচ্ছা করে। অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট থেকে মাঝেমধে্য সহযোগিতা পেয়ে থাকি। তবে যাদের টাকাপয়সা আছে, তাদের কাজ না করে পড়াশোনা করা উচিত।

মুনিরা আকতার
মুনিরা আকতার

মুনিরা আকতার

আমার ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা করব। বড় হয়ে ছোটখাটো একটা চাকরি করব। এ জন্য ভালো করে পড়াশোনা করছিলাম। কিন্তু অভাবের তাড়নায় পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। আমার বাবা বাসাবাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে দিয়েছেন। সেখানেই কাজ করছি।

আমার বাবা-মা পড়াশোনা সম্পর্কে সচেতন নন। পরিবারের সহায়তা ছাড়া একা পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সাহস হয়নি। কোনো কোনো বাসার মালিকের আচরণ ভালো না। সামান্য কারণেই রাগারাগি করে। বাসাবাড়িতে কাজ করতে ভালো লাগে না। পড়াশোনা করতে ইচ্ছে করে। কেউ আমাকে পড়াশোনা করার সুযোগ করে দিলে আমি খুব খুশি হতাম। তবে অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট শিশুদের সহযোগিতা করে থাকে।

রাজেকুজ্জামান রতন
রাজেকুজ্জামান রতন

রাজেকুজ্জামান রতন

শিশুরা নানা ধরনের কাজ করে। তবে জীবিকার জন্য মজুরির বিনিময়ে কাজ করলে তাকে শিশুশ্রম হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশ সরকার ৩৮ ধরনের কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে সেসব কাজে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করেছে।

শিশুর মাধ্যমে সাময়িক লাভ উপেক্ষা করে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে মানবসম্পদ উন্নয়নের কোনো িবকল্প নেই।

মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় একদিকে শিশুর স্বাস্থ্য ভেঙে যাচ্ছে এবং অন্যদিকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শ্রমদক্ষতা গড়ে না উঠে এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ সস্তা শ্রমের দেশ হিসেবে বিবেচিত হবে, যা আমাদের কাম্য নয়।

সংবিধানের ৮টি অধ্যায়ে শিশুদের অধিকার নিয়ে কথা বলা হয়েছে। সংবিধান মেনে আইনের মাধ্যমে শিশুদের অধিকার সংরক্ষণ ও বাস্তবায়ন করা উচিত। সচেতনতা ছাড়াও সক্ষমতার দিকে নজর দিতে হবে। শিশুর প্রতি সমাজের সহানুভূতি থাকা প্রয়োজন। শিশুদের ঝুঁকির হাত থেকে বাঁচাতে হলে এই খাতে সরকারকে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নিতে হবে।

আনজীর লিটন
আনজীর লিটন

আনজীর লিটন

সচেতনতার অভাবে শিশুশ্রম প্রকট আকার ধারণ করেছে। িশশুদের িনয়ে বাংলাদেশ শিশু একাডেমী দুই ধরনের কাজ করছে। প্রথমত, শিশুদের সৃজনশীলতা বিকাশ এবং দ্বিতীয়ত, শিশুর অধিকার সুরক্ষা।

এ বছর গ্রামীণ শিশুদের সৃজনশীলতা বিকাশ নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। অভিভাবকের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য উঠানবৈঠক করা হচ্ছে। শিশুশ্রমের ক্ষতিকর দিকগুলো সাধারণ মানুষকে জানানো হচ্ছে।

সরকার ছাড়াও শিশুশ্রম নিরসনে সহায়ক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অভিভাবকের সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে। শিশু শ্রমিককে স্কুলে ফিরিয়ে আনার পর সরকারিভাবে ভাতা প্রদান করা উচিত।

বর্তমান সরকার উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত মেয়েদের বিনা বেতনে পড়াশোনা ও উপবৃত্তির ব্যবস্থা করেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েদের উপস্থিতি আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। গরিব ছাত্রদেরও বৃত্তি প্রদানের বিষয়টি সরকারকে ভাবতে হবে।

চন্দন জেড গোমেজ
চন্দন জেড গোমেজ

চন্দন জেড গোমেজ

িশশুশ্রম িনরসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ প্রশংসার দাবিদার। সরকারের পাশাপাশি ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ ১৬৫ হাজার পরিবারের অরক্ষিত শিশুকে অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে শিশুশ্রমের হাত থেকে রক্ষা করেছে। ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী ও দিনাজপুরের ৩০ হাজার শিশুকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে শিক্ষাজীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

সম্প্রতি ‘শিশুর প্রতি শারীরিক নির্যাতন বন্ধ করতে আমি পারি’ নামে ওয়ার্ল্ড ভিশন গোটা বিশ্বে একটি প্রচারণা অভিযান পরিচালনা করছে। যার লক্ষ্য সমাজের প্রত্যেক মানুষকে শিশুশ্রম নিরসন কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা।

শিশুরা ফুলের মতো। তাদের মানসিক বিকাশে সহায়তা করা প্রয়োজন। এ জন্য একটি সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে শিশুশ্রমমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে।

ফারুক আহাম্মদ
ফারুক আহাম্মদ

ফারুক আহাম্মদ

শিশুশ্রম নিরসন সন্দেহাতীতভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শিশুশ্রম নিরসনে অব্যাহতভাবে কাজ করেছে। ধীরগতিতে হলেও আগের তুলনায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে আমাদের িনর্ভরযোগ্য পরিসংখ্যানের অভাব রয়েছে। সঠিক পরিসংখ্যান নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

কেবল আইন দিয়ে শিশুশ্রম নিরসন সম্ভব নয়। বাস্তবতার নিরিখে বিষয়গুলোকে বিবেচনা করতে হবে। শিশুশ্রম িনরসনে িশশুর আর্থিক নিরাপত্তা িনশ্চিত করতে হবে। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের জন্য অন্য সংগঠনগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে।

শ্রমের সঙ্গে জড়িত শিশুদের কারিগরি শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সমাজে ব্যাপকভাবে সচেতনতা বাড়াতে হবে। শিশুশ্রমের মূল কারণ দারিদ্র্য। শিশুকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে হবে।

সাহিদা বেগম
সাহিদা বেগম

সাহিদা বেগম

শিশুশ্রম নিরসনের উদ্দেশ্যে সেভ দ্য চিলড্রেন বয়সভিত্তিক কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। শিশু শ্রমিকদের বিকল্প আর্থিক সুবিধা না দিয়ে সরাসরি শ্রম থেকে তুলে স্কুলে ভর্তি করলে কার্যকর ফল পাওয়া যাবে না।

শিশুদের বয়সভিত্তিক ভাগ করে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অভিভাবক ও সাধারণ মানুষকে শিশুশ্রমের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে অবগত করতে হবে।

সেভ দ্য চিলড্রেনের একটি বড় প্রকল্প হলো এডুকেশন ফর ইয়ুথ এমপাওয়ারমেন্ট। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী শিশুদের কারিগরি শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করা এ প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য। এ ক্ষেত্রে কর্মদাতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সহযোগিতা করলে ভালো হয়।

আবদুছ সাইদ মাহমুদ
আবদুছ সাইদ মাহমুদ

আবদুছ সাইদ মাহমুদ

বড় বড় পোশাকশিল্পে শিশু শ্রমিক নেই। কিন্তু ছোট পোশাক কারখানাগুলোতে শিশু শ্রমিকের উপস্থিতি লক্ষণীয়। তিন মাস আগে সাভারের কয়েকটি পোশাকশিল্প পরিদর্শন করি। দেখা যায়, ৮০ শতাংশ শ্রমিক ১৫ থেকে ১৬ বছরের মেয়েশিশু। এ ধরনের কারখানাগুলোতে শিশুশ্রম নিরসনে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।

আমাদের দেশে নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যানের অভাব রয়েছে। এ জন্য বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। সঠিক পরিসংখ্যান জোগানের ক্ষেত্রে সরকারকে জোর দিতে হবে।

পরিবহনে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। যথাযথ গবেষণার মাধ্যমে এর কারণ অনুসন্ধান করতে হবে।

শিশুশ্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার পেছনে যেসব কারণ থাকে, তা খুঁজে বের করে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলে ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে শিশুশ্রমমুক্ত করা সম্ভব হবে।

মো. সামছুজ্জামান ভূইয়া
মো. সামছুজ্জামান ভূইয়া

মো. সামছুজ্জামান ভূইয়া

সমাজে দারিদ্র্য প্রকট আকারে ছড়িয়ে রয়েছে। চরম দারিদ্র্যের উপস্থিতি শিশুকে শ্রমে নিয়োজিত হতে বাধ্য করছে। দারিদ্র্য নিরসনের আগে শিশুশ্রম নিরসন করা কোনোমতেই সম্ভব নয়।

তবে হঠাৎ শিশুশ্রম নিরসন করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বিষয় চিন্তা করে পর্যায়ক্রমে এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশে আইন থাকলেও কার্যকর বাস্তবায়ন নেই। আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। অভিভাবকের আয় একটা নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করলে ওই পরিবারের শিশুরা শ্রমের সঙ্গে জড়িত হতে পারবে না।

আমাদের দেশের কয়েকটি মন্ত্রণালয়, এনজিও এবং কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান শিশুশ্রম নিরসনে কাজ করছে। তবে কাজের সমন্বয় নেই বলে সাফল্য অর্জিত হচ্ছে না। একটা নির্দিষ্ট খাত থেকে সম্পূর্ণভাবে শিশুশ্রম তুলে দেওয়ার পর সেসব শিশুর স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে।

ইতিমধ্যে শিশুদের নিয়ে তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। আরও একটি বড় ধরনের প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। প্রকল্পটি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে ২০২৫ সালের মধ্যে সব খাত থেকে শিশুশ্রম নিরসন করা সম্ভব হবে।

মো. মল্লিক চান
মো. মল্লিক চান

মো. মল্লিক চান

ছোট বাচ্চারা স্বেচ্ছায় আমাদের কাছে

এসে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে এবং অনুরোধ করে। হাত-পায়ে ধরে কাজ করতে চায়। বাধ্য হয়েই তাদের টেম্পোর সহকারী হিসেবে রাখতে হয়।

আমরাও চাই তারা স্কুলে পড়াশোনা করুক। কিন্তু পড়াশোনা তো দূরের কথা, তিন বেলা খেতেই পারে না। বাধ্য হয়ে কাজের সঙ্গে জড়িত হয়।

কোনো কোনো সময় এসব শিশুর বাবা-মা এসে কাজ দেওয়ার অনুরোধ করেন। তাই তাদের কাজ িদতে হয়। তা ছাড়া বড় মানুষ লেগুনার পেছনে দাঁড়ালে উল্টে যেতে পারে। এ জন্য ছোটদের কাজে িনলে চালকের সুবিধা হয়।

জঁ্য লিবি
জঁ্য লিবি

জঁ্য লিবি

প্রথম আলোকে ধন্যবাদ। তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনায় এনেছে। বাংলাদেশে প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে ১ জন শ্রমের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু শিশুশ্রম কারও কাম্য না।

সরকারের জাতীয় কর্মপরিকল্পনা রয়েছে, যেখানে ২০২১ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসনের কথা বলা হয়েছে। তবে যদি জাতীয় এ কাজের জন্য অর্থ বরাদ্দ না থাকে, তাহলে এ ধরনের কর্মপরিকল্পনা খুব একটা কাজে আসবে না। শিশুশ্রম নিরসন করার জন্য সরকার, এনজিওসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

আমাদের জানামতে, ৩১টা উন্নয়ন–সহযোগী প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজসহ অনেকে এ ক্ষেত্রে কাজ করছে। কিন্তু সমন্বিতভাবে কাজ করছে না বলে শিশুশ্রম নিরসনে আশানুরূপ অগ্রগতি হচ্ছে না। শ্রমজীবী শিশু কেবল মজুরি কম পায় না; শারীরিক-মানসিকভাবে নির্যাতিত হয়। যৌন হয়রানির শিকার হয়। বিভিন্নভাবে অপমানিত হয়।

বাংলাদেশে হাজার হাজার শিশু গৃহকর্মী হিসেবে রয়েছে। তারা সপ্তাহে প্রায় সাত দিনই কাজ করে। তাদের কোনো স্বাধীনতা নেই। এভাবে শারীরিক, মানসিক, যৌন হয়রানিসহ প্রায় সব ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

মুনিরা সুলতানা
মুনিরা সুলতানা

মুনিরা সুলতানা

২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে বুয়েনস এইরেসে বিশ্ব শ্রম সংস্থার আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকার শিশুশ্রম নিরসনের প্রতিশ্রুতি দেয়। এ জন্য সরকারকে ধন্যবাদ।

শিশুশ্রম নিরসনে িশশুশ্রম–সম্পর্কিত আইনের ত্রুটিগুলো দূর করা জরুরি। অনেক প্রতিষ্ঠান শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ করে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো শিশুশ্রম নিরসনের উদ্দেশ্যে আইনে শাস্তির মেয়াদ দুই বছর জেল ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান করেছে। আমাদের আইনে ৫ হাজার টাকা জরিমানা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না।

বর্তমানে আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া চলছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ, তিনি যেন এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন।

খোন্দকার মোস্তান হোসেন
খোন্দকার মোস্তান হোসেন

খোন্দকার মোস্তান হোসেন

শিশুশ্রম নিরসনে করার জন্য সরকারের অঙ্গীকার রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীও শিশুশ্রমের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। তিনি আশা করেন, কোথাও শিশুরা কাজ করবে না। শিশুরা স্কুলে যাবে। খেলাধুলা করবে। আনন্দ-বিনোদনের মধ্যে থাকবে।

দেশে শিশুশ্রমের পরিস্থিতি জানানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিভাগীয় কমিশনারদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। ৩০ জুনের মধ্যে শিশুশ্রমের বিষয়ে প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হয়েছে।

আমাদের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। এ জন্য ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নিরসনের প্রতিশ্রুতি রয়েছে।

এ লক্ষ্যে ২৮৪ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শিশুশ্রম নিরসনের বিষয়ে খুবই আন্তরিক।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সহায়তায় মাঠপর্যায়ে প্রশাসনকে উজ্জীবিত করার জন্য কর্মশালা করা হচ্ছে। এসব কর্মশালায় প্রতিমন্ত্রী, সংশ্লিষ্ট সচিবেরা অংশগ্রহণ করছেন।

শিশুশ্রম নিরসনে সরকারের আরও অনেক উদ্যোগ রয়েছে। এসব উদ্যোগের ফলে শিশুশ্রম কমে আসছে। ভবিষ্যতে আরও কমবে।

টুমো পৌটিয়াইনেন
টুমো পৌটিয়াইনেন

টুমো পৌটিয়াইনেন

শিশুশ্রম নিরসনের জন্য বাংলাদেশ সরকার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। এ জন্য সরকারকে ধন্যবাদ। নূ্যনতম বয়স–সংক্রান্ত আইএলও কনভেনশন ১৩৮ অনুস্বাক্ষরের জন্য সরকারকে অনুরোধ জানাচ্ছি। বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস ২০১৮–এর প্রতিপাদ্য বিষয় ‘প্রজন্মের জন্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য’। আরও দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।

এক. জরুরি ভিত্তিতে শিশুশ্রম নিরসন। দুই. কিশোর-কিশোরী ও প্রাপ্তবয়স্ক তরুণ তরুণীদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপদ কর্মপরিবেশের নিশ্চয়তা দেওয়া।

রানা প্লাজা ধসের পর সরকার অনেক সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। এ জন্য সরকারকে ধন্যবাদ। শিশুশ্রম নিরসনে সরকারসহ সবার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।

এটা শুধু শ্রম মন্ত্রণালয়ের একার কাজ নয়। এনজিও, নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ী প্রতিনিধিসহ সব শ্রেণি–পেশার মানুষের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

শিশুশ্রম নিরসনে একটি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে হবে এবং তা অর্জনে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা অনুসারে কাজ করতে হবে।

বিশেষ করে এ দেশে অনেক শিশু প্রচণ্ড ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো শিশুদের শ্রমে নিয়োগ করে, সেসব প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্বসহকারে সতর্ক করা উচিত।

মো. মুজিবুল হক

শিশুশ্রম নিরসনে সরকারের উদ্যোগকে সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। গণমাধ্যমকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

বিভিন্নভাবে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে শিশুশ্রমের কুফল সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। শিশুশ্রম নিরসনের জন্য একটি কমিটি করা হয়েছে। সরকারের ২২টি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি রয়েছে। বিভিন্ন এনজিও সম্পৃক্ত রয়েছে। সমন্বিতভাবে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।

ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের সঙ্গে নিয়োজিত শিশুদের জন্য একটি ২৮৪ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। প্রয়োজনে এসব শিশুর অভিভাবককে ঋণ প্রদান করে বা অন্য কোনো ব্যবস্থা করে জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করা হবে।

বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শিশুশ্রম নিরসনে কাজ করছে। কয়েকটি এনজিও প্রশংসনীয়ভাবে তাদের কর্মসূচি পালন করছে। শিশুশ্রম নিরসনে বর্তমান সরকারও খুব আন্তরিক।

 সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়িত হলে ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম এবং ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নির্মূল করা সম্ভব হবে।

আব্দুল কাইয়ুম

আজকের আলোচনায় অনেকগুলো িবষয় এসেছে। িশশুশ্রম িনরসনে একদিকে সচেতনতা এবং অন্যদিকে িশশুর অার্থিক নিরাপত্তার িবষয়টি মাথায় রাখতে হবে।

সরকারের পাশাপাশি অন্য সংগঠনগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

 আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

যাঁরা অংশ নিলেন

মো. মুজিবুল হক: সাংসদ, প্রতিমন্ত্রী, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়

খোন্দকার মোস্তান হোসেন: অতিরিক্ত সচিব, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়

মো. সামছুজ্জামান ভূইয়া: (অতিরিক্ত সচিব) মহাপরিদর্শক, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর

আনজীর লিটন: পরিচালক, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী

টুমো পৌটিয়াইনেন: কান্ট্রি ডিরেক্টর, আইএলও কান্ট্রি অফিস, বাংলাদেশ

ফারুক আহাম্মদ: মহাসচিব, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশন

রাজেকুজ্জামান রতন: সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট

আবদুছ সাইদ মাহমুদ: পরিচালক, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম

শাহীন আনাম: নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

সাহিদা বেগম: প্রোগ্রাম ডিরেক্টর, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ

জঁ্য লিবি: শিশু সুরক্ষা প্রধান, ইউনিসেফ

সালমা আলী: নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি

চন্দন জেড গোমেজ: কর্মসূচি পরিচালক, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ

মুনিরা সুলতানা: প্রোগ্রাম অফিসার, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা

মুনিরা আকতার: শিশুশ্রমিক, গৃহকর্মী

মো. রাব্বি: শিশুশ্রমিক, ওয়েল্ডিং কর্মী, অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট

মো. মল্লিক চান: টেম্পোচালক, অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট

সঞ্চালক

আব্দুল কাইয়ুম: সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো