জীবন উপভোগ করতে হয় সবাইকে নিয়ে

হায়াৎ মামুদ
হায়াৎ মামুদ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক ও অনুবাদক হায়াৎ মামুদের আজ ৮০ তম শুভ জন্মদিন। এ উপলক্ষে প্রথম আলোর মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম


প্রথম আলো: আমরা আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আপনার বয়স ৮০ বছর পূর্ণ হলো। ৮০ বছর বয়স কেমন?

হায়াৎ মামুদ: কম না তো। ৮০ বছর লম্বা বয়স...

প্রথম আলো: অঙ্কের হিসাবে না, জীবনটাকে কী মনে হচ্ছে?

হায়াৎ মামুদ: জীবন অনেক আনন্দে কাটিয়েছি...

প্রথম আলো: আপনি বহু বছর শিক্ষকতা করেছেন, বইপত্র লিখেছেন অনেক, অনুবাদ করেছেন, অনেক বই সম্পাদনা করেছেন। সব মিলিয়ে আপনার কাজের পরিমাণ কম নয়। এখন কি আপনার মনে হয়, আপনি আরও করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু করতে পারেননি?

হায়াৎ মামুদ: না, তা নয়। আমি যা চেয়েছি সব করেছি, নিজেকে নিয়ে আমার কোনো অতৃপ্তি নেই। ছাত্রছাত্রীরা আমাকে খুব ভালোবাসে। এটা আমার মস্ত বড় পাওয়া। যেসব ছাত্রছাত্রী দূরে চলে গেছে, দেশের বাইরে গেছে, তারা ঢাকায় এলে আমার খোঁজখবর নেয়।

প্রথম আলো: আপনি লেখালেখি করেছেন নানা বিষয়ে। মূলত কী লিখেছেন? লেখালেখির জগতে আপনি কোন শাখার মানুষ?

হায়াৎ মামুদ: প্রবন্ধ এবং শিশুসাহিত্য।

প্রথম আলো: শিক্ষা, সাহিত্য, ভাষা, সমাজ ও সংস্কৃতি—এসব আপনার প্রবন্ধের বিষয়। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতক পরে এখন আমাদের দেশ কী অবস্থায়?

হায়াৎ মামুদ: খারাপ অবস্থায় আছি। আমাদের সমাজের চলন এমন হয়েছে যে পৃথিবীর ভালো কিছু সবই যেন বাংলাদেশের বাইরে। বাংলাদেশ খুব খারাপ জায়গা; ফলে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যেতে পারলেই সবাই যেন প্রাণে বাঁচে। তারপর গিয়ে যখন চাকরবাকরের অবস্থা হয়, তখন টের পায় নিজের দেশটা কেমন। নিজের দেশ যেমনই হোক, ওটা স্বর্গ। যাওয়ার আগে টের পায় না। আরেকটা বিষয় আমাকে বেশ কষ্ট দেয়। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, এই মাতৃভাষাই আজকালকার ছেলেমেয়েরা ভালো করে শিখছে না। তার অন্যতম কারণ, আমাদের শিক্ষায়তনগুলোতে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ানোর ভালো শিক্ষক এখন নেই।

প্রথম আলো: কেন নেই?

হায়াৎ মামুদ: ভালোভাবে শেখানো-পড়ানোর ব্যাপারটা তৈরি হয় ভালোবাসা থেকে। চাকরি করছি বলেই হয় না। শিক্ষকতার মানে হচ্ছে আমি ছাত্রছাত্রীদের মানুষ করব, তারা মানুষ হওয়ার পথ জানবে। এখন ইচ্ছে করে শিক্ষকতা করতে আসেন, শিক্ষকতাকে ভালোবেসে আসেন, এমন মানুষ এখন খুব কম। নেই বললেই চলে। কিন্তু আমাদের সময়ে অনেক ছিল; আমি নিজেও শিক্ষকতাই করতে চেয়েছি এবং সারা জীবন তা-ই করেছি। এখন কিন্তু সে রকম নয়।

প্রথম আলো: শুধু বাংলা ভাষা বা সাহিত্যের নয়, সব বিষয়েরই ভালো শিক্ষকের অভাবের কথা শোনা যায়। আমাদের শিক্ষার মান কমে যাওয়ার একটা কারণ ভালো শিক্ষকের অভাব। এই অভাব কেন দেখা দিল? আমাদের তো অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো শিক্ষক তৈরি করতে পারছে না কেন?

হায়াৎ মামুদ: কেন যে পারছে না...আমার তো মনে হয়, বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে শিক্ষকেরা আছেন, তাঁদের যদি বেশি মাইনের অন্য চাকরি দেওয়া হয়, তাঁরা সেখানে চলে যাবেন। কিন্তু এ রকম তো হওয়ার কথা ছিল না। আমার এ কাজ ভালো লাগে বলেই তো আমি এসেছি। টাকাপয়সার জন্য আসিনি। আমার ছাত্রছাত্রীদের মেলামেশা করতে, তাদের মানুষ করে তুলতে, তাদের স্বপ্ন দেখাতে—জাতি গঠনের স্বপ্ন, নিজেকে মানুষ করার স্বপ্ন, মানুষকে ভালোবাসার স্বপ্ন জাগাতে আমি শিক্ষায়তনে এসেছি। এখন এইটা বোধ হয় আর কারও মনে কাজ করে না।

প্রথম আলো: আমরা এ রকম হয়ে গেলাম কেন?

হায়াৎ মামুদ: কেন যে...! আমরা বোধ হয় পয়সাকড়ি চিনে গেছি! এ ছাড়া আর কী বলব?

প্রথম আলো: আমাদের মূল সমস্যা কী বলে আপনার মনে হয়? প্রকৃত শিক্ষার অভাব?

হায়াৎ মামুদ: আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে অর্থলালসা। টাকা পেলেই সবকিছু পেয়ে যাব—এই মানসিকতা। এর জন্যই পরীক্ষায় শুধু ভালো ফল করার জন্যই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটা। এর জন্যই নানা অন্যায়, অপরাধ, দুর্নীতি। অর্থলালসার জন্যই রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠান ঠিকমতো কাজ করছে না; সমাজটা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে; মানুষ নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে। অর্থলালসার জন্যই আমাদের সমাজ থেকে পরার্থপরতা চলে গেছে। অপরের জন্য কিছু করব, এটা কেউ ভাবে না। কেউ ভাবলে বলা হবে, বোকা লোক। গরিব দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি তো এটাই যে আমার পাশে আরও ১০ জন আছে।

প্রথম আলো: এই অবস্থা থেকে আমরা বেরোতে পারি কীভাবে? কোনো পথ আছে?

হায়াৎ মামুদ: হ্যাঁ, পথ তো আছেই।

প্রথম আলো: সেটা কী?

হায়াৎ মামুদ: সমাজের দিকে তাকানো। শুধু নিজের কথা না ভেবে অন্যের কথাও ভাবা।

প্রথম আলো: সেটা শুরু হবে কোন জায়গা থেকে?

হায়াৎ মামুদ: এক জায়গা থেকে না, শুরু করতে হবে সব জায়গা থেকে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে শিক্ষায়তন।

প্রথম আলো: ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, তরুণ-তরুণীদের প্রতি আপনি কিছু বলবেন?

হায়াৎ মামুদ: তরুণ-তরুণীদের প্রতি আমার বলার কিছু নেই। তাদের মা-বাবাদের প্রতি বলার আছে, তাঁরা যেন ছেলেমেয়েদের প্রতি লক্ষ রাখেন। বড়দের উদ্দেশে আমার বলার আছে: আমাদের দেখেই তরুণ-তরুণীরা শিখছে। তাই আমাদের সেভাবে চলতে হবে, যেভাবে চললে আগামী প্রজন্ম পরার্থপর হয়; শুধু নিজের নয়, সবার কথা ভাবে।

প্রথম আলো: দেশের ভবিষ্যৎ কী দেখেন?

হায়াৎ মামুদ: দেশ এ রকমই চলবে। খারাপ-ভালো, খারাপ-ভালো—এ রকমই চলবে। অদূর ভবিষ্যতে খুব ভালো কিছু ঘটবে না, খুব খারাপ কিছুও দেখি না। গড়িয়ে গড়িয়ে চলা আরকি।

প্রথম আলো: আমরা এখন কথা শেষ করব। জীবন সম্পর্কে আপনার শেষ কথা কী?

হায়াৎ মামুদ: জীবন চমৎকার। জীবনকে উপভোগ করতে জানতে হয়। একা নয়, সবাইকে নিয়ে।

প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

হায়াৎ মামুদ: সবার জন্য শুভকামনা।