পুঁজি পাচারের লাগাম টেনে ধরুন

সদ্যবিদায়ী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের আমদানি বিল ৬ হাজার কোটি ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে কিংবা ছাড়িয়ে যাবে এবং ব্যাপারটা মোটেও স্বাভাবিক নয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ৪ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের পণ্য, এক বছরে এক লাফে আমদানি ব্যয় ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারটা যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না। গত বছর আগাম বর্ষা ও বন্যায় বোরো ধানের মারাত্মক ক্ষতি হওয়ায় উৎপাদন ঘাটতি পূরণে এক বছরে খাদ্যশস্য আমদানি প্রায় এক কোটি টনে পৌঁছে যাওয়ায় ওই খাতে আমদানি ব্যয় প্রায় ২০০ কোটি ডলার বেড়েছে। একই সঙ্গে পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প ও এলএনজি টার্মিনাল এবং পায়রা বিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের প্ল্যান্ট ও যন্ত্রপাতি আমদানির প্রবাহ যুক্ত হওয়ায় এ বছরের আমদানি বিল অনেক দ্রুত বেড়েছে বলে ধারণা দেওয়া হচ্ছে। তা সত্ত্বেও আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমদানি বিলের এই অস্বাভাবিক উল্লম্ফন কোনোমতেই অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির কারণে হচ্ছে না। এই উল্লম্ফনের মূল কারণ দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচার–প্রক্রিয়া মারাত্মক পর্যায়ে উপনীত হওয়া।
কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচার ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে, এটা ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নয়। আইএলও এবং গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) মতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থা বেশ কিছুদিন ধরেই এ ব্যাপারে বিপৎসংকেত দিয়ে চলেছে। কিন্তু আমাদের দেশের নীতিপ্রণেতাদের এই ইস্যুতে মোটেও আগ্রহী হতে দেখা যাচ্ছে না। আইএলও প্রায় তিন বছর
আগে ঘোষণা করেছে যে বাংলাদেশ থেকে বছরে পাঁচ-ছয় শ কোটি ডলার পুঁজি বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। প্রায় দুই বছর আগে নিউইয়র্কভিত্তিক
গবেষণা সংস্থা জিএফআই ঘোষণা দিয়েছে যে তাদের সর্বশেষ গবেষণা মোতাবেক, বাংলাদেশ থেকে ২০১৫ সালে ৯০০ কোটি ডলারের বেশি পুঁজি বিদেশে পালিয়ে গেছে।
পুঁজি পাচার প্রতিরোধ করা অসাধ্য নয়। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে কীভাবে তা নিরুৎসাহিত করা যায়, তার নজির বিভিন্ন দেশে রয়েছে। আমদানি বাণিজ্যে ওভারইনভয়েসিং বিশ্বের সব উন্নয়নশীল দেশে অতি পরিচিত এবং বহুল প্রচলিত পুরোনো সমস্যা। এটাকে পুঁজি পাচারের সবচেয়ে কার্যকর পন্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একই সঙ্গে রপ্তানি বাণিজ্যে আন্ডারইনভয়েসিং বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা সফলভাবে ব্যবহার করে চলেছেন পুঁজি পাচারের জন্য। এ দেশের রপ্তানিকারকেরা তাঁদের রপ্তানি আয় সবটুকু দেশে আনছেন না, এটাও নীতিপ্রণেতাদের না জানার কথা নয়। আমাদের পোশাক ও নিটওয়্যার শিল্পের রপ্তানিকারকেরা যে কানাডার টরন্টোর বেগমপাড়ার বাসিন্দাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেটাও আমরা বহুদিন ধরে গবেষণার মাধ্যমে সবাইকে জানিয়ে যাচ্ছি।
মালয়েশিয়ার ‘সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচির সিংহভাগ খদ্দেরও ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা। যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যেখান থেকেই তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হোক, দেখা যাবে, পুঁজি লুটেরা রাজনীতিবিদ, দুর্নীতিবাজ সামরিক–বেসামরিক কর্মকর্তা, ক্ষমতাসীন মহলের কৃপাধন্য ব্যবসায়ী ও ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতা-নেত্রীদের পরিবার-আত্মীয়স্বজন দলে দলে বিদেশে ঘরবাড়ি, রিয়েল এস্টেট, ব্যবসাপাতি কিনে পুঁজি পাচারের ফায়দাভোগীদের দল ভারী করে চলেছেন। এ দেশের বিভিন্ন চেম্বার কিংবা ব্যবসায়ী সমিতির অতীতের বা বর্তমান নেতাদের, ব্যাংকমালিকদের কিংবা বড়সড় ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য কোথায় বসবাস করছেন, খবরাখবর নেওয়া হলে আমার এই দাবির অকাট্য প্রমাণ মিলবে। বাংলাদেশের প্রতিটি ছোট-বড় প্রকল্পের খরচ যে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, তার কারণ এই পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের মচ্ছব। বর্তমান সরকারের উন্নয়নের মহোৎসব যে ওপরে উল্লিখিত পুঁজি লুটেরাদের বেধড়ক পুঁজি লুণ্ঠনে ঘৃতাহুতি দিয়ে চলেছে, এ অভিযোগ অস্বীকার করা যাবে না।
এই ওভারইনভয়েসিং-আন্ডারইনভয়েসিংয়ের চেয়েও পুঁজি পাচারকে একেবারেই সহজ করে দিয়েছে বাংলাদেশের ১ কোটি ৩০ লাখ অভিবাসী বা এনআরবির রেমিট্যান্স প্রেরণে গেড়ে বসে থাকা ‘হুন্ডি পদ্ধতি’। এখন আমরা সবাই বুঝতে পারছি যে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থার খেলাপি ঋণ সমস্যার মূলেও রয়েছে এই পুঁজি পাচার সমস্যা। সরকার যতই লুকানোর চেষ্টা করুক না কেন, এই ক্রমবর্ধমান ঋণ খেলাপ সমস্যা বাড়তেই থাকবে। বড় বড় রাঘববোয়ালের হাজার হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের সিংহভাগ
আদতে দেশেই নেই। এই অর্থ প্রধানত ওভারইনভয়েসিং, আন্ডারইনভয়েসিং এবং ‘হুন্ডি সিস্টেমের’ মাধ্যমে অতি সহজে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এ রাঘববোয়ালদের ধরপাকড় শুরু হলে গোপনে তাঁদের বিদেশে পলায়নের হিড়িক পড়বে। কারণ, তাঁদের পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য ইতিমধ্যেই বিদেশে ঘাঁটি গেড়ে বসেছেন। ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ বাগিয়ে তাঁরা বহুদিন ধরে বিদেশে পুঁজি পাচারে ব্যাপৃত রয়েছেন।
এখন সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচার মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়, বিশ্বের সব উন্নত দেশে এবং বিশেষত ‘ট্যাক্স-হ্যাভেন’ হিসেবে বহুল পরিচিত দেশগুলোতে এখন সহজেই পুঁজি পাচার হয়ে যাচ্ছে। সরকার এখন ব্যাংকগুলোর মালিকপক্ষকে যেভাবে বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে ওগুলোকে তাঁদের পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত করতে উঠেপড়ে লেগেছে, তাতে পুঁজি পাচার যে আরও প্রচণ্ডভাবে উৎসাহিত হবে, তাতে সন্দেহ নেই। যেহেতু দেশের বড় আমদানিকারকেরাই এখন বিভিন্ন ব্যাংকের মালিক এবং পরিচালকদের অন্তর্ভুক্ত কিংবা তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখেন, তাই তাঁদের আমদানি–রপ্তানির এলসি বা ইনভয়েস সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রসেস করা বা রিজেক্ট করার ক্ষমতা ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কিংবা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জন্য দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। এখন মধ্যম বা নিচু স্তরের ব্যাংকাররা দিনরাত খেটে এসব রাঘববোয়ালের পুঁজি লুণ্ঠনকে শক্তিশালীকরণের অসহায় অংশীদারের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। বলাবাহুল্য, তাঁদের চাকরি নিয়েই টানাটানি পড়বে এগুলো নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করলে। আবার ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি উদ্‌ঘাটিত হলেও প্রথমেই কোপ পড়বে তাঁদের ওপর। (আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন ব্যাংকার দীর্ঘদিন হাজতে দিনযাপন করছেন বেসিক ব্যাংকের মামলার কারণে, কিন্তু শেখ আবদুল হাই বাচ্চু দিব্যি বহাল তবিয়তে দিন গুজরান করছেন।)
ওভারইনভয়েসিং ও আন্ডারইনভয়েসিং শক্তভাবে ঠেকানোর জন্য ব্যাংকগুলোর সক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমছে। এসব ঠেকাতে হলে ব্যাংকের কয়েক শ মালিক-পরিচালকের ক্ষমতার তাণ্ডব প্রতিরোধ করতেই হবে। ব্যাংকগুলোর শীর্ষস্থানীয় নির্বাহীসহ প্রকৃত ব্যাংকাররা এখন দিন দিন যেভাবে মালিক-পরিচালকদের কাছে অসহায় বলির পাঁঠা কিংবা সক্রিয় বখরা ভাগাভাগির অংশীদারে পরিণত হচ্ছেন, সেটা থামানো না গেলে ব্যাংক ব্যবস্থাকে বাংলাদেশের এই মহাশক্তিধর ‘রবার-ব্যারনদের’ খপ্পর থেকে বাঁচানো যাবে না।
গেল বছরের লেনদেন ভারসাম্য বা ব্যালান্স অব পেমেন্টসের চলতি খাতে (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট) এপ্রিল মাসের মধ্যেই সাড়ে আট শ কোটি ডলার ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছিল, জুন মাসের হিসাব পাওয়া গেলে এই ঘাটতি ১ হাজার কোটি ডলার পেরিয়ে যাবে বলে ধারণা। কারণ, রপ্তানি আয় ও নিট রেমিট্যান্স মিলিয়ে ৬ হাজার কোটি ডলার আমদানি ব্যয়ের মধ্যে বড়জোর ৫ হাজার কোটি ডলার পরিশোধ করা যাবে, বাকি ১ হাজার কোটি ডলার হয় বৈদেশিক ঋণ দিয়ে মেটাতে হবে, নয়তো বৈদেশিক মুদ্রার মজুত থেকে নিতে হবে। জনসাধারণের অগোচরে এ দেশের বৈদেশিক ঋণ গত এক বছরে প্রায় সাত হাজার কোটি ডলার বাড়িয়ে ফেলা হয়েছে। রূপপুর, মাতারবাড়ী, পায়রাসহ যেসব মেগা প্রকল্পের জন্য ‘সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট’ গ্রহণ করা হয়েছে, ওসব ঋণের অর্থ দেশে আসতে শুরু করায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে এখনো বড়সড় ধস দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু মজুত ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার থেকে বাড়ার পরিবর্তে ১০০ কোটি ডলার কমে
গেছে গত এক বছরে। অতএব যে কথাটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীকে দৃঢ়ভাবে বলতে চাই তা হলো, অবিলম্বে আমদানির উল্লম্ফন এবং পুঁজি পাচারের মচ্ছবের লাগাম টেনে ধরুন। নয়তো অর্থনীতির ‘ম্যাক্রো-ইকোনমিক ব্যালান্স’ তছনছ হতে বেশি সময় লাগবে না।

মইনুল ইসলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ইউজিসি অধ্যাপক