সোনার ডিম পাড়া প্রজন্মকে পঙ্গু করবেন না

প্রতিভাধর বিজ্ঞানী হেলেন কেলার বলেছিলেন, ‘এমন একজন রাজা নেই, যাঁর পূর্বপুরুষে কেউ দাস ছিলেন না, আবার এমন একজনও দাস নেই, যাঁর পূর্বপুরুষ কেউ রাজা ছিলেন না।’ সভ্যতার বিধান হলো, আমার খুব নিকট অতীত ধরেই শুধু টান দিই। বাবা কী করে? আজ সেই নিকট পূর্বপুরুষের ইতিহাস আরও ভারী, আরও বেদনাবহ হয়ে যায়, যখন দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের নামে কোটাব্যবস্থার অব্যবস্থাপনায় নতুন প্রজন্ম ভোগে। যখন ন্যায্য চাওয়াকে পাওয়ায় রূপ দেওয়া সুশাসনের বদলে শাসকের কাছে নতিস্বীকারে বাধ্য করা হয়। যখন দেশের জনগণ শাসকদের প্রধানতম বিরোধী দল হয়ে দাঁড়ায়, তাদের সব কটি মৌলিক ইস্যু তখন স্নায়ুযুদ্ধে পরিণত হয়। আমাদেরও অসহায়ত্ব, যেকোনো দাবিদাওয়া নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজেদের রাস্তার মানুষ প্রমাণ করতে হয়। সরব হতে গেলেই জোটে আইনি পুলিশ আর বেআইনি লাঠিয়ালদের আগ্রাসন। আর নীরব আমরণ অনশনে গেলে জোটে ছাগল তাড়ানো আশ্বাস।

এক কোটাব্যবস্থাতেও তিন দফায় ছাগল তাড়ানো আশ্বাস এসেছিল, শেষ ছিল গত ১৪ মে। কেন নো ভ্যাট আন্দোলন একদফায় সফল হয়, কেন কোটা আন্দোলন, শিক্ষক আন্দোলন সফল হয় না, তার সমীকরণ খুব স্পষ্ট হয়, যখন কোটার সুবিধাভোগী বনাম ভ্যাটের সুবিধাভোগীদের মাথা গোনা যায়। উল্লেখ্য, কোটাব্যবস্থা নিয়ে প্রকাশিত তথ্যমতে, নিবন্ধিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই-আড়াই লাখ। অর্থাৎ এক হাজার মানুষের মাঝে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ দশমিক ২ জন বা ১ দশমিক ৫ জন, যা সমগ্র জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ১২ থেকে শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ। মুক্তিযোদ্ধা কোটার পরিমাণ ৩০ শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৫৫ শতাংশের বেশি কোটা রয়েছে। চাকরির ক্ষেত্রে কোটাব্যবস্থার পাঁচটি দাবি নিয়ে চাকরিপ্রত্যাশীরা আন্দোলন করছেন। প্রথম দাবি হলো, সরকারি চাকরির বেলায় বর্তমান কোটা ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ করা।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্যমতে, গত এক দশকে বাংলাদেশে বেকারত্ব বেড়েছে বছরে ১ দশমিক ৬ শতাংশ হারে। সেই অনুসারে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার কমেছে ২ শতাংশ হারে। অর্থাৎ কর্মক্ষম মানুষ যেভাবে বাড়ছে, যে হারে কর্মসংস্থান না বেড়ে বরং কমছে। প্রতিবছর শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে প্রায় ২৭ লাখ কর্মক্ষম ব্যক্তি। এর মধ্যে চাকরি পাচ্ছেন মাত্র ৭ শতাংশ, অর্থাৎ ১ লাখ ৯০ হাজার। বাকি প্রায় ২৫ লাখ বেকার থেকে যাচ্ছেন। আইএলওর হিসাবে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি এবং বেকারত্ব বাড়ছে এমন ২০টি দেশের তালিকার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম।

আবার বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে বিভিন্ন শিল্পকারখানা বন্ধ হওয়ায় প্রায় ১০ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) আওতাধীন ২৯টি ক্যাডারে প্রতিবছর দেড় থেকে সোয়া দুই লাখ অংশগ্রহণ করে, যাতে সফলতার হার ২ শতাংশ, বিশেষ বিসিএসে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থাৎ মাত্র চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার চাকরিপ্রার্থীর সংস্থান হয় এভাবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপে উঠে এসেছিল উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি—৯ শতাংশ। অথচ কোনো ধরনের শিক্ষার সুযোগ পাননি, এমন মানুষের মধ্যে মাত্র ২ দশমিক ২ শতাংশ বেকার। আমাদের মধ্যবিত্ত মনস্তত্ত্ব, শ্রেণিভেদ, তীব্র আত্মচাহিদার ঘেরাটোপ শিক্ষার্থীর সবল হাতে-পায়ে শিকল পরায়। পাশাপাশি কোনো কাজে ন্যূনতম পেশাদারিটাও গড়ে উঠতে অন্তরায়। যেমন প্রবাসী প্রত্যেকেই কোনো কাজের আউটসোর্সিংয়ের বিষয় এলে নিজের দেশেই আহ্বান জানান। কিন্তু উপযুক্ত সাড়া মেলে না। মিললেও মেইল বা ফোনের প্রত্যুত্তরের দায়বদ্ধতার বালাই নেই। যার দরুন কাজ ডেলিভারির সুনির্দিষ্ট সময়সীমা সেই কর্মী আদৌ মেটাতে পারবেন কি না, এই নিয়ে ভয়াবহ আশঙ্কায় পড়তে হয়।

যদি মুক্তমঞ্চে (ফ্রিল্যান্সার ডটকম ইত্যাদি) একই কাজের আহ্বান জানানো হয় তো পাশের দেশ ভারত থেকে থেকে সেকেন্ডের ভগ্নাংশে কমপক্ষে ১০ জন সাড়া দেয়, সময়কালভেদেই। এবং কাজটার প্রাথমিক আউটলাইন দেওয়ার পর খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত জানায়। এমনকি কাজটি তার নিজ দক্ষতার বাইরে হলে অন্য কাউকে রেফার করার মতো নিঃস্বার্থ সাহায্য করতেও কোনো কালক্ষেপণ করে না। কারণ, তারা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করে। এমন পেশাদার আচরণে কর্মদাতা অবশ্যই তার ওপর নির্ভর করবেন, তার রেফার করা ব্যক্তির কাছে তার নামও উল্লেখ করবেন। একই ইন্ডাস্ট্রিতে একে অন্যের প্রয়োজনে এই কাঁধ ভাগাভাগি সুস্থ প্রতিযোগিতাকেই প্রণোদিত করবে। কষ্টকরভাবেই সত্য যে আমাদের এহেন অপেশাদার কর্মীদের নিয়ে কাজ করাতে যথেষ্ট দেশপ্রেমী অথবা নিরুপায় হতে হয়। কোনো প্রজেক্টে গেলে টাকার ভাগীদার সবাই, দায়িত্বের ভাগীদার কেউ না। অথচ এসবই কিন্তু পরবর্তী প্রকল্পের রেফারেন্স নষ্ট করে।

আমাদের সোনার ডিম পাড়া হাঁস জিইয়ে রেখে ডিম সংগ্রহের ধৈর্য নেই। অদূরদর্শিতায় প্রথমেই হাঁসটাকে জবাই করে ফেলি। এই দক্ষতা আর পেশাদারির অভাব কিন্তু কোনো কোটায় আটকে নেই। আজ কোটাব্যবস্থার সফল সংস্কার হলে উপকৃত হবেন কয়েক হাজার। কিন্তু আমাদের পেশাদারি আর দক্ষতা বৃদ্ধিতে রক্ষা পাবে বিশাল কর্মহীন জনশক্তি। কাজেই দক্ষ জনশক্তি তৈরি এবং কর্মসংস্থানের সামগ্রিক সংস্কার চাই।

তানজিনা ইয়াসমিন চৌধুরী: জাপানপ্রবাসী গবেষক।