পরিকল্পিত পরিবার মানবাধিকারের অংশ

ইউএনএফপিএর সহযোগিতায় প্রথম আলো আয়োজিত ‘পরিকল্পিত পরিবার: সুরক্ষিত মানবাধিকার’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তাঁর বাঁয়ে সাংসদ ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি ও ডানে সাংসদ বেগম ওয়াসিকা আয়শা খান।  প্রথম আলো
ইউএনএফপিএর সহযোগিতায় প্রথম আলো আয়োজিত ‘পরিকল্পিত পরিবার: সুরক্ষিত মানবাধিকার’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তাঁর বাঁয়ে সাংসদ ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি ও ডানে সাংসদ বেগম ওয়াসিকা আয়শা খান। প্রথম আলো

পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি আরও সফলভাবে কার্যকর করতে হলে সেবাগ্রহীতাদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। পরিকল্পিত পরিবার মানবাধিকারের অংশ। দম্পতিদের কাছে মানসম্পন্ন সেবা সহজলভ্য করে তুলতে হবে। সেবার ক্ষেত্রে সব ধরনের বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে।

গতকাল শনিবার রাজধানীর প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘পরিবার পরিকল্পনা: সুরক্ষিত মানবাধিকার’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা এসব মতামত দেন। প্রথম আলো এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ), গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা ও আরটিএম ইন্টারন্যাশনাল এই আয়োজনে সহায়তা করে।

১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। দিনটি সামনে রেখে এই আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক, একাধিক সাংসদ, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ইউএনএফপিএর প্রতিনিধি, অভিনেত্রীসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন।

অনুষ্ঠানে বলা হয়, পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য অনেক। জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী ব্যবহারের হার ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬২ শতাংশ হয়েছে। ১৯৭২ সালে দম্পতিপ্রতি সন্তান ছিল ৬ দশমিক ২ জন। এখন তা কমে হয়েছে ২ দশমিক ৩ জন। এসব উপাত্ত উল্লেখ করে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘আমরা জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঋণাত্মক পর্যায়ে নিতে চাই না। এ ব্যাপারে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত আছে। চীন তাদের জনসংখ্যা নীতি থেকে সরে এসে এখন দুই সন্তানের ওপর জোর দিচ্ছে।’

সাংসদ ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি বলেন, কোনো দম্পতি কত সন্তান কখন নেবেন, এ ক্ষেত্রে জন্মনিয়ন্ত্রণের কোন ধরনের পদ্ধতি তাঁরা বেছে নেবেন, সেই স্বাধীনতা দম্পতির থাকতে হবে। জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর মজুত যেন শেষ না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি।

সাংসদ বেগম ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি সফল করার জন্য সঠিক তথ্য-উপাত্তের বিকল্প নেই। বিশেষ ভৌগোলিক অঞ্চলের তথ্য-উপাত্ত আলাদা করে থাকা প্রয়োজন। চট্টগ্রাম ও সিলেট এলাকা পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। এসব অঞ্চলের জন্য পৃথক কর্মসূচি নিতে হবে।

মূল বক্তব্য উপস্থাপনের সময় ইউএনএফপিএর টেকনিক্যাল কর্মকর্তা আবু সাইদ হাসান বলেন, বাংলাদেশের জনঘনত্ব বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। প্রতিবছর ২০ লাখ মানুষ কর্মক্ষম হচ্ছেন। কিন্তু কর্মসংস্থান হচ্ছে ১২ লাখ মানুষের। বছরে ৫৮ লাখ নারী গর্ভধারণ করেন। এর মধ্যে ৪৮ শতাংশ অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ। এতে গর্ভপাত যেমন বাড়ছে, আবার গর্ভপাতজনিত কারণে মাতৃমৃত্যুও বাড়ছে। তিনি বলেন, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি সবার জন্য সহজলভ্য হলে ৪০ শতাংশ গর্ভপাত এড়ানো সম্ভব হবে। জোর করা যাবে না, তবে যাঁর সেবা প্রয়োজন তিনি যেন প্রয়োজনের সময় তা পান।

ইউএনএফপিএর ঢাকা কার্যালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান সাথিয়া দোরাইস্বামী বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিকার’ বা ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এসব স্লোগানের সঙ্গে পরিবার পরিকল্পনা সেবা এখন যুক্ত হয়েছে। এই সেবাকেও এখন অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে, মানুষ যেভাবে সেবা চায়, যে পদ্ধতি গ্রহণ করতে চায়, তাকে তা-ই দিতে হবে। চাপিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, আগের মাঠকর্মী দিয়ে ২০১৮ সালের মাঠের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না।

সরকারের কর্মকাণ্ডের বিবরণ দেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজী মোস্তফা সারোয়ার। তিনি বলেন, দেশে খাবার বড়ি ও কনডমের ব্যবহার বেশি। জন্মনিয়ন্ত্রণের দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী পদ্ধতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেশ কিছুটা পিছিয়ে আছে। দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর মজুতে কোনো সংকট নেই। মাঠে জনবলের সংকট দূর করতে আট হাজার কর্মী নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।

অভিনেত্রী মৌসুমী বলেন, বুঝে না-বুঝে কম বয়সী ছেলেমেয়েরা নানা অঘটনের শিকার হয়। কম বয়সী মেয়ে যখন দুই-তিন সন্তানের মা হয়ে যায়, তখন সে অসহায় হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনেক বড়। কোটি কোটি মানুষের সামনে পরিবার পরিকল্পনা ও মানবাধিকারের বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরতে হবে।

অধিকারের বিষয়টি ব্যাখ্যা করার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আমিনুল হক বলেন, ‘আমি আমার পরিবার নিয়ে যে পরিকল্পনা করি—কখন সন্তান নেব, কীভাবে তাকে বড় করে তুলব, কোথায় তার শিক্ষা হবে—নিজের এই পরিকল্পনা যদি দেশের সব মানুষের জন্য করি, তাহলেই কর্মসূচি সফল হবে।’ তিনি বলেন, অনেক মানুষ এখন সচেতন। পিছিয়ে পড়া বা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ১০০ ভাগ দম্পতির কাছে এই সেবা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

তিন ঘণ্টার এই গোলটেবিল বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর উপদেষ্টা গওহার নঈম ওয়ারা।

গোলটেবিলে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (আইইএম) আশরাফুন্নেসা বলেন, জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ কিশোর-কিশোরী। দেশের কিশোরী মায়েদের সংখ্যা যেমন কমানো দরকার, পাশাপাশি এদের জন্য পরিকল্পনা থাকা দরকার।

দেশে আইইউডি ও ইমপ্লান্ট সরবরাহে কিছু সমস্যা আছে উল্লেখ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এফপি ২০২০-এর ফোকাল পারসন আবু জামিল ফয়সাল বলেন, এই দুটি সামগ্রী বিদেশ থেকে আনতে হয়। এর সরবরাহের ব্যাপারে সরকারের আরও মনোযোগী হতে হবে।

অনুষ্ঠানে ঢাকা নার্সিং কলেজের দুজন ছাত্রী অংশ নেন। তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী আসমা আকতার বলেন, পরিবার পরিকল্পনা মানে শুধু জন্মনিয়ন্ত্রণ নয়। মানুষকে বোঝাতে বা পদ্ধতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে মিডওয়াইফরা বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেরাকের সহযোগী কর্মসূচি ব্যবস্থাপক তাসনিয়া আহমেদ বলেন, কর্মসূচি সফল করতে হলে পুরুষদের অংশগ্রহণ সমানভাবে জরুরি। অন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পপুলেশন কাউন্সিলের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক মাসুমা বিল্লাহ বলেন, আর্থসামাজিক কারণে এখনো বাল্যবিবাহ হচ্ছে। বেশি বয়সে বিয়ে হলে যৌতুকও বেশি দিতে হয়। বিয়ে হওয়া কিশোরীরা প্রসব-পূর্ব ও প্রসব-পরবর্তী সেবাও কম পায়।