কোন্দল-বিরোধ আছে দুই দলেই

বৃহস্পতিবার দুপুরে সহকর্মী সাইয়াম রহমানকে নিয়ে যখন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাই, দেখি মূল ভবনের সামনে কয়েক শ শিক্ষার্থী বিক্ষোভ করছেন। সেমিস্টার ফি কমানোসহ ২২ দফা দাবিতে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিল সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ। সাংবাদিক বন্ধুদের কেউ কেউ জানান, সাধারণ শিক্ষার্থীরা যাতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগ দিতে না পারে সে জন্য ২২ দফাকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক জানান, ২২ দফার ৯৮ শতাংশ অনেক আগেই মেনে নেওয়া হয়েছে। এরপরও আন্দোলন করাটা অযৌক্তিক। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার মতে, এই আন্দোলনের পেছনে স্থানীয় রাজনীতি আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে শনিবার দক্ষিণাঞ্চলের শিল্প সম্ভাবনা নিয়ে যে সেমিনারের আয়োজন করা হয়, তাতে প্রধান অতিথি ছিলেন শিল্পমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু। মূলত সেমিনারটি বাধাগ্রস্ত করতে ছাত্রদের একাংশকে মাঠে নামানো হয়েছে। এলাকার উন্নয়ন নিয়ে যে সেমিনার, তাতেও রাজনীতি ঢুকে গেছে!

বরিশালে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কর্তৃত্বের লড়াই অনেক দিনের। স্বাধীনতার পর এখানে নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। পঁচাত্তরে বিতর্কিত ভূমিকার কারণে তিনি দল থেকে বহিষ্কৃত হন। এরপর স্থানীয়ভাবে বড় কোনো নেতা আসেননি। ১৯৭৩ সালের পর ২০০৮ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এই আসন থেকে জয়ীও হতে পারেনি। ২০১৪–এর নির্বাচনে সাবেক মেয়র শওকত হোসেনের স্ত্রী জেবুন্নেসা আফরোজ মনোনয়ন নিয়ে জয়ী হলেও স্থানীয় রাজনীতিতে তাঁর তেমন প্রভাব নেই।

বরিশালের রাজনীতিতে একসময় শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর ব্যাপক প্রভাব–প্রতিপত্তি ছিল। সাবেক মেয়র শওকত হোসেনসহ অনেকেই ছিলেন তাঁর অনুসারী। কিন্তু সাবেক চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এলাকার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পর আমুর অনুসারীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। বর্তমানে হাসানাত আবদুল্লাহ বরিশালের রাজনীতিতে ‘সর্বময়’ ক্ষমতার অধিকারী। জেলার ছয়টি সংসদীয় আসনের পৌর মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যানরা তাঁর অনুসারী। হাসানাত আবদুল্লাহ জেলা কমিটির সভাপতি, স্ত্রী সাহান আরা সহসভাপতি এবং পুত্র সাদিক আবদুল্লাহ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, যিনি এবার মেয়র পদপ্রার্থী হয়েছেন। হাসানাত আবদুল্লাহ নির্বাচনী এলাকা আগৈলঝাড়া থাকলেও এককভাবে শহরের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন।

প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ একেবারে সুনসান। কিন্তু ভেতরে ভেতরে চাপান–উতোর আছে। আমরা যেদিন বরিশাল পৌঁছাই সেদিনই সব স্থানীয় পত্রিকায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ খবর বের হয়। বরিশাল-৪ আসনের সাংসদ পঙ্কজ দেবনাথের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে সংবাদ সম্মেলন করেন মেহেন্দীগঞ্জের কাজীর হাট থানা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সঞ্জয় চন্দ্র। তাঁর দাবি, সাংসদের অনুসারী ৪১ ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন আইনে মামলা করায় তাঁকে দুবার হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। পত্রিকায় তাঁর ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতের ছবিও ছাপা হয়েছে। তবে সাংসদ দেবনাথ এই অভিযোগ অস্বীকার করে করে বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে একটি মহল তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এ ঘটনার সঙ্গে বরিশাল আওয়ামী লীগের শিবির বিভাজনের যোগসূত্র আছে বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। পঙ্কজ দেবনাথ আমুর অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন সাতজন। দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হা্সিনা তাঁদের সবাইকে ঢাকায় ডেকে নিয়েছিলেন। অন্যান্য স্থানের মনোনয়নের ক্ষেত্রে যেমনটি হয়ে থাকে, এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দল যঁাকেই মনোনয়ন দিক তাঁর পক্ষে সবাইকে কাজ করতে হবে। সেদিন মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে যাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গিয়েছিলেন তাঁদের একজন এই নিবন্ধকারকে বলেছেন, সেখানে অন্য কারও কথা বলার সুযোগ ছিল না। প্রধানমন্ত্রী প্রার্থীর নাম ঘোষণার পর মনোনয়নপ্রত্যাশীদের একজন হাসিমুখে এবং বাকি ছয়জন মনোবেদনা নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। জেলা কমিটির অন্যতম সহসভাপতি জাহিদ ফারুকের অনুসারীরা মনে করেন, জাহিদেরই মনোনয়ন পাওয়া উচিত ছিল। ২০০৮ সালে তিনি দলের টিকিটে নির্বাচন করে জিততে না পারলেও রেকর্ড সংখ্যক ভোট পেয়েছিলেন। মনোনয়ন নিয়ে দলে বিরোধ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে হাসানাতের অনুসারী এক নেতা বলেন, দলে নেতা-কর্মীদের মধ্যে মতভেদ থাকতে পারে। কিন্তু মেয়র নির্বাচনে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। কেননা এটি শুধু নির্বাচন নয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এই যুদ্ধে আওয়ামী লীগকে জয়ী হতেই হবে। দলের সবাই সেই লক্ষ্যেই কাজ করবেন।

অন্যদিকে বিএনপিতে আহসান হাবিব কামাল ও মজিবর রহমান সরোয়ারের বিরোধ অনেক পুরোনো। তঁাদের অনুসারীদের মধ্যে বহুবার মারামারিও হয়েছে। দলের কর্মসূচিও তাঁরা একসঙ্গে পালন করতেন না। ২০১৩ সালে মেয়র হওয়ার পর আহসান হাবিব দলীয় পদ ছেড়ে দিলে সরোয়ারের অবস্থান সুদৃঢ় হয়। তিনি একই সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব, জেলা কমিটির সভাপতি এবং জেলা শ্রমিক দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর স্ত্রী নাসিমা সারোয়ার জেলা কমিটির এক নম্বর সদস্য। অর্থাৎ বরিশালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলেই পরিবারতন্ত্র কায়েম হয়েছে।

মেয়র নির্বাচনে সারোয়ারের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন দুজন—বর্তমান মেয়র আহসান হাবিব ও সাবেক সাংসদ বিলকিস জাহান শিরীন। শিরীন দলীয় চেয়ারপারসনের কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত। তাঁর অনুসারীদের দাবি, ‘ম্যাডাম বাইরে থাকলে তিনিই মনোনয়ন পেতেন।’ অন্যদিকে আহসান হাবিবের অনুসারীরা মনে করেন, সিলেট ও রাজশাহীতে যেখানে বর্তমান মেয়রদ্বয় মনোনয়ন পেয়েছেন, সেখানে তাঁকে না দেওয়াটা অন্যায় হয়েছে। দলের দুঃসময়ে তিনিই সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন কিনা সাংবাদিকেরা জানতে চাইলে আহসান হাবিব কৌশলী উত্তর দেন, ‘মেয়র হিসেবে আমি নির্বাচনী প্রচার চালাতে পারি না।’ আপনার অনুসারীরা কী করবেন? তিনি জবাব দেন, ‘তাঁরা যেভাবে পারেন কাজ করবেন।’

বরিশালের নাগরিক সমাজের নেতাদের মতে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। তারা মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে কিন্তু নিজেরা তা মানে না। কোনো দলেই তৃণমূল থেকে প্রার্থীর নাম সুপারিশ করা হয় না। ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়। দলে নতুন নেতৃত্ব তৈরি না হওয়ায় একই নেতা বছরের পর বছর পদ দখল করে থাকেন।

তবে তাঁরা এ–ও স্বীকার করেন, বরিশালে অনেক মেয়র এসেছেন, গেছেন। কিন্তু শওকত হোসেনের সময়ে শহরের যে উন্নয়ন হয়েছে, আর কারও সময়ে তা হয়নি। বরিশালবাসী চান, এবারও যিনি নির্বাচিত হবেন তিনি দলের ঊর্ধ্বে থেকে শহরের উন্নয়নে কাজ করবেন।
আগামীকাল: ‘বরিশাল হবে সিঙ্গাপুর’

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]