শিক্ষকেরা বারবার রাস্তায় কেন?

জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনশনরত শিক্ষকেরা
জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনশনরত শিক্ষকেরা

একদিকে যখন বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগ ও পুলিশের যৌথ নির্যাতনে ক্ষতবিক্ষত, অন্যদিকে তখন স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার অনাহারী শিক্ষকেরা অনশন করছেন ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষক-দুজনেরই দাবি ন্যায্য কিন্তু সরকার গ্রহণ করেছে বৈরী পথ। শিক্ষার্থীদের জন্য নির্যাতন ও অপপ্রচার এবং শিক্ষকদের জন্য উপেক্ষা ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ।

১৪ দিন ধরে ঢাকা শহরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কয়েক শ শিক্ষক আমরণ অনশনে আছেন, না খেয়ে রোদ-বৃষ্টিতে রাস্তায় পড়ে আছেন। বহু বছরের খুবই যুক্তিসংগত দাবি নিয়ে তাঁদের এই কর্মসূচি। বহুবার তাঁরা ঢাকায় এসেছেন, বহুবার সরকারের প্রতিশ্রুতি পেয়ে সরল বিশ্বাসে তাঁরা ফিরে গেছেন কাজে। কিন্তু বারবারই সরকার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। গত ২৫ জুন এই শিক্ষকেরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনশন কর্মসূচি শুরু করেন। এই কর্মসূচি চলাকালে নন-এমপিও এডুকেশনাল ইনস্টিটিউশন টিচার্স অ্যান্ড এমপ্লয়িজ ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মোহাম্মদ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘২০০৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত এই দাবি নিয়ে আমরা ২৮ বার ঢাকা শহরে এসেছি।’ (নিউ এজ, জুলাই ৫,২০১৮)

এই শিক্ষকেরা ২০১৩ সালে যখন এসেছিলেন, তখন পুলিশের লাঠি, স্প্রে, মরিচের গুঁড়া-সবই প্রয়োগ করা হয়েছে তাঁদের ওপর। সেবারও শিক্ষামন্ত্রী তিন মাসের মধ্যে সব দাবি মেনে নেবেন বলেছিলেন, সেই আশা নিয়ে শিক্ষকেরা আবার ক্লাসে ফিরেছিলেন, কিন্তু সেই দাবি পূরণ হয়নি। এরপরও তিনবার এসে রাস্তায় বসেছেন তাঁরা। সর্বশেষ এ বছরই ৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে প্রতিশ্রুতি পেয়ে তাঁরা কাজে ফিরেছিলেন।

শিক্ষকদের দাবি একটাই-সরকারের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এমপিও বা মান্থলি পে অর্ডার ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তি। যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সরকারি স্বীকৃতি পেতে প্রথমেই ১৩-১৪টি শর্ত পূরণ করতে হয়। নিয়মিতভাবে পর্যালোচনা করে নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিও কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করার কাজ ২০০৪ সাল পর্যন্ত ঠিকমতোই চলেছে বলে শিক্ষকনেতারা মনে করেন। এরপর থেকে এটি বন্ধ হয়ে যায়। ২০১০ সাল পর্যন্ত শিক্ষক প্রতিনিধিরা বহুবার সরকারের উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ করেছেন। এই সময়কালের তিন সরকার থেকে প্রতিবারই অভিন্ন কথা বলা হয়েছে, ‘সরকারের টাকা নেই’। আন্দোলনের মুখে ২০১০ সালে প্রায় দেড় হাজার প্রতিষ্ঠান এমপিওতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, কিন্তু বেশির ভাগই ছিল রাজনৈতিক প্রভাবে। এরপর থেকে তা আবারও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন ৫ হাজার ২৪২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৮০ হাজার শিক্ষক এই সুবিধার বাইরে, অথচ প্রায় ২৫ লাখ শিক্ষার্থীকে তাঁরা পড়িয়ে যাচ্ছেন। সরকার আন্দোলনের এই পর্যায়ে ১ হাজার প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করার কথা তুলছে। শিক্ষকেরা যথার্থই বলছেন, এতে আবারও রাজনৈতিক প্রভাব আর দেনদরবারের শিকার হবেন তাঁরা। তাঁরা সবগুলো প্রতিষ্ঠানই এমপিওর আওতাভুক্ত করার দাবিতে অনড়। বলেছেন, টাকার অভাব থাকলে বরং ধাপে ধাপে টাকা দেওয়া হোক, কিন্তু সব প্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গেই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

কয়েক বছর আগেও একই দাবি নিয়ে এ রকমই অনশনে বসেছিলেন শিক্ষকেরা। সে সময় আমি এক লেখায় লিখেছিলাম, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় যে ভবনে, সেই সচিবালয়ের পাশের ফুটপাতেই ১১ দিন ধরে দিনরাত কাটাচ্ছেন আট হাজারেরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ১ লাখ শিক্ষকের প্রতিনিধি কয়েক শ মানুষ, যুবক-বৃদ্ধ নারী-পুরুষ। তাঁরা শিক্ষক। স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার। তাঁদের প্রতিষ্ঠান সরকারের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত, সরকার তাঁদের দিয়ে নির্বাচন, শুমারি, নানাবিধ জরিপ-সবই করায়। এখানে নিয়মিত ক্লাস হয়; পিইসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি সব পরীক্ষা হয়।...কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এত সব দায়িত্ব পালন করার পরও মাসের পর মাস বছরের পর বছর সরকারের কাছ থেকে তাঁদের বেতন আসে না। আসে না বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতা। এগুলো ছাড়াই এই শিক্ষকেরা ক্লাস নিতে থাকেন, অন্য সব কাজ করেন বছরের পর বছর। কীভাবে সম্ভব?’ (প্রথম আলো, নভেম্বর ১৩,২০১৫)

শিক্ষকদের কাছে তখনো শুনেছি, এবারও শুনলাম বেতন-ভাতা বন্ধ থাকায় কেউ দোকান নিয়েছেন, কেউ দিনমজুরির কাজ নিয়েছেন, রিকশা চালানোর ঘটনাও আছে। আর আছে ঋণের বোঝা। এমনিতেই শিক্ষকদের বেতন, সুযোগ-সুবিধা বিশ্বের অন্য সব দেশের তুলনায় কম। আর তাঁদের মধ্যেও নিরাশ্রয় এই বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষকেরা। কয়েক শ কোটি টাকা হলে সব শিক্ষকের ন্যূনতম দাবি পূরণ হয়, সরকার তাঁদের শ্রম নেবে কিন্তু বেতন দেবে না, কারণ ‘সরকারের টাকা নেই’! বটেই তো, কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট হলে যদি অর্থমন্ত্রী বলেন ‘এটা কোনো ব্যাপারই না’, তিনি কেমন করে বহু লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষকদের পাওনা কয়েক শ কোটি টাকা খুঁজে পাবেন!

সরকারি এবং এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অবস্থাও যে খুব সম্মানজনক, তা নয়। কম হলেও বেতন তাঁরা পান কিন্তু তবে অবসর গ্রহণের পর তাঁদের প্রাপ্য পেতে আয়ু কমে যায়। তাঁদেরই টাকা তহবিলে জমা হয়, অথচ সরকার এখানেও বলে ‘টাকা নেই’। মাসের পর মাস বছরের পর বছর শিক্ষকেরা ঘুরতে থাকেন, আমলা-কর্মচারীরা তাঁদের ভিক্ষুক গণ্য করেন, দূর দূর করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিক্ষামন্ত্রী বলেন, শিক্ষকদের মর্যাদা সবার ওপরে। কিন্তু শিক্ষকদের পাওনা টাকা দেওয়ার ব্যাপারে তাঁদের কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। শিক্ষকদের ভিক্ষুক বানানোর চেষ্টা সরকারের অবিরাম। নন-এমপিও শিক্ষকদের অবস্থা একেবারে সর্বনিম্ন।

সরকারের নিজের টাকা বলে তো কিছু নেই, সবই তো জনগণের টাকা। জনগণের স্বার্থে, বিশেষত শিক্ষার কাজে সরকার জনগণের টাকা খরচ করবে না কেন? নিজেদের বিলাসিতা আর কিছু গোষ্ঠীর বিত্ত গঠনে কেন জনগণের টাকা শেষ হবে? এর আগেও শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, শিক্ষা বাজেট বাড়ানো ছাড়া এমপিও ব্যবস্থায় নতুন প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয়। কেন বাড়ানো হবে না? জাতিসংঘের সুপারিশ অনুসারে বাংলাদেশে শিক্ষা বাজেট যত হওয়ার কথা, বাস্তবে হচ্ছে তার তিন ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ শিক্ষা বাজেট কয়েক গুণ বৃদ্ধি খুবই যৌক্তিক। অথচ এ বছর অনুপাত আরও কমেছে। বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে ব্যয় অনুপাত বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে নিচের সারিতে, ১৬১টি দেশের মধ্যে ১৫৫ তম, দক্ষিণ এশিয়ায় নিম্নতম। এমপিওভুক্তির বাজেট যোগ করলেও তা অনেক নিচেই থাকবে। অর্থমন্ত্রী আগ বাড়িয়ে বলছেন, পুরো এমপিও ব্যবস্থাই রাবিশ! কে দায়ী এর জন্য? নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গঠন ও অনুমোদন-এগুলো কি শিক্ষকেরা করেন?

আমরা দেখি, হাজার হাজার কোটি টাকা অদৃশ্য করে দেয় ব্যাংক খাতের দুর্বৃত্তরা, তাদের সেই টাকা আবার জনগণের টাকা থেকে ভর্তুকি দেওয়া হয়। ফ্লাইওভার, সেতু, বিদ্যুৎ প্রকল্পে গত কয়েক বছরে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রতিবছর দেশ থেকে পাচার হচ্ছে কম হিসেবে ৭০ থেকে ৯০ হাজার কোটি টাকা। ঋণখেলাপি ও বিলুপ্ত ঋণে চলে গেছে লাখো কোটি টাকার বেশি। অথচ সেই কারণেই জনস্বার্থের কাজে, শিক্ষা ও চিকিৎসার কাজে, শিক্ষকদের দাবি ও পাওনা পরিশোধে কয়েক শ কোটি টাকার সংস্থান হয় না। বরাদ্দের ধরনে দুর্বৃত্ত-তোষণ আর জনবঞ্চনার চিত্রই স্পষ্ট হয়।

অনশনে বসা অনাহারী শিক্ষকদের দাবি আপাতদৃষ্টিতে নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হলেও তা শিক্ষা খাতকে বৈষম্য ও নৈরাজ্য থেকে উদ্ধারের লক্ষ্যকেই হাজির করে। সব নাগরিকের শিক্ষা যে রাষ্ট্রের দায়িত্ব, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যে রাষ্ট্রের দায়িত্বেই পরিচালিত হওয়া উচিত, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ নয়, সর্বজন শিক্ষাব্যবস্থার বিকাশই যে একমাত্র করণীয়, সেই তাগিদই উপস্থিত হচ্ছে তাঁদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।

আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক
[email protected]