উপাচার্যগণ কহেন!

ঢাবির উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান (বাঁয়ে) ও রাবির উপাচার্য আবদুস সোবহান
ঢাবির উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান (বাঁয়ে) ও রাবির উপাচার্য আবদুস সোবহান

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে যে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে আসছে, তাঁদের সম্পর্কে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা নানা ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন, এখনো করছেন। এর মধ্যে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের গন্ধ খুঁজছেন। আমাদের ক্ষমতার রাজনীতির যে সংস্কৃতি, তাতে এসব মন্তব্য ও আচরণ আমাদের মোটেই বিস্মিত করে না। আজ যাঁরা আন্দোলনকারীদের ন্যায্য দাবির প্রতি বৈরী মনোভাব দেখাচ্ছেন, ক্ষমতার পালাবদল হলে তাঁরাই তাঁদের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানাতে দ্বিধা করবেন না। আবার আজ যারা নৈতিক সমর্থন দিয়ে প্রতিদিন বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন, ক্ষমতায় গেলে হয়তো উল্টো সুর ধরবেন।

বাংলাদেশে সত্য ও ন্যায় নিরূপিত হয় ক্ষমতার নিরিখে।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে যে আন্দোলন করছেন, সরকার মুখে স্বীকার না করলেও তার ন্যায্যতা মেনে নিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি কাজও শুরু করেছে। এখানেই ঘটনা থেমে যেতে পারত। কিন্তু যায়নি তার কারণ মন্ত্রীদের সংস্কার আতঙ্ক এবং সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের শক্তিপ্রয়োগের মহড়া। মানুষ তখনই শক্তি প্রয়োগ করে, যখন যুক্তি ও বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। তবে ছাত্রলীগের এই আচরণেও আমরা খুব অবাক হচ্ছি না এ কারণে যে তারা তাদের ‘ঐতিহ্য’ রক্ষা করে চলেছে।

আমরা অবাক হয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনের নিন্দনীয় ও কাপুরুষোচিত ভূমিকায়। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুস সোবহান যেসব মন্তব্য করেছেন, তা গিনেস বুকে লিখে রাখার মতো। পৃথিবীর আর কোনো দেশে নিজের শিক্ষার্থীদের এভাবে তথ্যপ্রমাণ ছাড়া জঙ্গি আখ্যায়িত করার নজির আছে বলে জানা নেই।

তাঁরা শুধু উপাচার্য নন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও। ক্যাম্পাসে যখন ছাত্রলীগ নামধারীরা কোটা সংস্কারের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আহত ও রক্তাক্ত করেছে, হাতুড়ি দিয়ে পা ভেঙে দিয়েছে, তখন উপাচার্যদ্বয় আক্রান্তদের পাশে না থেকে আক্রমণকারীদের পক্ষ নিয়েছেন। যথার্থ অভিভাবকই বটে।

আখতারুজ্জামান বলেছেন, তিনি আন্দোলনকারীদের মধ্যে জঙ্গিদের ছায়া দেখেছেন। জঙ্গি নেতা ওসামা বিন লাদেন ও মোল্লা ওমর যেমন গুপ্ত স্থান থেকে ভিডিও বার্তা পাঠিয়েছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারাও না কি সেভাবে ভিডিও বার্তা পাঠিয়ে আন্দোলনকারীদের উসকে দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁর জানার কথা এটি সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, কাউকে উসকে দিতে হয় না।

আর আবদুস সোবহানের মন্তব্যটি আরও নিষ্ঠুর। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যখন তরিকুল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থী যখন ছাত্রলীগের হাতুড়ি অভিযান পা ভেঙে যাওয়ার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল, তখন তিনি তাঁর চিকি’সার ব্যবস্থা না করে আন্দোলনকারীদের ‘বাম ঘরানার শিবির’ বলে আখ্যায়িত করলেন। তিনি বা তাঁর প্রশাসনের কেউ আহত শিক্ষার্থীদের দেখতে যাননি। এমনকি যখন তরিকুলকে রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা শেষ না করেই বের করে দিল, তখনো এই উপাচার্যের চৈতন্যোদয় হলো না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাড়িতে হামলার ঘটনাটি নিন্দনীয়। কিন্তু কারা এই হামলা চালিয়েছে তদন্তকারী পুলিশ এখনো বের করতে পারেনি। তারপরও উপাচার্য মহোদয় অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে জঙ্গি ছায়া খুঁজে বের করেছেন। কিন্তু যারা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর যাঁরা চড়াও হলেন, পিটিয়ে রক্তাক্ত ও আহত করলেন, তাঁদের সম্পর্কে তিনি একটি কথাও বলেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরও ‘ হামলার কথা শোনেননি, কেউ তাঁর কাছে অভিযোগ করেননি’ বলে যে মন্তব্য করেছেন, সেটিও নির্দয় বলে মনে হয়।

বাংলা ভাষায় একটি নতুন শব্দ সংযোজন করেছেন বলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে ধন্যবাদ জানাই। শব্দটি হলো বাশি( বা্ম ঘরানার শিবির)। কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তাঁর জানার কথা যে এই বাম ঘরানার ছাত্ররাই সেখান থেকে শিবির তাড়িয়েছিল। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত ‘ডান ঘরানার’ ছাত্রলীগ সাংগঠনিকভাবে খুবই দুর্বল ছিল। এখন তারা অবশ্য শাবল-হাতুড়ি নিয়ে সবল হওয়ার চেষ্টা করছেন এবং উপাচার্য মহোদয় পেছন থেকে তাদের শক্তিমান করার সব রকম সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন।

অধ্যাপক সোবহান আন্দোলনকারীদের বাম ঘরানার শিবির বলেছেন, যারা ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নামধারীদের হাতে মার খাচ্ছেন। যারা তাদের ওপর হামলা চালাচ্ছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই ডান ঘরানার শিবির। মৌলবাদী ইসলামি ছাত্র শিবিরের সঙ্গে বামদের কোনো সম্পর্ক নেই। আগেও ছিল না।

রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি কথা বেশ চাউর আছে যে ছাত্রদল ও শিবিরের কর্মীরা নাকি ছাত্রলীগে ঢুকে নানা অপকর্ম করছেন। শহীদ মিনারে আন্দোলনকারীদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগপন্থী একজন বুদ্ধিজীবী জোর দিয়ে বললেন, ছাত্রলীগের কেউ এই হামলা চালাতে পারেন না। তাহলে ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারীরা যদি এই হামলা করে তাকে তাদের ডান ঘরানার শিবির হিসেবে আখ্যায়িত করাই সঠিক হবে।

উপাচার্য মহোদয় আন্দোলনকারীদের মধ্যে ‘বাম ঘরানার মধ্যে শিবির আবিষ্কার করলেও ছাত্রলীগ যে মিছিল ঠেকাতে গিয়ে হাতুড়ি দিয়ে শিক্ষার্থীর পা ভেঙে দিল, সেটি তাঁর চোখে পড়ল না।

দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মন্তব্য শুনে বা বিবৃতি পড়ে এটাই ধারণা হয় যে, তাঁরা আর যাই হোক, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণ করেন না। এটি নিয়ন্ত্রণ করে অধ্যাপক সোবহানের ভাষায় ‘ডান ঘরানার শিবির।’ কেননা আচার্য উপাচার্যদের নিয়োগকর্তা হলেও তাদের চাকরির স্থায়িত্ব নির্ভর করে সরকার সমর্থক ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের তুষ্ট রাখার ওপর। ছাত্রলীগের প্রতিরোধের মুখে অনেক উপাচার্যকে মেয়াদের আগেই বিদায় নিতে হয়েছে।

রাষ্ট্রাচারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদটি কত নম্বরে আছেন, মানুষ সেই হিসাব না করেও পদাধিকারীদের অনেক বেশি সমীহর চোখে দেখেন। পৃথিবীর সব দেশেই কৃতীমানেরা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে আসীন হয়ে থাকেন। বাংলাদেশেও বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, অধ্যাপক আবুল ফজল,মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী, আবুদল হালিম চৌধুরী ও জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী মতো বরেণ্য ব্যক্তিরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন।

কিন্তু সেই সম্মানের পদটিকে বর্তমানের পদাধিকারীরা কত নিচে নামিয়ে এনেছেন! এদের হাতে শিক্ষা ও শিক্ষার্থী কোনোটাই নিরাপদ নন।