দিল্লির দরবারে ঢাকার ইমাম

ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, দিল্লির লাড্ডু-খেলেও পস্তায়, না খেলেও পস্তায়। যে মহাজন এ প্রবচনটি চালু করেছিলেন, তিনি এর গূঢ়তত্ত্ব ফাঁস করেননি। এখানে মুখ্য কে বা কী, দিল্লি না লাড্ডু। সে যা-ই হোক, বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বে দিল্লি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একে এড়িয়ে গিয়ে বা উপেক্ষা করে বেশি দূর যাওয়া যায় না, বেশি দিন থাকা যায় না।

তো দিল্লির দরবারে আমাদের রাজনীতিবিদদের যাওয়া-আসা কোনো নতুন বিষয় নয়। সামনে নির্বাচন। এ সময় এ ধরনের সফরের অন্য মাজেজা আছে। এটা অস্বীকার করার জো নেই, এ দেশের রাজনীতি অনেকাংশেই ভারতকেন্দ্রিক। ভারত রাষ্ট্রের মূল দরবারটি দিল্লিতে। সেখানে নজরানা দিয়ে অতীতে অনেকেই সুবে বাংলা শাসন করেছেন। দিল্লিকে অখুশি করে বাংলার অনেক শাসক গদিও হারিয়েছেন।

এরপর পদ্মা-মেঘনা-যমুনা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। মাঝখানে ব্রিটিশ আর পাকিস্তানের জমানা পেরিয়ে আমরা নিজেরাই হলাম বাংলা মুলুকের হর্তাকর্তা-বিধাতা। আমরা স্বাধীন, আমাদের একটি সার্বভৌম সংসদ আছে, আছে একটি সংবিধান। তারপরও মনে হয় দিল্লির সঙ্গে রয়ে গেছে এক অদৃশ্য সুতোর টান। আমরা যেন বাংলার আকাশে উড়ছি ঘুড়ির মতো। নাটাইটা যেন দিল্লিতে। সেখানে টান পড়লে গোঁত্তা খেয়ে আমাদের ঘুড়ি পড়বে মাটিতে। নাটাই হাতে আরও অনেকেই আশপাশে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। তাদের ঘুড়ির লড়াইয়ের প্যাঁচে পড়ে সুতো ছিঁড়ে আমরা হাওয়ায় উড়েও যেতে পারি। একেবারে ভোঁ-কাট্টা। পণ্ডিতেরা এর নাম দিয়েছেন জিও-পলিটিকস। এখানে আমরা দাবার বোর্ড।

ভারত আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই বন্ধুত্ব নবজীবন পেয়েছিল। সম্পর্কের বৃহস্পতি ছিল তুঙ্গে। ওই সময় লেখক-সাংবাদিক আবু জাফর শামসুদ্দিনের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘ইচ্ছে হয় এখনই মরে যাই।’ তাজউদ্দীনের মনে হয়েছিল, এ-সম্পর্ক বেশি দিন ভালো থাকবে না। খারাপ সময়টা তিনি দেখে যেতে চান না। আবু জাফর শামসুদ্দিন তাঁর স্মৃতিকথায় এটা উল্লেখ করেছেন।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের পারদ বারবার ওঠানামা করেছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জটিল ও সূক্ষ্ম বিষয়গুলো আমরা অনেক সময় বিচার করি সুলতানি-বাদশাহি আমলের কিংবা পাকিস্তান আমলের চশমা দিয়ে। আমরা অনেকেই দিল্লীশ্বরের বন্দনা করি, যখন দিল্লির সিংহাসনে থাকেন ‘মুসলমান’ শাসক। ব্রিটিশ এসে দিল্লিকে আমাদের কাছে পর করে দিয়েছিল। পাকিস্তান আমলে ভারত তো রীতিমতো শত্রুরাষ্ট্র। মনে হয়েছিল, একাত্তরের পরে চালচিত্র বদলাবে। কিন্তু তা হয়নি। একধরনের ‘আইডেন্টিটি পলিটিকস’ চলছে এখানে-ওখানে। সম্প্রতি আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব এর আগে কখনো এত ভালো ছিল না। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর গলায় একই সুর, তারপরও দেখি ও শুনি, সম্পর্কের ছন্দপতন হচ্ছে, তাল কেটে যাচ্ছে, কথাবার্তা বেসুরো ঠেকছে।

এ দেশে অনেকেই অনেক দিন ধরে বলে আসছেন, দিল্লি ঢাকাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। আড়ালে-আবডালে কিংবা বক্তৃতা-প্রচারপত্রে দুই দেশেই অনেক বিষোদ্গার আছে। ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংয়ের দৌড়ঝাঁপ কোনো লুকানো ব্যাপার ছিল না। আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে একটা ধারণা বা বিশ্বাস মোটামুটি গেঁথে গেছে যে, দিল্লির মন না পেলে বাংলার মসনদ অধরাই থেকে যাবে। প্রচণ্ড ভারতবিরোধী দল হয়েও বিএনপির বোধোদয় হয়েছে, দিল্লিকে গালাগাল করার কৌশল এখন আর মুনাফা দেবে না। তার মন পেতে হবে, অথবা তাকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের আঁচলে বাঁধা পড়তে দেওয়া যাবে না। তখন থেকেই বিএনপির নেতারা দিল্লির দরবারে হাজিরা দিচ্ছেন। সম্প্রতি তাঁদের তিনজন নেতা দিল্লি ঘুরে এসে নানান কথাবার্তা বলেছেন। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা তাঁদের নিয়ে হাসি-মশকরা করতে ছাড়েননি। বিএনপির এই ‘অধঃপতন’ দেখে তাঁরা বিস্মিত।

দিল্লির সঙ্গে বিএনপির আগবাড়িয়ে মাখামাখি নিয়ে আওয়ামী লীগ কি উদ্বিগ্ন? কদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হোসেন তৌফিক ইমাম তিন দিনের সফরে দিল্লি গিয়েছিলেন। দেখা করেছেন ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবর এবং বিজেপি নেতা রাম মাধবের সঙ্গে। দিল্লির এক থিংক ট্যাংকের সভায় বক্তৃতাও দিয়েছেন। এর বাইরে তিনি আর কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন কি না, জানি না। তিনি বলেছেন, ‘ভারতের মন ভোলানোর হাজার চেষ্টা চালালেও বিএনপির নেতারা সফল হবেন না।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘যে দলের নেতা একজন দাগি অপরাধী। যিনি পুরোপুরি পাকিস্তানপন্থী, সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে এবং জামায়াত যাদের হাতের মুঠোয় পুরে গিয়েছে, সেই বিএনপিকে ভারত কোনো রকম সুযোগ দেবে না, দিতে পারে না (প্রথম আলো, ৮ জুলাই ২০১৮)।’

ইমাম সাহেবের কথায় স্পষ্ট যে তিনি কী বলতে চেয়েছেন। তার অর্থ হলো বিএনপি পাকিস্তানপন্থী দল এবং আওয়ামী লীগ ভারতের পরম বন্ধু। বোঝা যাচ্ছে, ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ের একটি ক্ষেত্র হচ্ছে বাংলাদেশ। আগামী সংসদ নির্বাচনকে উপলক্ষ করে এ লড়াই আরও প্রকাশ্য হবে বলে মনে হয়।

‘ভারত বিএনপিকে কোনো সুযোগ দেবে না’-এইচ টি ইমামের গলায় এই আত্মবিশ্বাস বা আশাবাদ শুনে ধারণা হতেই পারে যে কে সুযোগ পাবে আর কে পাবে না, তা অনেকটাই দিল্লির ওপর নির্ভর করে। কথাটি লুফে নিয়েছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি পাল্টা কামান দেগে বলেছেন, ‘ভারত সুযোগ দেওয়ার কে? বাংলাদেশের মালিক বাংলাদেশের জনগণ। সুযোগ দেবে বাংলাদেশের জনগণ।’ রিজভী যা-ই বলুন না কেন, জুনের প্রথম সপ্তাহে তাঁদের তিন নেতার দিল্লি সফর কিন্তু উল্টো বার্তা দেয়। বার্তাটি এই-জনগণ সবকিছুর নিয়ামক বা নিয়ন্ত্রক নন। দিল্লির একটি বিশেষ ভূমিকা আছে এখানে।

আওয়ামী লীগ-বিএনপির এ ধরনের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য নতুন নয়। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে, এটা বাড়বে। বাংলাদেশে পরবর্তী সরকার গঠনের আশা করছে দুটো দলই। উভয়ই এই যাত্রায় ভারতের সমর্থন, সহানুভূতি, আশীর্বাদ চায়। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ভূরাজনীতির এ লড়াই যত মুখ্যই হোক, আমাদের রাজনীতিবিদেরা অনেক সময় স্থূল ও বেফাঁস কথাবার্তা বলে ফেলেন।

বিএনপি দিল্লিকে একটা বার্তা দিতে চেয়েছে, ‘আমরা তোমাদের শত্রু নই।’ আওয়ামী লীগ তো বরাবরই বলে এসেছে, ‘আমি তোমাদেরই লোক।’ দুই দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাম্প্রতিক দিল্লি সফর আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতা ধরে রাখার বিষয়টি সম্ভবত শুধু ভোটের ওপর নির্ভর করে না।

অনেক আগে একটা কাওয়ালি শুনেছিলাম। তার একটি লাইন ছিল এ রকম, ‘কেউ ফেরে না খালি হাতে, খাজা তোমার দরবারে।’ খাজা বাবার স্মৃতিধন্য আজমিরে পুণ্যার্থীরা যান ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে, খাজা বাবার আশীর্বাদ পাওয়ার আশায়। দিল্লির দরবারে যুযুধান দুই দলের প্রতিনিধিরা যে আশা নিয়ে যাচ্ছেন, সেখানে শিকে ছিঁড়বে একজনের ভাগ্যেই। শেষ কথাটি বলার সময় হয়েছে কী? কিন্তু একটি কথা তো বলাই যায়। সব আকর্ষণ-বিকর্ষণ সত্ত্বেও দিল্লির লাড্ডু খুবই স্বাদু!

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
mohi [email protected]