ভারত ইস্যুতে অবস্থান বদলাচ্ছেন ট্রাম্প?

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প

স্বৈরাচার ক্ষমতায় এলে গণতন্ত্র যে টালমাটাল হয়, তা ডোনাল্ড ট্রাম্প গদিতে বসার পর ভালোভাবে টের পাওয়া গেছে। ট্রাম্প শুধু স্বৈরাচারীই নন, বরং সাম্রাজ্যবাদী চেহারা নিয়ে ক্রমেই আবির্ভূত হচ্ছেন। সবচেয়ে ক্ষমতাধর গণতান্ত্রিক দেশ আমেরিকার সঙ্গে সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের উষ্ণ সম্পর্কে আচমকা তিনি জটিল একটি প্যাঁচ বাঁধিয়ে দিয়েছেন।

সংবাদমাধ্যমগুলোর খবর অনুযায়ী, ট্রাম্প ভারতকে ইরানের কাছ থেকে তেল আমদানি বন্ধ করতে বলেছেন। জবাবে নয়াদিল্লি ওয়াশিংটনকে জানিয়ে দিয়েছে, ইরানের সঙ্গে ভারতের একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি আছে। এর আওতায় তারা ইরান থেকে তেল আমদানি করে। এই চুক্তির আওতায় ইরান বাজারদরের চেয়ে অনেক কম দামে ভারতের কাছে তেল সরবরাহ করে থাকে। আপাতত ট্রাম্পের কথা মেনে তেল আমদানি বন্ধ করা সম্ভব নয়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। নয়াদিল্লির জবাবের পর ওয়াশিংটন এই বৈঠক বাতিল করেছে। অবশ্য ওয়াশিংটন এখনো বলেনি যে ইরান থেকে তেল আমদানি বন্ধ না করার কারণেই বৈঠকটি বাতিল করা হয়েছে। মাইক পম্পেও ইতিমধ্যেই সুষমা স্বরাজকে ফোন করে ‘অনিবার্য কারণে’ বৈঠকটি বাতিল করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং যত দ্রুত সম্ভব দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বসার আশ্বাসও দিয়েছেন।

ট্রাম্পের পক্ষ থেকে আসা এ ধরনের চাপে ভারত স্পষ্টতই বিরক্ত। তবে ভারত মনে করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হলে এ-বিষয়ক মতভেদ দূর করে ফেলা সম্ভব হবে।

গত মাসে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি ভারতে এসে ভারতের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেখানে ইরান থেকে ভারতের তেল আমদানি নিয়ে তিনি একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। কিন্তু মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এটি পরিষ্কার করেই জানিয়ে দিচ্ছে ইরান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান বদলাবে না। ইরানকে একঘরে করতে ইউরোপের মিত্রদের সহায়তা চাওয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ার দেশ চীন, ভারত ও অন্য দেশগুলোরও সহায়তা চাইবে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আমেরিকার কর্মকর্তাদের এই ইস্যু নিয়ে দেনদরবার করতে এসব দেশে আসার কথা।

বেশ কয়েক বছর ধরে তেলনীতি নিয়ে ইরানের সঙ্গে ভারতের একটি স্থিতিশীল সম্পর্ক দাঁড়িয়েছে। দুই দেশই একটি দীর্ঘমেয়াদি অঙ্গীকারের জায়গায় থেকেছে। ইরান ভারতকে তেল দিচ্ছে, আর ভারত ইরানকে নানা ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দিয়ে আসছে। এর আগেও যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে। কিন্তু তার কারণে ইরানের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য সম্পর্কে টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়নি। এ অবস্থায়ই সব চলছিল। আচমকা ট্রাম্প গোল বাঁধিয়ে দিলেন।

তেল ও গ্যাস নিয়ে ইরান ও ভারতের মধ্যে যে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি আছে, সে অনুযায়ী ভারতের পক্ষে সেখান থেকে পিছিয়ে আসা একেবারেই অসম্ভব। প্রতিরক্ষা নিয়েও এই দুই দেশের মধ্যে চুক্তি আছে। সেই চুক্তিতে সামরিক প্রশিক্ষণ এবং পরস্পরের সমরাস্ত্র পরিদর্শনের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত আছে। চুক্তিতে বলা আছে, ভারত ও ইরান সহাবস্থানে থাকবে এবং তারা যৌথভাবে কোনো তৃতীয় দেশের বিরুদ্ধে যাবে না। বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য দেশ দুটি সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করবে বলেও চুক্তিতে বলা আছে। চুক্তি অনুযায়ী, ইরানের বন্দর ও রেল ব্যবস্থার উন্নয়নে ভারত সহায়তা করবে এবং ভারতের অবকাঠামো খাতে ইরান বিনিয়োগ করবে।

নয়াদিল্লিকে তার নিজের স্বার্থকেই আগে দেখতে হবে। ওয়াশিংটনের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখার জন্য ভারত ইতিমধ্যে ইরান থেকে আমদানি করা অনেক কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেটা যদি মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তাহলে দেশের জন্য ক্ষতি বয়ে আনবে। হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে মোদির প্রথম বৈঠকের পর তাঁরা যে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন, তাতে তাঁরা বলেছেন, সন্ত্রাস দমনের মতো কিছু বিষয়ে সব সময় তাঁরা এক হয়ে কাজ করবেন। পাকিস্তানের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে নীতি অনুসরণ করে আসছে, বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে তার উল্টো অবস্থানে চলে যেতে দেখা গেছে। সেখানে পাকিস্তানের কড়া সমালোচনা করা হয়েছে। এতে চীনের মহাসড়ক প্রকল্পেরও সমালোচনা এসেছে। ট্রাম্প মোদিকে ‘বিশ্বনেতা’ বলে অভিহিত করেছেন।

পাকিস্তানকে সহায়তা দেওয়ার নীতি থেকে ট্রাম্প সরে এসে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু ইরান ইস্যুতে ট্রাম্প অবস্থান পাল্টাচ্ছেন। যে মুহূর্তে চীন সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, সে মুহূর্তে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করা ভারতের জন্য ভালো হবে না। কিন্তু ট্রাম্পের অতিরিক্ত আবদার মানাও দিল্লির পক্ষে কঠিন। ফলে দিল্লি-ওয়াশিংটন সম্পর্ক যে একটি জটিল জায়গায় রয়েছে তা বলাই যায়।

ইংরেজি থেকে অনূদিত

কুলদীপ নায়ার ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট