বরিস জনসন যুক্তরাজ্যকে ধ্বংস করেছেন

বরিস জনসন
বরিস জনসন

গত তিন বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো বরিস জনসন ব্রিটিশ সরকারকে অস্থিতিশীল করলেন এবং দেশটির ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে ফেললেন। ব্রেক্সিট নিয়ে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের নতুন পরিকল্পনা নিয়ে বিরোধের জেরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ালেন তিনি। এখন কোনো ধরনের অর্থসংকট তৈরি করা ছাড়াই ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের জন্য থেরেসা মের কর্তৃত্ব ও সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এটা নিশ্চিত যে এ ঘটনা যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি করবে। ২০১৬ সালে ব্রেক্সিট প্রশ্নে গণভোটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে প্রচারের নেতৃত্বে ছিলেন বরিস জনসন। জনসন এবং তাঁর অনুগামীরা হচ্ছেন হার্ড ব্রেক্সিট বা কড়া ব্রেক্সিটপন্থী গ্রুপ, যাঁরা কিনা ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের প্রায় সম্পূর্ণ বিচ্ছেদের পক্ষে, যাতে ইউরোপে অবাধ অভিবাসন এবং যুক্তরাজ্যের ওপর ব্রাসেলসের কর্তৃত্ব বন্ধ হয়। আর একটি পক্ষ হচ্ছে সফট বা নরম ব্রেক্সিট গ্রুপ। এরা ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতার বিরোধী এবং তারা চায় ইইউতে থেকে যুক্তরাজ্য যে সুবিধাগুলো পায় সেগুলো অব্যাহত রাখতে। এখন থেরেসা মে ব্রেক্সিটের যে পরিকল্পনা দিয়েছেন তার সমালোচনা করে কড়া ব্রেক্সিটপন্থীরা বলছেন, এতে ইউরোপকে খুব সহজে অনেক বেশি ছাড় দেওয়া হয়েছে।

২০১৬ সালের শুরুতে বরিস জনসন সম্ভবত ব্রিটেনের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ ছিলেন। তাঁকে এক পলক দেখার জন্য সমর্থক-ভক্তরা ভিড় জমাতেন। জনমত যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এবং পণ্ডিতেরা মনে করতেন তিনি দেশের অনেক স্থানেই পৌঁছাতে পারেন, যেখানে কিনা অনেক কনজারভেটিভ নেতা যেতে পারেন না। কিন্তু দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য তিনি এতটাই বেপরোয়া হয়ে পড়েছিলেন যে তাঁর ডানপন্থী দল ইউরোস্কেপটিকের সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিষয়ে তাঁর আগের অবস্থান থেকে সরে আসেন।

বরিস জনসন বলতে থাকেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেলে যুক্তরাজ্য আরও ধনী এবং আরও স্বাধীন হবে। জাতীয় স্বাস্থ্যসেবায় আরও বেশি অর্থ বরাদ্দ করা সম্ভব হবে, অভিবাসীদের ওপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যাবে এবং ইউরোপের সঙ্গে মসৃণভাবে বাণিজ্য করা যাবে। তবে অনেকেই তখন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিল, ব্রেক্সিট কীভাবে যুক্তরাজ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরির ক্ষতি করবে। কিন্তু কড়া ব্রেক্সিটপন্থীরা এক ফুৎকারে তাদের কথা উড়িয়ে দেন। অপ্রত্যাশিতভাবে ব্রেক্সিটপন্থীদের জয় হলেও গত দুই বছরে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে থেকে শুরু করে বরিস জনসন কেউই যুক্তরাজ্য থেকে বেরিয়ে আসার এমন কোনো পরিকল্পনা দিতে পারেননি যা পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যকে বা জনগণকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছে। কেন পারেনি? কারণ হচ্ছে, ব্রেক্সিটের পক্ষে প্রচারণা চালানোর সময় বরিস জনসন এমন সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যেগুলোর বাস্তবায়ন অসম্ভব।

বরিস জনসনের ওই সব মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে ভোটাররা অধীর হয়ে একটি সহজ, সমৃদ্ধ ও উৎপাদনশীল যুক্তরাজ্যের স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু তাঁদের এ স্বপ্ন বোধ হয় স্বপ্নই থেকে যাবে। এসব মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়ার জন্য ভোটারদের কাছে ক্ষমা চাওয়া তো দূরের কথা, উল্টো বরিস জনসনসহ ব্রেক্সিটপন্থীরা তার বদলে অর্থহীন প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছিলেন। হার্ড ব্রেক্সিট সম্পর্কে সব নেতিবাচক ধারণা তাঁরা নস্যাৎ করে দেন। গত সপ্তাহে থেরেসা মে অবশেষে তাঁর বিভাজিত মন্ত্রিসভাকে একটা সমঝোতায় আসার জন্য ব্রেক্সিট নিয়ে একটি পরিকল্পনা পেশ করেন। তিনি আংশিক ব্রেক্সিটের প্রস্তাব দেন, যাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু শর্ত মেনে নেওয়ার বিনিময়ে ব্রিটিশ পণ্য ইউরোপের ভেতরে ও বাইরে বিনা মূল্যে প্রবেশের অনুমতি পায়।

এই পরিকল্পনা নিয়ে বিরোধের জেরে প্রথমে ব্রেক্সিটবিষয়ক মন্ত্রী ডেভিড ডেভিস ও পরে বরিস জনসন পদত্যাগ করেন। পদত্যাগ করাটা বরিস জনসনের একটি বেপরোয়া সিদ্ধান্ত, যিনি কিনা তাঁর সব বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন, তিন বছর আগে যা তার ছিল। বরিস জনসন হয়তো ভেবেছিলেন, এটা তাঁর সর্বশেষ সুযোগ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার। পদত্যাগের পর তিনি আশা করেছিলেন বিদ্রোহী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হবেন যিনি কিনা দলের নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু তিনি আরও একবার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলেন।

দুই বছর আগে বরিস জনসনের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার ফলে দেশ দুভাগ হয়ে যাচ্ছিল এবং সব ব্রিটিশ সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা কয়েক দশকের জন্য ঝুঁকির মুখে পড়তে যাচ্ছিল। আর তাঁর এখনকার পদক্ষেপও ভালো কোনো ফল বয়ে আনবে না বলেই মনে হচ্ছে, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের রাজনীতির ক্ষেত্রে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া

জেনি রাসেল ব্রিটিশ সাংবাদিক ও টাইমস অব লন্ডনের কলামিস্ট