ধর্ষণের শিকার নারীর 'মিথ্যা' অভিযোগ

যৌন সহিংসতামূলক অপরাধের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শুধু ভুক্তভোগীর একক সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে দোষী প্রমাণিত করতে কোনো আইনগত বাধা নেই, যদি আদালতের কাছে তাঁর সাক্ষ্য যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়। তবে বাস্তবে ধর্ষণের মামলাগুলোর ক্ষেত্রে খুব কমই এই নিয়মের প্রতিফলন দেখা যায়। এর একটি অন্যতম কারণ হলো সেই প্রচলিত ধারণা যে আইনের আশ্রয় চাওয়া একজন নারী যখন ধর্ষণের অভিযোগ করেন, অভিযোগটি সচরাচর মিথ্যা হয় বা নিরপরাধ ব্যক্তিকে হয়রানি করবার উদ্দেশ্যেই করা হয়। এই মিথ্যা মামলার সন্দেহটি অনেক সময়ই ধর্ষণের শিকার নারীর সাক্ষ্যটিকে দুর্বল করে দেয় এবং এর ফলস্বরূপ তাঁর ওপর ঘটনা প্রমাণের বোঝাটিও বহুগুণ বেড়ে যায়। তাঁকে অন্যান্য শক্ত সাক্ষ্য–প্রমাণ দিয়ে তাঁর সঙ্গে ঘটে যাওয়া অপরাধটিকে সত্য প্রমাণ করতে হয়। কিন্তু অনেক সময়ই দেখা যায়, একজন ভুক্তভোগী নারী অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হন এবং আসামি খালাস পেয়ে যান।

ধর্ষণের শিকার নারীর প্রতি এই বিশেষ অবিশ্বাস আর সন্দেহ কিন্তু সেই ঔপনিবেশিক আমলের বিচারিক প্রক্রিয়ারই একটি ধারাবাহিকতা, ঠিক যেমনটি ধর্ষণের সংজ্ঞা এখনো সেই সনাতনী ব্রিটিশ আমলেরই রয়ে গেছে। সতেরো শতকে ব্রিটিশ আইনবিদ ম্যাথিউ হেলের সময় ধর্ষণসংক্রান্ত ব্রিটিশ আইনে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়, যার সূচনা হয় কুখ্যাত ‘হেলস ওয়ার্নিং’ বা হেলের সতর্কবাণীর মাধ্যমে। ওই সতর্কবাণীতে স্পষ্ট করে বলা হয় যে একজন নারী যখন ধর্ষণের মামলা করেন, তখন শুধু তাঁর সাক্ষ্যের ওপর ভরসা করা খুবই বিপজ্জনক, কেননা ধর্ষণ এমন একটি অপরাধের অভিযোগ, যার মাধ্যমে একজন নারী খুব সহজেই একজন নির্দোষ ব্যক্তিকে ফাঁসিয়ে ফেলতে পারেন।

এই সাবধানবাণীর কারণেই ব্রিটিশ আদালতে দেখা যেত, একজন ধর্ষণের শিকার নারীর একক সাক্ষ্যকে আর কোনোভাবেই বিশ্বাস করা হয় না, যদি না তা অন্য প্রমাণাদি দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয়, অর্থাৎ আইনের ভাষায় যেটিকে বলা হয় করোবোরেশন। ব্রিটিশ আদালতে এই ধারণাই জেঁকে বসে যে একজন নারী মূলত মিথ্যা মামলাই সাজানোর চেষ্টা করেন—যখন তিনি ধর্ষণের অভিযোগ করেন এবং এ কারণেই শুরুর দিকে করোবোরেশন সম্পর্কে সাধারণভাবে আদালতে যে সাবধানতা অবলম্বন করা হতো, সেটিই একসময় রূপান্তরিত হয় বাধ্যতামূলক প্রথাতে, যার নড়চড় হলে ন্যায়বিচারের ব্যত্যয় ঘটেছে বলেই ধরে নেওয়া হয়। এই সাবধানতার নিয়মের চাপে ধর্ষণের শিকার একজন নারীর অভিযোগের সত্যতা প্রমাণের জন্য তাঁর ব্যক্তিগত যৌন সম্পর্ক ও আচরণ, ধর্ষণের সময় বাধা দেওয়া হয়েছিল কি না, এফআইআর করতে কতটা বিলম্ব হয়েছে ইত্যাদি বিষয় ব্রিটিশ আদালতে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হতো।

যদিও আধুনিক ফৌজদারি আইনগুলোতে এই ধরনের করোবোরেশনের প্রাসঙ্গিকতা প্রায় বিলুপ্ত বললেই চলে। কিন্তু উত্তর-ঔপনিবেশিক সময়ে এই উপমহাদেশে ধর্ষণের শিকার নারীর প্রতি অনাস্থা আর অবিশ্বাসের প্রথাটি অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। অবশ্য ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট সাম্প্রতিক কালে ধারাবাহিকভাবে ঔপনিবেশিক আদালতের এই বিশেষ সাবধানতা-সংবলিত করোবোরেশনের নিয়মটিকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। এমনকি বাংলাদেশের উচ্চ আদালতও কিছু ক্ষেত্রে এমন সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে যৌন অপরাধমূলক মামলার ক্ষেত্রে বাদীর একক সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করাতে কোনো বাধা নেই। তবে গত দশ থেকে বারো বছরে প্রকাশিত রায়গুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে কঠোর করোবোরেশনের প্রথা এখনো ধর্ষণের মামলাগুলোতে প্রাধান্য পায়।

বর্তমান প্রচলিত বিচারিক ব্যবস্থা এভাবে একজন ভুক্তভোগী নারীকে অনেক ক্ষেত্রেই একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির কাতারে ফেলে দেয়, যেখানে তাঁকেই সন্দেহাতীতভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তির দোষ প্রমাণ করতে হয়। ব্রিটিশ আমলের মতো তাই ধর্ষণের ঘটনায় বাদীর সম্মতি ছিল কি না, তা বাদীর ‘চরিত্র’, শরীরে জখমের চিহ্ন, বয়স, আর্থিক অবস্থা ইত্যাদি বাধাধরা বিষয় দ্বারাই প্রভাবিত হয়। এ ছাড়া অন্য প্রমাণাদি, যেমন দ্রুত এফআইআর দায়ের করা, ধর্ষণের শিকার নারীর ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্ট, নিরপেক্ষ সাক্ষী, পরিহিত কাপড়ের রাসায়নিক পরীক্ষা ইত্যাদি বিষয়কেও প্রাধান্য দেওয়া হয় একজন বাদীর সাক্ষ্যকে সত্য প্রমাণ করার জন্য।

ধর্ষণের মামলার রায়ের পর্যালোচনা থেকে আরেকটি বিষয় দেখা যায় যে একজন ধর্ষণের শিকার নারী যখন কিছু প্রচলিত ছাঁচে-ঢালা সংজ্ঞায় পড়েন না, তখন তাঁর সাক্ষ্যকে অন্যান্য প্রমাণ দিয়ে সমর্থন করার প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়ে যায়। যেমন যদি তিনি বিবাহিত হন বা অপেক্ষাকৃত বয়স্ক হন বা যদি তিনি নিম্নবিত্ত শ্রেণির কেউ হন, তবে তাঁর ক্ষেত্রে বিভিন্ন সাক্ষ্যপ্রমাণ দ্বারা ধর্ষণের শিকার হওয়ার প্রমাণ করা হয়ে যায় আরও দুষ্কর। খুব সাম্প্রতিক সময়ে এমন একটি মামলার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তি সফলভাবে বাদীকে মিথ্যা প্রমাণিত করতে পেরেছেন, সেই ঔপনিবেশিক যুক্তির আশ্রয় নিয়ে যে বাদী ‘দুশ্চরিত্র’ অথবা সমাজের নিম্ন শ্রেণির কেউ। আর এ কারণেই তাঁর অভিযোগ মিথ্যা হওয়ার সম্ভাবনা দৃঢ়।

তবে একই সঙ্গে এমন উদাহরণও রয়েছে, যেখানে আমাদের উচ্চ আদালত সচেতনভাবে ভুক্তভোগী নারীর পক্ষ হয়ে করোবোরেশনের প্রয়োজনীয়তাকে বিবেচনা করেছেন এবং মামলার রায়ে ভুক্তভোগীর সাক্ষ্যকে যথাযথ মূল্যায়ন করেছেন। আমরা চাই, আমাদের বিচারব্যবস্থা এমন হবে, যেখানে ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধের শিকার একজন নারীর সাক্ষ্য মূল্যায়িত হবে এবং তিনি ন্যায়বিচার পাবেন।

তাসলিমা ইয়াসমীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক