লাইসেন্সবিহীন চালক

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে লাইসেন্সবিহীন গাড়িচালকের যে তথ্য হাজির করেছেন তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৩৪ লাখ ৯৮ হাজার ৬২০টি। অথচ ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী চালক আছেন ১৮ লাখ ৬৯ হাজার ৮১৬ জন। তাহলে কি একজন লাইসেন্সধারী চালক ২টি করে যানবাহন চালান? সেটি তো বাস্তবে হতে পারে না।

মন্ত্রীর দেওয়া তথ্যমতে, নিবন্ধিত যানবাহনের মধ্যে ২২ লাখ ৬ হাজার ১৫৫টি মোটরসাইকেল আছে। প্রতিটি মোটরসাইকেলচালক লাইসেন্স নিলেও সমসংখ্যক লাইসেন্সধারী চালক থাকার কথা। কিন্তু সব শ্রেণির যানবাহন মিলে লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা সাড়ে ১৮ লাখের কিছু বেশি।

এসব তথ্য-উপাত্ত পরিবহন খাতের অব্যবস্থা ও বিশৃঙ্খলার কথাই মনে করিয়ে দেয়। এর আগে একজন মন্ত্রী গরু-ছাগল চিনলেই গাড়ি চালানো যায় বলে চালকদের সনদ দিয়েছিলেন। সড়ক পরিবহনমন্ত্রী সেই অবাস্তব বাক্য উচ্চারণ না করে দেশে ড্রাইভিং স্কুল ও দক্ষ প্রশিক্ষকের ঘাটতির কথা স্বীকার করেছেন। এ জন্য তিনি ধন্যবাদ পেতে পারেন।

তবে সড়ক পরিবহনমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই, তিনি বিলম্বে হলেও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষ চালকের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছেন। এখন যে প্রশ্নটি সামনে আসে তা হলো গাড়ির চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রয়োজনীয় শিক্ষাকেন্দ্র ও প্রশিক্ষক কেন আমরা তৈরি করতে পারলাম না? ৩৪ লাখ নিবন্ধিত যানবাহনের জন্য মাত্র ১২৩টি ড্রাইভিং স্কুলকে নিবন্ধন এবং ১৭৯ জন ড্রাইভিং ইনস্ট্রাক্টর থাকা অবিশ্বাস্য ঘটনা।

মন্ত্রী মহোদয় লাইসেন্সধারী চালকদের সংখ্যা কত, সেটি দেশবাসীকে জানালেও নকল বা ভুয়া লাইসেন্স নিয়ে কতজন চালক গাড়ি চালাচ্ছেন, সেই তথ্য দেননি। তবে দুর্ঘটনার পর অনেক সময়ই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে। দেখা যায় দুর্ঘটনাকবলিত যানটি যিনি চালাচ্ছিলেন, তিনি চালকের সহযোগী বা তাঁর কাছে যে লাইসেন্স আছে, সেটি আসল নয়। কিন্তু ভুয়া লাইসেন্স নিয়ে তাঁরা কীভাবে সড়কে নামেন? ভুয়া লাইসেন্স যাঁরা সরবরাহ করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে বিআরটিএ কী ব্যবস্থা নিয়েছে?

সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমেই ভুয়া লাইসেন্সধারীদের চিহ্নিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কোনোরকম প্রশিক্ষণ না নিয়ে অর্থের বিনিময়ে লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করতে হবে। তৃতীয়ত, লাইসেন্স নিতে যাতে কেউ হয়রানির শিকার না হন, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে দক্ষ ও মানবিক গুণসম্পন্ন পেশাদার গাড়িচালক তৈরির লক্ষ্যে পেশাজীবী গাড়িচালকদের স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলেছেন মন্ত্রী। কিন্তু দুই দিনের নিয়মমাফিক প্রশিক্ষণ যথেষ্ট কি না, সেটি ভাবা প্রয়োজন। তিনি যাত্রীসাধারণ তথা পথচারীদের সচেতন হওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু চালকদের সচেতন করার পাশাপাশি বিআরটিএকেও সজাগ করা জরুরি বলে মনে করি।

মন্ত্রী মহোদয় যাত্রীকল্যাণ সমিতিকে ভুয়া আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর উষ্মার কারণ সমিতির দাবি, গত ঈদের ছুটিতে ৩৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ ও গণমাধ্যমের উদ্ধৃতি দিয়ে মন্ত্রী বলেছেন, এই সংখ্যা ছিল ৮৪। কিন্তু তাঁর জানার কথা যে সব দুর্ঘটনার খবর গণমাধ্যমে আসে না এবং পুলিশের কাছেও পৌঁছে না। মন্ত্রী যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। কিন্তু তথ্য–প্রমাণ ছাড়া একটি সমিতিকে ভুয়া বলা কতটুকু যৌক্তিক? যেসব বিশিষ্ট নাগরিক যাত্রীকল্যাণ সমিতির আমন্ত্রণে গিয়ে যাত্রীসাধারণের নিরাপত্তাহীনতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তঁাদের কথা মন্ত্রীর কানে শ্রুতিমধুর না লাগলেও তঁাদের কণ্ঠে পরিবহন খাতের নির্মম সত্যই উঠে এসেছে।