মিনায় বাংলাদেশিরাও স্বেচ্ছাসেবক হতে পারেন

হজ পালনের সময় হজযাত্রীদের মিনা, আরাফাত, মুজদালিফা ও মক্কায় অবস্থান করতে হয়। মক্কার মসজিদুল হারাম থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে মিনা। হজের সময় মিনা মূলত তাঁবুর শহরে পরিণত হয়। সব তাঁবু দেখতে হয় একই রকমের। এ সময় অনেক মানুষের ভিড় হওয়ায় সেখানে কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারে না। ফলে হজযাত্রীদের পায়ে হেঁটেই চলাচল করতে হয়। নতুন দেশ, নতুন জায়গা হওয়ায় সচেতন না থাকলে বয়োবৃদ্ধেরা তো বটেই, তরুণ হজযাত্রীরাও নিজেদের তাঁবু হারিয়ে ফেলেন। তখন তাঁদের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। স্বেচ্ছাসেবকেরা সেই পথ দেখানোর কাজটি করেন। সাধারণত দেখা যায়, স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান থেকে আসা প্রবাসীরা বেশি। তাঁরা প্রতিবছরই মিনায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু বাংলাদেশি কোনো স্বেচ্ছাসেবক নেই।
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ১ লাখ ২৭ হাজারের বেশি মানুষ হজ পালন করতে যান। ভারত থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার, পাকিস্তান থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার মানুষ হজ পালন করেন। ২০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি সৌদি আরবে থাকেন। মক্কা, রিয়াদ ও জেদ্দায় অনেক বাংলাদেশি কাজ করেন। হজের পাঁচ দিন তাঁরা ছুটি পান। চাইলে তাঁরা মিনায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। যদিও মিনায় কিছু বাংলাদেশি অর্থের বিনিময়ে হজকর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এ ছাড়া তাঁরা কাজটা খুব একটা আন্তরিকতার সঙ্গে করেন না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এর কারণ, তাঁরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করে প্রবাসে এলেও ভালো কাজ পাননি বা তাঁদের নিয়োগকারীরা (কফিল) তাঁদের ইকামা (থাকার অনুমতিপত্র), অন্যান্য বিষয়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায়সহ নানা বিষয়ে জুলুম করেন। ফলে এই কর্মীরা আনন্দ ছাড়া কাজটা করেন। তবে অনেক বাংলাদেশি ছুটিকে কাজে লাগিয়ে হজযাত্রীদের সেবা করতে চান, স্বেচ্ছাসেবক হতে চান, তাঁদের সংগঠিত করে কাজে লাগানো যেতে পারে।
২০১৭ সালের হজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ওই বছর সৌদি আরবে কর্মরত বহু ভারতীয় ও পাকিস্তানি পেশাজীবী মিনায় হজ পালনে আসা হাজিদের সেবা দেন। মোট পাঁচ দিন সেবা দেন তাঁরা। কথা হয় স্বেচ্ছাসেবক ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার আজিজুল শেখ, সিরাজুল ইসলাম, বর্ধমান জেলার শহীদুলের সঙ্গে। জেদ্দার স্বর্ণ কারখানায় তাঁরা চাকরি করেন। শহীদুল বলেন, ‘ঈদের কারণে কর্মস্থলে ছুটি থাকে, দেশেও যেতে পারি না। পাঁচ দিন হজযাত্রীদের সেবা করি।’
তাঁদের কাছ থেকে জানতে পারি, হজের সময় ভারতের ইন্ডিয়া ফ্রেটারনিটি ফোরাম (আইএফএফ), রিসালা স্টাডি সার্কেল, জেদ্দা ওয়েলফেয়ার ফোরাম ও পাকিস্তানের পাকিস্তান হজ ফোরাম পথ হারানো হজযাত্রীদের পথ দেখানোর কাজটি করে। এসব ফোরামের সদস্যসংখ্যা তিন হাজারের মতো।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘হজ শুরু হওয়ার এক মাস আগে আমরা নিজেদের উদ্যোগে জেদ্দা হজ কার্যালয়ে (সিজি অফিস) যোগাযোগ করি। সিজি অফিস আমাদের মিনার ম্যাপ এলাকা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়। পরিচয়পত্র দেয়। আমরা নিজেরা ৩০০ রিয়াল করে জমাই। এই টাকায় আমরা মিনায় খাবার খাই। ২৪ ঘণ্টা পালাক্রমে হারানো হাজিদের পথ দেখিয়ে দিই। সিজি অফিস ঘুমানোর একটা জায়গা দিয়েছে। পুরো মিনা এলাকা ছয় কিলোমিটার। প্রতি ১০০ থেকে ২০০ মিটার পরপর আমরা দাঁড়িয়ে থাকি। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে আসা হাজিদের পথ দেখাই। হজযাত্রীদের সঙ্গে ভারী ব্যাগ থাকলে তা নিজেরা বহন করে তাঁদের কষ্ট কিছুটা লাঘব করার চেষ্টা করি। দেশে মা-বাবা আছেন। তাঁদের কথা মনে করে এসব হজযাত্রীর সেবা করাটা পুণ্যের কাজ বলে মনে করি। হজের এই ছুটিতে কোনো কাজ থাকে না আমাদের। যেহেতু আত্মীয়স্বজন দেশে থাকে, ছুটিতে থাকলে টিভি দেখে সময় কাটাতাম। এর চেয়ে এখন হজযাত্রীদের সেবা করছি, এটা আমাদের পরম পাওয়া।’
সৌদি আরবে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিভিন্ন ফোরাম রয়েছে। এসব ফোরাম স্বেচ্ছাসেবক হতে আগ্রহী বাংলাদেশিদের সংগঠিত করে হজের পাঁচ দিন মিনায় হাজিদের সেবায় নিয়োগ দিতে পারে। তাহলে আরও বেশি হজযাত্রী উপকৃত হবেন। তাঁদের দুর্ভোগ কমবে। চাইলে পরীক্ষামূলকভাবে এ বছর থেকেই প্রবাসী ফোরামগুলো মিনায় এ সেবা চালু করতে পারে। আগ্রহী প্রবাসীদের একত্র করার কাজটা জেদ্দায় নিযুক্ত বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল (সিজি) অফিস বাস্তবায়ন করতে পারে। প্রথম বছর হয়তো কিছুটা ভুলভ্রান্তি হবে। পরের বছরগুলোতে তা শোধরানো যাবে। প্রবাসীরা উদ্যোগ গ্রহণ করলে সিজি অফিসকেও এগিয়ে আসতে হবে।

ফেরদৌস ফয়সাল প্রথম আলোর হজ প্রতিবেদক, সাংবাদিক
afef [email protected]