গণতন্ত্রের কোলেই জন্ম নেয় কদলীতন্ত্র

রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান
রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান

রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান হয়তো এই মুহূর্তে দরজির সঙ্গে স্যুটের মাপ নিয়ে তর্ক করছেন। দ্বিতীয় মেয়াদে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। সবকিছু হতে হবে নিখুঁত। টাই আর পকেট স্কয়ার কী হবে, হয়তো সেটাও ভাবছেন।

এগুলো সবই অনুমান। যেটা নিশ্চিত, তা হচ্ছে দেশের সুরক্ষা নিয়ে এরদোয়ানের ভাবনা রোববার ৪৬১ পৃষ্ঠার প্রজ্ঞাপন জারি করে তাঁর সরকার। ভয়েস অব আমেরিকা জানায়, প্রজ্ঞাপনে প্রজাতন্ত্রের ১৮ হাজার ৬৩২ জন কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এঁদের মধ্যে আছেন পুলিশ কর্মকর্তা, সামরিক অফিসার থেকে বহু শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী।

এই প্রথম এরদোয়ান ঢালাও চাকরি খেলেন, এমন নয়; ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য টেলিগ্রাফ বলছে, ২০১৬ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানচেষ্টার পর থেকেই দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি রয়েছে। সেই ক্ষমতাবলে এরদোয়ান এর আগে ১ লাখ ৬০ হাজার প্রজাতন্ত্রের সেবককে সদর দরজা দেখিয়েছেন।

তুরস্ক সরকার বলছে, জাতীয় নিরাপত্তার খাতিরে সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে। এরদোয়ানের বিরুদ্ধে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের জন্য দায়ী করা হয় নির্বাসিত ধর্মীয় নেতা ফেতুল্লাহ গুলেনকে। ধর্মগুরু হওয়ার কারণে ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে তাঁর যোগসাজশ আছে—এমন অভিযোগ আছে। এরদোয়ান অবশ্য বলছেন, যাঁদের চাকরি গেছে, তারা কোনো না কোনোভাবে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত। তাই রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে তাঁদের অব্যাহতি জরুরি।

রোববারের প্রজ্ঞাপনে আগে চাকরি যাওয়া ১৪৮ জনকে স্বপদে পুনর্বহালও করা হয়েছে। কিন্তু কপালে শিকে ছেঁড়েনি ১২ এনজিও, তিন পত্রিকা ও একটি টেলিভিশন স্টেশনের। ঢাউস সাইজের প্রজ্ঞাপনটি তুরস্কে কার্যত তুঘলকি কারবার ঘটিয়েই দিয়েছে।

সমালোচকেরা বলেন, ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর থেকেই তুরস্কে প্রেসিডেন্টের অফিসকে প্রশ্নাতীত ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। এরদোয়ান স্বাভাবিকভাবেই এসবে কান দেন না। সমালোচকদের যুক্তি, প্রশ্নাতীত ক্ষমতা আখেরে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য ভালো কিছু নয়। এরদোয়ান উল্টো যুক্তি খাড়া করেন। ঐতিহাসিক উদাহরণ টেনে বলেন, কেন, এডলফ হিটলার।

টেলিগ্রাফের খবরে বলা হয়, এরদোয়ান বলেছিলেন, ‘হিটলারকে দেখুন, প্রশ্নাতীত ক্ষমতা পেয়ে তিনি ও জার্মানি কিন্তু ইতিহাসের পাতায় সফল।’

হিটলারের কথা যেহেতু উঠেই পড়ল, একটু পেছনে ফেরা যাক। প্রথম মহাযুদ্ধে হার নিশ্চিত বুঝতে পেরে ইম্পেরিয়াল সরকার মিত্রবাহিনীর সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে। সমরাস্ত্র উৎপাদন করতে গিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া জার্মান অর্থনীতি ভেঙে পড়ে নিমেষেই। রাস্তায় রাস্তায় শ্রমিক অসন্তোষ, হরতাল শুরু হয়। জার্মানিতে কমিউনিস্ট বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখা দেয়। রাশিয়ায় বলশেভিকদের জার বিতাড়নের ক্ষত তখনো তাজা।

শ্রমিক অসন্তোষ, ভেঙে পড়া অর্থনীতি আর কমিউনিস্ট বিপ্লবের আশঙ্কা সব মিলিয়ে জার্মানির ধনিক শ্রেণি ও সমাজের উঁচুতলার রাজনীতিকেরা হুট করেই জার্মানিকে পার্লামেন্টারি রিপাবলিক ঘোষণা করেন। যার প্রধান কাজ ছিল প্রথম মহাযুদ্ধের শান্তিচুক্তির শর্তগুলো পূরণ করা।

এই শর্তপূরণের প্রথম বলি হয় জার্মান সামরিক বাহিনী আর জার্মানির সীমানার এক-দশমাংশ। পুরো মহাযুদ্ধের দায়ও জার্মানিকেই নিতে হয়, দিতে হয় ক্ষতিপূরণও। তাতে বারোটা বাজে মিইয়ে যাওয়া জার্মান অর্থনীতির।

রাজনীতিবিদদের ওপর আস্থা হারায় জার্মান জনগণ। শত্রুবিনাশে ব্যর্থ তো বটেই, শত্রুর কাছে খোদ দেশটাকেই বেচে দিয়েছেন তাঁরা। জার্মান আত্মপরিচয়ের গরিমা ধুলোয় মিশে গেছে একেবারে। এই আত্মপরিচয়ের গরিমাকেই কাজে লাগিয়েছিলেন হিটলার। জার্মান জনগণকে সহজ শত্রু খুঁজে দেন তিনি: পুঁজিবাদ-সমাজতন্ত্রের কচকচিতে না গিয়ে দুটোকেই জার্মানি ধ্বংসের ষড়যন্ত্র বলে দেন। জমে থাকে জার্মান বারুদে এটুকু ফুলকিই দরকার ছিল।

হিটলারের সমর্থকেরা খোলা রাস্তায় দল পাকিয়ে কমিউনিস্ট খেদানো শুরু করে। বাইরের যে কেউই শত্রু। এমনকি ধনাঢ্য ইহুদিরাও। তাদের চেহারা জার্মানদের মতো নয়। বেহাল অর্থনীতিতে তারা বেশ আছে। নিশ্চয়ই শত্রুপক্ষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মালপানি বানিয়েছে। হিটলারও এমন চিন্তাতে উসকে দেন। বাড়তে থাকে তাঁর জনসমর্থন। মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতোই উড়ে আসে আমেরিকার মহামন্দা। আমেরিকার ব্যাংকগুলো, জার্মানিতে লগ্নি করা অর্থ ফেরত নিয়ে নেয়। পরিস্থিতি হয়ে পড়ে বেদম ঘোলাটে।

দিশেহারা জার্মান জনগণ। পরিত্রাণ কোন পথে, সবার এক চিন্তা। রাস্তা বাতলে দিলেন হিটলার: পুঁজিবাদী হটাও; কমিউনিস্ট খেদাও; বিদেশি তাড়াও। আর এই সমাধান করতে পারবেন একা হিটলার। এই ইশতেহারে নাৎসি পার্টির হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন তিনি। যুদ্ধফেরত বীর ফন হিন্ডেনবার্গের কাছে হেরে গেলেও ৩৬ শতাংশ ভোট পান হিটলার। দুবছর আগেও সেটা ছিল মাত্র তিন শতাংশ।

হিটলারের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করতে তাকে চ্যান্সেলর বানাতে চাপ দেন ব্যবসাদারেরা। তাতে কমিউনিস্টদের খেদিয়ে অন্তত কলকারখানাতে অল্প টাকায়, বিনা হরতালে কাজ করা যাবে। চ্যান্সেলর হয়েই কমিউনিস্ট আন্দোলনের জুজু হটাতে মনোযোগ দেন হিটলার ও তাঁর অনুসারীরা। এরই মাঝে এক তরুণ শ্রমিক জার্মান সংসদে আগুন দেয়। ঝোপ বুঝে কোপ মারেন হিটলার। জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে পার্লামেন্টের কাছ থেকে ক্ষমতা নিজের কবজায় নিয়ে নেন।

কিছুদিনের মধ্যেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। প্রজাতন্ত্রের চাকরি হারায় বহু লোক। অভিযোগ সেই একটাই—লোকগুলো রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন‍্য হুমকি। নিজের সমর্থকদেরও রেহাই দেননি হিটলার। অনেককে ধরে জেলে পোরেন, ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠান। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীকে মাথা তুলতে দেননি। আগস্ট ১৯, ১৯৩৯; মারা যান প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ। আর তখনই পানির মতো পরিষ্কার হয়ে যায়, জার্মানিতে আর কোনো নির্বাচন হচ্ছে না।

ভাবনার বিষয়, জনসমর্থন আদায়ে হিটলারকে মারধর করতে হয়নি কাউকে। মাঠগরম বক্তৃতা আর জনমানসের অবান্তর ভয়কে বাতাস দিয়েই লোক তাতিয়েছিলেন। বুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ীরা জনমতের স্রোতে টিকে থাকার জন্য হিটলারের ভুয়োদর্শনে সমর্থন জুগিয়ে যান। তাঁরা ভেবেছিলেন হিটলারের চরমপন্থী ইশতেহার স্রেফ মাঠগরম বক্তব্য ছাড়া কিছু নয়।

এর পরেরটা ইতিহাস। অনেকেই মনে করেন, গণতন্ত্র একবার প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলেই কেল্লাফতে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, হিটলারের মতো বর্ণবাদী একনায়কের উত্থান এই গণতন্ত্রের কোলে। আধুনিক যুগে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান একা সুলতান নন। এই সুপ্ত বাসনা বহু শাসকের আছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাহরণ, ভিন্নমতের উধাও হওয়া—এগুলো এশিয়া, মধ্য এশিয়ায় অহরহ ঘটছে। খোদ ইউরোপও এর বাইরে নয়। সবখানেই যুক্তি এক: রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও বহিঃশত্রু দমন। এই শত্রু কখনো কমিউনিস্ট, কখনো লোভী ইহুদি, কখনোবা মৌলবাদী সন্ত্রাসী।

তবে এসব অনেকের কাছে তাত্ত্বিক আলোচনা মনে হতে পারে। মোদ্দা কথা হলো, এরদোয়ান বা হিটলার, এঁদের মতো শাসকদের কাছে রাষ্ট্রনীতি কেন, কোনো নীতিরই এক পয়সা দাম নেই। ক্ষমতাই তাদের একমাত্র মাথাব্যথা। প্রজাতন্ত্রের চাকুরেদের পত্রপাঠ বিদেয় দিয়ে এরদোয়ান সবাইকে একটা বার্তাই দিলেন: লাইনে আসুন, নয়তো গর্দান যাবে। অথচ রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রজাতন্ত্রের চাকরিই সবচেয়ে নিরাপদ হওয়ার কথা ছিল।