ভিনদেশে রাজনীতিকদের ধরনা

গাজীপুর ও খুলনার নগর নির্বাচনে সাজানো ভোটের নতুন মডেল চালুর অভিযোগ করায় বিএনপির উদ্দেশে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ব্যঙ্গ করে তাদের বিদেশিদের কাছে নালিশ দিতে বলেছিলেন। সে রকম কোনো নালিশ তারা করেছে কি করেনি, সেই বিতর্কের ইতি টানা প্রায় অসম্ভব। তবে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট যে ওই দুই নির্বাচনেই অনিয়মের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, সে কথা আমরা সবাই জানি। তিনি ওই সব অনিয়ম তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেছেন। রাষ্ট্রদূতের এই মন্তব্যগুলো ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের পছন্দ হয়নি। তাঁদের কেউ কেউ একে কূটনৈতিক রীতিনীতির লঙ্ঘন অভিহিত করে তাঁকে বরং যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ত্রুটি-বিচ্যুতিতে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

বিদেশিদের বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়ে মাথা না ঘামানোর পরামর্শের জন্য ক্ষমতাসীন দলকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তাদের কথা আর কাজের মধ্যে ফারাক অনেক। ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে কথিত সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার পক্ষে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংয়ের ভূমিকা কারোরই অজানা নয়। আগামী নির্বাচনে ভারত যাতে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি কোনো পক্ষপাত না করে, সে জন্য দিল্লিতে বিএনপির ধরনায় আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্টতই একধরনের অস্থিরতা লক্ষণীয়। দলটির নির্বাচনী কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়কারী হোসেন তৌফিক ইমামের সাম্প্রতিকতম দিল্লি সফরে সে রকম আলামতই মেলে। বিএনপি পাকিস্তানপন্থী এবং তাদের ভারত কখনোই বিশ্বাস করবে না বলে আগের বলা কথাগুলোই তিনি এবার আরও জোরালোভাবে বলে এলেন।

হোসেন তৌফিক ইমাম শুধু যে বিএনপির অপরাধগুলোর কথা বললেন তা নয়; বরং আগ বাড়িয়ে আরও বললেন যে তিস্তা এখন আর দুই দেশের মধ্যে কোনো ইস্যু নয়। এসব কথা তিনি বলেছেন ভারতের ক্ষমতাসীন দল হিন্দুত্ববাদী বিজেপির গবেষণা প্রতিষ্ঠান, অবজারভার ফাউন্ডেশনে-যার সদস্যরা দলটির নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে বিশেষ ভূমিকা রেখে থাকেন।

তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবি পরিত্যাগের কথা যেহেতু সরকারিভাবে ঘোষিত হয়নি, সেহেতু ‘দুষ্টলোকেরা’ যদি বলেন যে আগামী নির্বাচনে তাদের সমর্থন পেতেই একটা বড় ছাড় দেওয়ার কথা তিনি জানিয়ে এলেন, তাহলে তার জবাব কী হবে? গত মঙ্গলবার ব্রাসেলসে তাঁর সঙ্গে দেখা হলে সংবাদপত্রে, বিশেষ করে ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর বক্তব্যের বিবরণ যথার্থ কি না-জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, তারা ভুল কিছু লেখেনি। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যদের কাছে তাঁর দল ও সরকারের কাজকর্মের যৌক্তিকতা তুলে ধরার জন্য তিনি যে প্রতিনিধিদল নিয়ে ব্রাসেলস গিয়েছিলেন, তাদের ভিড়ে তাঁর সঙ্গে কথা বাড়ানোর আর সুযোগ মেলেনি। যদিও আলাদা করে সময় চেয়েছিলাম, কিন্তু সময় হয়নি।

দিল্লিতে তিনি আরও বলেছেন, ভারতের উচিত বিএনপি অথবা বিএনপিমনাদের ভারত থেকে বের করে দেওয়া। আগামী নির্বাচনের জন্য ঘর গোছানোর প্রস্তুতির একটা ধারণাও তাঁর বক্তব্যে পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, হেফাজতে ইসলামের সমর্থক অনেক এবং যেহেতু তাদের দমন করা সম্ভব নয়, সেহেতু সরকার তাদের জন্য বিশেষ কৌশল গ্রহণ করেছে। তাঁদের অনেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন বলেও তিনি জানিয়েছেন।

বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারতের যেমন আগ্রহ আছে, অন্যান্য দেশেরও তেমনটি থাকা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আগের মতো এবারও দেখা যাচ্ছে যে ক্ষমতাসীন দল মনে করে শুধু তাদের পক্ষে যাঁরা, সেসব বিদেশি বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়ে মতামত দেওয়ার অধিকার রাখেন। সরকারের বিপক্ষে যায়, এমন কথা যাঁরা বলেন, তাঁদের নাক গলানো গ্রহণযোগ্য নয়। অতীতে বিরোধী দলে থাকার সময়ে তাদের চাপাচাপিতেই কমনওয়েলথ মহাসচিব যে স্যার স্টিফেন নিনিয়ানকে মধ্যস্থতার জন্য পাঠিয়েছিলেন, সে কথা অবশ্য ইতিহাস না পড়লে ৩০ বছরের কম বয়সী কারোরই জানার কথা নয়।

ব্রাসেলসে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্যের (এমইপি) সঙ্গে আলোচনায়ও আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্যের একটা বড় অংশজুড়েই ছিল আগামী নির্বাচনের কথা। এমইপিরা একটা অবাধ, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। বলা হয়েছে, এ জন্য প্রয়োজন একটি স্বাধীন এবং দৃঢ়চেতা নির্বাচন কমিশন, সবার শান্তিপূর্ণ প্রচার ও মত প্রকাশ এবং ভোটারদের পছন্দ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করা। সেখানে সাম্প্রতিক বিভিন্ন নির্বাচনের প্রসঙ্গও উঠেছে। ‘ছয় হাজার নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ ওঠেনি’ এমন দাবি সত্য হলে গত কয়েক বছরের নির্বাচনী সহিংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তি, বিশেষ করে দলীয় যুবগোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ আসত না। সেখানে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার নিশ্চিত করার আহ্বানও জানানো হয়েছে।

ব্রাসেলসে আওয়ামী লীগের যে প্রতিনিধিরা এসেছিলেন, তাঁরা দলে বেশ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বই পালন করেন। হোসেন তৌফিক ইমামের সঙ্গে ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা মসিউর রহমান, পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রধান দীপু মনি, প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ, তরুণ সাংসদ ফজলে নূর তাপস। তাঁরা প্রত্যেকেই সরকারের আর্থসামাজিক নীতিগুলো কতটা ভালো এবং সেগুলোর নানা সাফল্যের ফিরিস্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। মানবাধিকার বা আইনের শাসন বিষয়ে সরকারের বিরুদ্ধে যত অভিযোগই থাকুক না কেন, তারা দেশের ভালো করছে। সমস্যা যেগুলো হচ্ছে, সেগুলোর জন্য দায়ী বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও এবং তাদের দুর্নীতির রেশ। তাঁরা আরও বলেছেন, বিএনপি এখন কার্যত পরিচালনা করছে জামায়াতে ইসলামী। দেশে জঙ্গিবাদের সমস্যার জন্যও দায়ী জামায়াতে ইসলামী। আলোচনার একটা বড় অংশজুড়ে অবশ্য ছিল ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দেওয়ার মতো মানবিক দায়িত্ব পালনের মহত্ত্ব তুলে ধরার বিষয়।

ইংরেজি প্রবাদ ‘এন্ড জাস্টিফাইস মিনস্’ (কৌশল বা উপায় যা-ই হোক কর্মফলেই তার যৌক্তিকতা) অবশ্য সবার কাছে যে গ্রহণযোগ্য হবে, এমন কোনো কথা নেই। সে কারণেই মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশ আয়োজন ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার, বিনা বাধায় নির্বাচনী প্রচার চালানোর সুযোগ, স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলোর কথা আলোচনায় নানাভাবেই উঠে এসেছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাফল্যের স্বীকৃতি মিললেও প্রশ্ন উঠেছে, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কেন এখন সর্বোচ্চ? কেনই-বা সাধারণ মানুষের গড় আয় কমে গেছে? শিক্ষার মান কেন নিম্নমুখী?

গত সপ্তাহেই ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তাঁকে বলা হয়েছে, আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে। ব্রাসেলসের সভায়ও আওয়ামী লীগের নেতারা আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে বলে সবাইকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন। আমাদের নির্বাচন কমিশনের সামর্থ্য ও দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন অর্থায়ন করায় তাদের ঔৎসুক্যের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন করার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। কমিশনকে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সগুলো তারাই সরবরাহ করেছে। বিশ্বায়নের কালে এসব ঘটনা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হেনস্তা করার উদ্দেশ্যে বিদেশি কূটনীতিকদের কটু কথা শোনানোর আগে তাই নিজেদের চেহারাটাও আয়নায় দেখে নেওয়া উচিত।

সভার আয়োজক ব্রিটিশ কনজারভেটিভ পার্টির এমইপি চার্লস ট্যানকের বিরুদ্ধে অতীত পক্ষপাতের অভিযোগ এনে বিএনপি বৈঠকটি বর্জন করে রাজনৈতিকভাবে কতটা লাভবান হয়েছে, তা তারাই ভালো বলতে পারবে। তবে এই একটি সভা বয়কট করায় তাদের বিরুদ্ধে ‘বিদেশিদের কাছে নালিশ’ করার অভিযোগ যে বন্ধ হবে, এমনটি মনে হয় না।

রাজনীতিতে বিদেশিদের নাক গলানোর অভিযোগে সর্বসাম্প্রতিক সংযোজন হচ্ছে ব্রিটেনের লর্ডসভার সদস্য অ্যালেক্স কার্লাইলের ভারত সফরের নাটকীয়তা। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির বিরোধিতা করায় তিনি কয়েক বছর ধরেই বিতর্কিত। কিন্তু বিএনপি তাঁকে খালেদা জিয়ার আইনি পরামর্শক নিয়োগের পর লর্ড কার্লাইলকে ঢাকা এবং দিল্লিতে আসতে না দেওয়ার ঘটনায় তিনি যতটা প্রচার পেয়েছেন, তাতে সরকারের আদৌ কোনো লাভ হয়েছে কি না, এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে। এতে করে বরং যাঁরা খালেদা জিয়ার মামলায় রাজনীতির ছায়া দেখেন, তাঁদের দাবি জোরালো হবে।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক