ইউরোপের লজ্জা ও আত্মশুদ্ধি!

সিরিয়া থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়া একটি শরণার্থী পরিবার
সিরিয়া থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়া একটি শরণার্থী পরিবার

যুদ্ধবিধ্বস্ত দাঙ্গাপীড়িত অঞ্চল অথবা অভাবী দেশগুলো থেকে আসা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ইউরোপ। যাঁরা এত দিন গণতন্ত্র, মানবিকতা ও সহমর্মিতার কথা বলে এসেছেন, তাঁরা এখন পেছনে হাঁটছেন। শরণার্থী ঠেকাতে ফন্দিফিকির করতে তাঁরা একমত হয়েছেন।

জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের জার্মানি তথা ইউরোপের উদার শরণার্থী নীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। একাধিক দেশের রক্ষণশীল নেতা ও সরকারগুলোর চাপে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জুন মাসের শেষের দিকে ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত শরণার্থীবিষয়ক শীর্ষ সম্মেলনে শরণার্থী আসা ঠেকাতে দুটি বিষয়ে একমত হয়েছে। প্রথম সিদ্ধান্ত হলো, এখন থেকে ফ্রন্টটেক্স নামে পরিচিত বাহিনী ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সীমান্ত এবং সমুদ্র সীমান্তে শরণার্থী আগমন ঠেকাতে কড়াকড়ি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আফ্রিকার দেশগুলো থেকে ইউরোপে আসতে ইচ্ছুক শরণার্থীদের জন্য ইউরোপ মহাদেশের সীমানার বাইরে উত্তর আফ্রিকার কোনো দেশে শরণার্থী শিবির স্থাপন করা হবে।

দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত হলো, ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইউরোপমুখী যেসব শরণার্থীকে সাগর থেকে উদ্ধার করা হবে, তারা প্রকৃতপক্ষে শরণার্থী হওয়ার যোগ্য, নাকি অর্থনৈতিক কারণে ইউরোপে প্রবেশ করতে চায়, তা যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত শরণার্থীকে ইউরোপের নানা দেশে গ্রহণ করা হবে এবং বাকিদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধ বা রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ কোটি ৮৫ লাখ মানুষ দেশত্যাগী হয়েছে। এদের মধ্যে মাত্র সাড়ে ৬ লাখ মানুষ গত বছর ইউরোপে প্রবেশ করেছে। নানা দেশের দেশত্যাগী শরণার্থীদের মধ্যে ৮৫ শতাংশ মানুষই প্রতিবেশী দেশ বা অনুন্নত দেশগুলোতেই মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিরিয়া থেকে সর্বোচ্চসংখ্যক ৬৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে দেশ ত্যাগ করেছে। ২০১৬ সালে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী ইউরোপে আসতে সমর্থ হলেও তাদের ইউরোপে আসার প্রবণতা ক্রমান্বয়ে কমেছে। ২০১৬ সালে জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের মানবিক সিদ্ধান্তের কারণে জার্মানিতে প্রায় ১২ লাখ শরণার্থী প্রবেশ করতে পেরেছিল। সে সময় মধ্য ইউরোপের অন্য দেশগুলোও বেশ কিছু শরণার্থী গ্রহণ করেছিল। মোদ্দাকথা, বিশ্বব্যাপী মোট শরণার্থীর মধ্যে খুব কমসংখ্যক মানুষ ইউরোপে তাদের আশ্রয় খুঁজতে পেরেছে।

আফ্রিকা ও এশিয়ার নানা দেশ থেকে আসা এই সামান্যসংখ্যক শরণার্থী নিয়ে ইউরোপে এখন বিদ্বেষ ছড়ানো রাজনীতি হচ্ছে। এই রাজনীতির কাছে পরাজিত হচ্ছে ইউরোপের উদারপন্থী রাজনীতি। ইউরোপের কট্টরপন্থী রাজনীতিকেরাসহ তাঁদের বিপুলসংখ্যক সমর্থক ইউরোপের অতীত ইতিহাস ভুলে গেছেন।

জার্মানির বনেদি পত্রিকা সুদ ডয়চে জাইটুং ইতিহাসবিষয়ক পাতায় ‘আত্মশুদ্ধি’ নামে একটি লেখা প্রকাশ করেছে। লেখায় প্রায় ২০০ বছর আগে ১৮২৪ সাল থেকে ইউরোপীয় নাগরিকদের অভাব-অনটনের কারণে আর ভালো জীবনযাপনের আশায় আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় প্রবেশ করার কাহিনি বিবৃত হয়েছে। ১৮২৪ থেকে ১৯২৪-এই শত বছরে ৫ কোটি ২০ লাখ ইউরোপীয় নাগরিক তাদের দেশ ছেড়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আর সচ্ছলতা খুঁজতে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছে বলে জানিয়েছেন লেখক রনেন স্টাইনকে। ইতিহাসনির্ভর এই লেখার শেষে তিনি নিউইয়র্কে পাড়ি দেওয়া ফ্রাঙ্কফুর্টে বসবাসকরী ২৫ বছরের এলিজাবেথ স্মিডের লেখা চিঠির উদ্ধৃতি দিয়েছেন। এলিজাবেথ তাঁর আমেরিকা যাওয়ার কষ্টের বিবরণসহ তাঁর শহর ফ্রাঙ্কফুর্টে ১৯০১ সালে অব্যাহতভাবে রাজনৈতিক অনাচার, বিদ্রোহ-পাল্টাবিদ্রোহ এবং সেই বছর ৩০০ রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও হানাহানির পর, রাষ্ট্র জার্মানির আতঙ্কিত ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর পরিবার আমেরিকা পাড়ি দিয়েছিল বলে জানিয়েছেন।

আজকে যেমন দারিদ্র্যপীড়িত ও যুদ্ধবিধ্বস্ত আফ্রিকা বা এশীয় দেশ থেকে আশ্রয়ের জন্য মানুষ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে আসতে চাইছে, ঠিক তেমনিভাবেই ইউরোপের মানুষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবধি পৃথিবীর নানা প্রান্তে আশ্রয় খুঁজে ফিরেছে। বছরের পর বছর খাদ্যশস্যের কম উৎপাদন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বেকারত্ব, যুদ্ধ আর রাজনৈতিক অস্থিরতা-সব মিলিয়ে ইউরোপ ছিল অস্থির। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় নানা ইউরোপীয় দেশ থেকে তারা আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছিল। অথচ সেই অতীত ইতিহাস আর আত্মশুদ্ধির বিষয়টি আজকের লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতিকেরা বেমালুম ভুলে বসেছেন।

ইউরোপের নানা দেশে এখন ইউরোপীয় দেশত্যাগীদের মর্মন্তুদ কাহিনি, আটলান্টিকের অপর পারে নতুন করে তাদের জীবন গড়ার কাহিনি, চিঠিপত্র, দলিল-দস্তাবেজ নিয়ে ‘দেশান্তরি জাদুঘর’ রয়েছে। এমনই একটি দেশান্তরি জাদুঘর উত্তর জার্মানির উত্তর সাগরের সমুদ্রবন্দর ব্রেমাহাফেনে। জাদুঘরের নাম ‘জার্মান দেশান্তরি জাদুঘর’। জাদুঘরের প্রবেশপথে লেখা রয়েছে, এই পথ দিয়েই ৭০ লাখ জার্মান ও মধ্য ইউরোপীয় অভিবাসী অজানা পৃথিবীর দিকে পাড়ি দিয়েছিল। এই ব্রেমাহাফেন বন্দর দিয়েই ১৮৮৫ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাদা ফ্রিডরিশ ট্রাম্প ভাগ্যের অন্বেষণে মাত্র ১৬ বছর বয়সে দক্ষিণ জার্মানির রাইনল্যান্ড ফালৎস রাজ্য ছেড়ে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছিলেন।

ইউরোপীয়দের শুধু অতীত দেশান্তরি হওয়ার ইতিহাসই নয়, এর সঙ্গে আছে শত শত বছর ধরে আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে উপনিবেশবাদী লুণ্ঠনের ইতিহাস। আর বর্তমানে আছে অস্ত্র বিক্রয়ের ব্যবসা। পৃথিবীব্যাপী অস্ত্র বিক্রেতা হিসেবে আমেরিকা, রাশিয়া, চীনের পরই আছে মধ্য ইউরোপের দুই দেশ ফ্রান্স আর জার্মানির নাম।

ইউরোপের অনেক দেশেই লোকরঞ্জনবাদী কায়দায় মানুষের আবেগকে সম্বল করে শরণার্থী, অভিবাসীদের প্রতি ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে। বর্ণ ও ধর্মবিদ্বেষী স্লোগান তুলে ইউরোপের রাজনৈতিক আঙিনায় রক্ষণশীল দলগুলো বেশ লাভবান হয়েছে। পোল্যান্ড, হাঙ্গেরিতে এরা সরকার গঠন করছে। আর জার্মানি, হল্যান্ড, ডেনমার্ক ও সুইডেনে ডানপন্থী রক্ষণশীল দলগুলো এখন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ৷ ইতালি, বেলজিয়াম, ফিনল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও গ্রিসে ডানপন্থী কয়েকটি দল সরকারের অন্যতম শরিক।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপজুড়ে যে পরিমাণ শরণার্থী রয়েছে, তার চেয়ে বেশি শরণার্থী রয়েছে ছোট দেশ লেবাননে। অথচ এই শরণার্থী রাজনীতিকে সম্বল করে ইউরোপে এখন তোলপাড় চলছে। যে মহাদেশ গত শতকে দুটি মহাযুদ্ধে জড়িয়েছে, বিস্তর ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে, তাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া আর আত্মশুদ্ধির বিষয়ে কার্পণ্য সত্যিই লজ্জাজনক।

সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর হ্যানোভার (জার্মানি) প্রতিনিধি
[email protected]