ছাত্রলীগ মারে কেন?

সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নামে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে যে ৫৫ শতাংশ কোটা আছে, সেটি সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে কয়েক বছর ধরে। সাম্প্রতিক ঘটনায় অনেকের মনে হতে পারে, আন্দোলনটি শুরু হয়েছে গত এপ্রিলে। বাস্তবে এর শুরু অনেক আগেই। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কোটার বিষয়টি পর্যালোচনা করতে একাধিকবার কমিটিও গঠন করেছিল। আর সেই কমিটিও সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছে।
এখানে সরকার অর্থাৎ নীতিনির্ধারক এবং যাঁরা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছেন, তাঁরা দুটি পক্ষ। কীভাবে কোটা সমস্যার সমাধান করবে, সেটি সরকারের এখতিয়ার। ইতিমধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটি কাজও শুরু করেছে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী কমিটি বিভিন্ন মহলের মত নিচ্ছে। এমনকি কোটা সংস্কারের আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁদের মতামতও নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
সে ক্ষেত্রে আমরা ধারণা করতে পারি, কমিটির পদাধিকারীরা বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন এবং তাঁরা চান সমস্যার শান্তিপূর্ণ ও স্থায়ী সমাধান হোক। শুরু থেকেই আন্দোলনকারীরা বলে আসছেন, তাঁরা কোটা প্রথা বাতিল চান না, সংস্কার চান। এখন সংস্কারটি কীভাবে হবে, কত দিনে হবে—সেটি দুই পক্ষ আলাপ–আলোচনা করে ঠিক করতে পারে। যেমনটি আন্দোলনের সূচনায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং  সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বৈঠক করে বলেছিলেন, এক মাসের মধ্যে সমাধান হয়ে যাবে। এ নিয়ে সংঘাত-সংঘর্ষ, হামলা, গ্রেপ্তার হয়রানি—কোনোটাই কাম্য নয়।
কিন্তু এরপরও হামলা হুমকির ঘটনা ঘটছে এবং সরকার ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে আরেকটি পক্ষের আবির্ভাব ঘটছে—ছাত্রলীগ। কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীরাও নিজেদের ছাত্রলীগের হল পর্যায়ের নেতা-কর্মী বলে দাবি করেছেন। ছাত্রলীগের সদ্যবিলুপ্ত কমিটির পক্ষ থেকে সেই দাবি নাকচ করা হয়নি।
কিন্তু আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, যেদিন সরকার কোটা সংস্কারের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছে, সেদিন থেকেই ছাত্রলীগ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের মারধর শুরু করল। ছাত্রলীগ মারে কেন?
এ বিষয়েও নানা ব্যাখ্যা আছে। সম্মেলনের পর আগের কমিটি বিলুপ্ত হলেও নতুন কমিটি গঠন করা হয়নি। নতুন কমিটিতে যাঁরা আসতে উদ্‌গ্রীব, তাঁরাই নাকি নিজেদের শক্তিমত্তা দেখাতে মাঠে নেমেছেন ভবিষ্যতের কথা ভেবে। আন্দোলনকরীরা এখন দ্বিমুখী আক্রমণের শিকার। একদিকে ছাত্রলীগ মারছে, আরেক দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের বাড়ি থেকে বা সমাবেশ থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সমাবেশে ছাত্রলীগ কেবল হামলাই করেনি, প্রতিবাদ সমাবেশে যোগদানকারী ছাত্রীদের ওপরও নির্যাতন চালিয়েছে। সরকারের দাবি, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে বিরোধী দলের সংযোগ আছে। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকলে সরকার কেন তা দেশবাসীকে জানাচ্ছে না? কেউ রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করলে (বাংলাদেশে সরকারবিরোধী কাজকেই রাষ্ট্রবিরোধী ভাবা হয়, যদিও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিষয়টি মোটেই ঠিক নয়) সরকার তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু সন্দেহের বশে কারও ওপর নির্যাতন চালাতে পারে না।

গণতান্ত্রিক সমাজে মত প্রকাশের অধিকার যেকোনো নাগরিক বা সংগঠনের আছে। ছাত্রলীগ যদি কোটা সংস্কার আন্দোলনকে অযৌক্তিক মনে করেন, সে কথাও তারা সংবাদ সম্মেলন বা সভাসমাবেশ করে জনগণকে জানাতে পারে। আমরা গত কয়েক দিনে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের যে রূপ দেখেছি, সেটি কোটা সম্পর্কে ছাত্রলীগের মনোভাব প্রকাশ নয়, বরং আন্দোলনকারীদের ওপর সহিংস তাণ্ডব। রাজশাহীতে তারা তরিকুল নামে একজন শিক্ষার্থীর পা ভেঙে দিয়েছেন হাতুড়ি থেরাপি চালিয়ে। ঢাকায় ছাত্রলীগ দফায় দফায় আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয়েছে। এমনকি শিক্ষকেরা শহীদ মিনারে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করলে ছাত্রলীগের কর্মীরা বলপ্রয়োগ করে তা পণ্ড করে দেন। প্রথম আলো অনলাইনে রোববারের ঘটনার বিবরণ দেওয়া হয়েছে এভাবে :
কোটা সংস্কার আন্দোলনে হামলার প্রতিবাদ ও গ্রেপ্তার ছাত্রদের মুক্তির দাবিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে দফায় দফায় বাধা দেওয়া হয়েছে। হামলা চালানো হয়েছে। দুপুরের দিকে কর্মসূচির একপর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মিছিল বের করলে তাঁদের ওপর হামলা হয়। এ সময় শিক্ষকদের সঙ্গে ছাত্রলীগ মারমুখী আচরণ করে। তারা ছাত্রীদের মারধর করে। ধাওয়া ও ধাক্কা দিয়ে মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেয়। একপর্যায়ে ‘পাকিস্তানি রাজাকার শিক্ষকদের বহিষ্কার করতে হবে’, ‘শিক্ষকেরা জামায়াত-শিবিরের দোসর’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন ছাত্রলীগের কর্মীরা। শিক্ষকদের গালাগালি ও মাইক বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগও পাওয়া যায়। হেনস্তার শিকার হয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনারের সামনে থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। সেখান থেকে সরে তাঁরা মিছিল বের করেন। কর্মসূচিতে শিক্ষকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক তানজীম উদ্দীন খান, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ফাহমিদুল হক, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ।
ছাত্রলীগের এই নেতা-কর্মীদের মধ্যে ইডেন ও বদরুন্নেসা কলেজের শিক্ষার্থীরাও ছিলেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী পপি জানান, তাঁরা ১২০ জন ছাত্রলীগের সঙ্গে এসেছেন।’
ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা যদি মনে করে থাকেন, বর্তমান কোটাপদ্ধতি খুবই উপাদেয় বিষয়, তারা তার পক্ষে ক্যাম্পাসের অন্য কোথাও মিছিল-সমাবেশ করতে পারত। অথবা শিকক-শিক্ষার্থীদের সমাবেশ শেষ হওয়ার পর তাঁরা আরেকটি সমাবেশ করতে পারতেন। কিন্তু সেটি না করে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আহুত সমাবেশ বাধাগ্রস্ত করলেন। যখন প্রতিবাদ করার মতো কোনো যুক্তি থাকে না, তখনই মানুষ বলপ্রয়োগের আশ্রয় নেয়। তবে আশ্চর্য ঘটনা হলো ছাত্রলীগের এসব বেআইনি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন টু শব্দটি করে না। বরং আমরা দেখেছি বাম ছাত্রসংগঠনগুলো যখন প্রশাসনের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে কর্মসূচি দিয়েছিল, তখন প্রশাসন ছাত্রলীগকেই লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করেছে।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রজ্ঞাপন জারি করে বলেছিল, বহিরাগতদের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে বা অবস্থান নিতে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। পরের প্রজ্ঞাপনে কিছুটা সংশোধন করে তারা বলেছে, প্রবেশে অনুমতি লাগবে না। তবে প্রবেশপথে চৌকি বসিয়ে পরিচয় জানতে চাওয়া হবে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই অবস্থিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সেখানে অবাধে সভাসমাবেশ করতে পারলেও বহিরাগতদের আসার কথা নয়।
কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমাবেশ ভাঙতে ছাত্রলীগ ইডেন কলেজ ও বদরুন্নেসা কলেজ থেকে ছাত্রী কর্মীদের নিয়ে এলেও কর্তৃপক্ষ টু শব্দটি করেনি। তাহলে তাদের বহিরাগত নিষেধাজ্ঞা কি শুধু কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর প্রযোজ্য? শিক্ষক শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ সমাবেশ ভাঙতে যে বহিরাগতরা শহীদ মিনারে আসেন বা আনা হয়, তাদের জন্য কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই?