মতলবে বাল্যবিবাহ বন্ধ

শতাব্দী-প্রাচীন যে কয়টি ‘দুরারোগ্য ব্যাধি’ থেকে আমরা এখনো মুক্তি পাইনি, তার একটির নাম বাল্যবিবাহ। এ ভয়ানক ব্যাধির ‘প্রতিষেধক’ হিসেবে যে আইন আছে, তার প্রয়োগটাই এখন বড় বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে। বাল্যবিবাহ বন্ধে সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাব তো আছেই। প্রশাসনের গাফিলতিও আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে।

এ রকম সময়ে আশাব্যঞ্জক একটি কাজ করেছেন চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শারমিন আক্তার। গত শুক্রবার গজরা ইউনিয়ন ও ছেংগারচর পৌর এলাকায় তিনি চারটি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছেন। এই চারজন ‘কনে’ই ছিল ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সী। তারা সবাই ছাত্রী। ইউএনও তাদের বাড়িতে গিয়ে ছেলে ও মেয়েপক্ষের অভিভাবকদের বুঝিয়ে বিয়ে বন্ধ করেন। সাবালিকা হওয়ার আগে মেয়েকে আর বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না মর্মে লিখিত অঙ্গীকারনামা আদায় করা হয় ওই চার ছাত্রীর অভিভাবকদের কাছ থেকে। একই সঙ্গে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ ও তদারকির জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। শারমিন আক্তারের মতো প্রতিটি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তারা বাল্যবিবাহবিরোধী অবস্থান নিলে চলমান সামাজিক আন্দোলন জোরদার হতো।

মেয়েদের বাল্যবিবাহের জন্য প্রধানত দায়ী দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও লিঙ্গবৈষম্য। গ্রামেগঞ্জে অনেক বাবা-মা এখনো মনে করেন, মেয়েদের শিক্ষার জন্য টাকাপয়সা খরচ করা মানে অপচয়। তার চেয়ে বরং মেয়েদের অল্প বয়সে পাত্রস্থ করতে পারলে সংসারে একজনের গ্রাসাচ্ছাদনের ভার কমে। আর এর বিষময় পরিণতি মেয়েদের অকাল মাতৃত্ব, যা প্রসূতি ও সদ্যোজাত শিশুর মৃত্যুর আশঙ্কা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। বাল্যবিবাহের এ নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরা দরকার।

বাল্যবিবাহ রোধ এবং রদ করতে প্রয়োজন সমষ্টিগত বহুমাত্রিক লড়াই। সমাজের অনেককেই এতে শামিল হতে হবে। বাবা-মা, ছেলেমেয়ে, স্বাস্থ্যকর্মী, স্থানীয় স্কুলশিক্ষক, শিক্ষিত সমাজসচেতন নাগরিক সবাইকে নিয়ে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রচার-অভিযান চালাতে হবে। এ ক্ষেত্রে নেতৃত্বে থাকতে হবে প্রশাসনকেই। বাস্তব উদাহরণ দিয়ে সবার সামনে মেয়েদের বাল্যবিবাহের কুফল তুলে ধরতে হবে। সচেতনতা গড়ে তোলাই বেশি জরুরি। আর বাল্যবিবাহ রুখতে আইনি ব্যবস্থা সর্বশেষ পদক্ষেপ হওয়া উচিত।

এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে মেয়েদের বাল্যবিবাহ ঠেকাতে তাদের আরও বেশি করে স্কুলে ভর্তি করতে হবে, পড়াশোনা যাতে চালিয়ে যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন মেয়েদের স্কুলে পড়াশোনা চালানোর জন্য সরকারি স্তরে বাড়তি কিছু সুযোগ-সুবিধা।

বাল্যবিবাহ নিরোধে আইন রয়েছে। আইন আইনের মতো চলুক, সঙ্গে চলুক মানসিকতা পরিবর্তনের আন্দোলন। এ কথা মানুষকে বোঝাতে হবে, মেয়েদের বাল্যবিবাহ দেওয়া মানে আসলে শৈশব চুরি করা। নিজের পরিবার থেকে মেয়েটিকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া।