নওয়াজের বিপদে ইমরানের খুশির কিছু নেই

নওয়াজ শরিফ ও ইমরান খান
নওয়াজ শরিফ ও ইমরান খান

২০১৩ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর নওয়াজ শরিফ আমাকে বলেছিলেন, তিনি পাকিস্তানের মানুষকে জানিয়ে দিতে চান, দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনিই দেশের ‘বস’; সেনাবাহিনী নয়। পাঁচ বছর পর সেই নওয়াজকে নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তে লন্ডন থেকে ফিরে শুধু কারাজীবনই নয়, তাঁকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চাওয়া সেনাশক্তিকেও মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

নির্বাসনে না থেকে জেলজীবন বেছে নেওয়ার মাধ্যমে নওয়াজ তাঁর দল পিএমএল-এনকে নতুন জীবনী শক্তি দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁর সাহসী প্রত্যাবর্তন আসন্ন নির্বাচনের জন্যও ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে। দেশে ফিরে কারাবরণ করার মধ্য দিয়ে তিনি জাতিকে বোঝাতে চেয়েছেন, পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর আনুগত্য না মেনে বুক টান করে দাঁড়ানোর মতো হিম্মত একমাত্র তাঁরই আছে।

তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়া নওয়াজ এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের নাম পানামা পেপারসে আসার খবর গত বছর প্রকাশ পায়। সেই সূত্র ধরে তদন্ত হয়। প্রথমে নওয়াজের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি দুর্নীতির টাকায় লন্ডনে চারটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনেছেন। কিন্তু দুর্নীতির বিষয়টি তদন্তকারীরা প্রমাণ করতে পারেননি। ফ্ল্যাটগুলো কেনার পয়সাকড়ি কোত্থেকে এল, সে সম্পর্কে সদুত্তর দিতে না পারায় আদালত নওয়াজ ও তাঁর মেয়েকে কারাদণ্ড দেন।

জেলের রায় হওয়ার আগেই সুপ্রিম কোর্ট নওয়াজকে ‘সৎ’ ও ‘বিশ্বস্ত’ না হওয়ার কারণে প্রধানমন্ত্রীর আসন থেকে সরিয়ে দেন। ‘সৎ’ ও ‘বিশ্বস্ত’-এ দুটি বিমূর্ত শব্দ পাকিস্তানের সংবিধানে যুক্ত করেছিলেন দেশটির সবচেয়ে কুখ্যাত জেনারেল জিয়াউল হক। নওয়াজ শরিফের দুর্নীতির অভিযোগ সঠিক কি না, সেটি এখন আর কোনো বড় বিষয় নয়। সাধারণ মানুষের ধারণা, রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিতে অন্যায়ভাবে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে তাঁকে জেলে ঢোকানো হয়েছে। ব্যাপকভাবে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের গায়ে দুর্নীতির কালিমা লেপন করে সেনাবাহিনী শাসনক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখতে চায়। পাকিস্তান হচ্ছে সেই দেশ, যেখানে একজন প্রধানমন্ত্রীও তাঁর পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। সেই দিক থেকে নওয়াজের ঘটনাকে বিচার বিভাগীয় অভ্যুত্থান হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। ঠিক এই কারণেই নওয়াজের পতন দেখে তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী (যিনি হয়তো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন) ইমরান খানেরও উল্লসিত হওয়া উচিত হবে না।

ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া ইমরান খানের ওপর আড়ালে থাকা ছায়া সরকারের নেকনজর আছে বলে সবাই মনে করছে। লাহোরে নওয়াজকে গ্রেপ্তারের সময় তাঁর যে সমর্থকেরা প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিলেন, তাঁদের ইমরান খান ‘গাধা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি আমাকে একবার বলেছিলেন, ‘উদারপন্থীরা পাকিস্তানের জঞ্জাল’। সেই তিনি এখন দুর্নীতিবিরোধী ও আমেরিকাবিরোধী স্লোগান নিয়ে রাজনীতির প্রথম সারিতে উঠে এসেছেন। অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করা এই রাজনীতিক পাকিস্তানকে তাঁর ভাষায় একটি ‘ইসলামি সমাজকল্যাণমূলক রাষ্ট্র’ বানাতে চান।

তবে ক্ষমতার মসনদের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ইমরান খান যে বিষয়টি ভুলে গেছেন, তা হলো আজ নওয়াজের যে অবস্থা হয়েছে, তা কাল তাঁরও হতে পারে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আজ ইমরানকে যত সহমর্মিতা দেখাচ্ছে, একসময় নওয়াজকে তারা এর চেয়ে বেশি অনুগ্রহ দেখিয়েছিল। চক্রাকারে ঘুরে আসা সেই নিয়তি কি ইমরান এড়াতে পারবেন?

পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমে কর্মরত আমার সব বন্ধুবান্ধবই আমাকে বলেছেন, সেখানে এখন গণমাধ্যমের ওপর রাষ্ট্র নজিরবিহীন কড়াকড়ি আরোপ করেছে। নওয়াজ শরিফ এবং তাঁর মেয়ের বক্তব্য গণমাধ্যমে সম্প্রচার করা হয়নি। তাঁর দেশে ফেরা এবং গ্রেপ্তার হওয়ার খবর সরাসরি সম্প্রচার না করার জন্য সব কটি মিডিয়াকে আগে থেকেই বলে দেওয়া হয়েছিল। শরিফের পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর কাটছাঁট করে তা প্রচার করা হয়েছে। নওয়াজের দলের কর্মী-সমর্থকদের বেছে বেছে ধরা হচ্ছে এবং জেলে পাঠানো হচ্ছে। এমনকি নওয়াজবিরোধীদেরও শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না।

কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে যে মুহূর্তে নওয়াজ ও তাঁর মেয়েকে জেলে নেওয়া হচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তানের আড়ালে থাকা কর্তৃপক্ষ ‘ভালো সন্ত্রাসীদের’ (যেসব সন্ত্রাসীকে ভারত ও আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায়) মূলধারার রাজনীতিতে পুনর্বাসন করছে।

কয়েক লাখ ডলারে ফ্ল্যাট কেনার পর অর্থের উৎস সম্পর্কে সদুত্তর দিতে না পারায় নওয়াজকে যখন জেলে যেতে হচ্ছে, ঠিক সেই সময় মুম্বাই হামলায় জড়িত সন্ত্রাসী হাফিজ সাঈদকে শুধু মুক্তিই দেওয়া হয়নি, তাঁর নেতৃত্বে ‘আল্লাহু আকবার তেহরিক’ নামের একটি দল খুলে সেই দলকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পথও প্রসারিত করা হয়েছে। এই দ্বিচারিতার কী ব্যাখ্যা থাকতে পারে?

শরিফ এমন দিনেই পাকিস্তানে ফিরেছেন, যেদিন বেলুচিস্তানে আইএসের হামলায় ১২৮ জন মারা যায়। কিন্তু এই হত্যার উন্মাদনা বন্ধে সরকার বা সেনাবাহিনীর কাউকেই তেমন সক্রিয় ভূমিকা রাখতে দেখা যায় না। রাজনীতিক হিসেবে অবশ্যই নওয়াজ শরিফ ধোয়া তুলসীপাতা নন। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সন্ত্রাসী সংগঠন লস্কর-ই-তাইয়েবার প্রতিষ্ঠাতা হাফিজ সাঈদকে ছেড়ে দেওয়া এবং নওয়াজের মতো নির্বাচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে জেলে পাঠানোর কোনো সভ্য যুক্তি থাকতে পারে না। এতে নওয়াজের প্রতি মানুষের সহানুভূতি ও সমর্থন বেড়েছে। জেলে ঢুকতে হবে জেনেও নওয়াজ দেশে ফেরায় তাঁর ঘোর শত্রুরা পর্যন্ত তাঁর সাহসের প্রশংসা করেছেন।

এর আগে জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে নওয়াজ ও বেনজির ভুট্টো এক হয়েছিলেন। এখন সামরিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে দেশকে বাঁচাতে নওয়াজ, বেনজিরের ছেলে বিলাওয়াল ও ইমরান খান যদি এক হন, সেটি গণতন্ত্রের জন্য ভালো। সামরিক অভ্যুত্থান এবং গণতন্ত্রের নামে সামরিক শাসনের অবসান ঘটাতে এ ছাড়া আর কোনো সমাধান আপাতত নেই।

(ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত)
(বারখা দত্ত: ভারতের সাংবাদিক)