নদীতে নামার দরকারটা কী?

কক্সবাজারের চকরিয়ায় মাতামুহুরী নদীতে গোসল করতে নেমে চিরতরে হারিয়ে গেছে পাঁচ কিশোর। গতকাল রোববার প্রথম আলোর তৃতীয় পাতার খবর এটি। নদীর পাশে থাকা মাঠে ফুটবল খেলতে গিয়েছিল কিশোরেরা। খেলা শেষে যখন তারা নদীতে গোসলে নামে, খরস্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাদের। এরা সবাই স্কুলের অষ্টম ও দশম শ্রেণির ছাত্র ছিল।

আজকের পত্রিকার একটি খবর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে মেঘনা নদীতে গোসলে নেমে সেলফি তোলার সময় প্রবল স্রোতে ডুবে যান এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী। তাঁকে উদ্ধারের জন্য তাঁর এক বন্ধু পানিতে ঝাঁপ দিলে তিনিও ডুবে যান। পরে তাঁদের লাশ উদ্ধার করা হয়।

এ ধরনের সংবাদ পত্রিকার পাতায় আমাদের কিছুদিন পরপর দেখতে হয়। বেড়াতে গিয়ে সাগরে, নদীতে, হ্রদে, জলপ্রপাতে ডুবে প্রায়ই মারা যাচ্ছে তরুণ-কিশোরেরা। বিপজ্জনক স্থানে সেলফি তুলতে গিয়ে মৃত্যুর খবরও এখন প্রায়ই শোনা যায়। মর্মান্তিক এসব মৃত্যুর পেছনের আসল কারণ হচ্ছে অসতর্কতা আর অসচেতনতা।

প্রায়ই দেখা যায়, সাঁতার না জানা সত্ত্বেও পানিতে নেমে পড়ছে অনেকে। ফলাফল হচ্ছে মর্মান্তিক মৃত্যু। আবার সাঁতার জানলেই যে পানিতে ডুবে মারা যাবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। নদী খরস্রোতা হলে বা সাগর উত্তাল হলে সাঁতার জানলেও তা কোনো কাজে আসে না।

কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে গিয়ে প্রতিবছরই সাগরে ডুবে পর্যটকের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। সাগরে গোসলের নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম থাকলেও অনেকেই তা মানে না। এতে স্রোতে ভেসে গিয়ে ও গুপ্ত খালে আটকে পড়ে মারা যাচ্ছে অনেকেই। কক্সবাজারে কিছু প্রতিষ্ঠান অবশ্য পর্যটকদের নিরাপত্তা বিধানে স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে কাজ করে যাচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা পর্যটকদের সাগরে নামার ব্যাপারে নানা দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন। তাঁরা গোসল করতে আসা লোকজনকে নানাভাবে সতর্ক করেন। গুপ্ত খাল চিহ্নিত করার জন্য লাল পতাকা উত্তোলন করেন। কিন্তু দেখা যায়, এসব সতর্কতাকে উপেক্ষা করে লোকজন সাগরে নেমে পড়ছে। পরিণতিতে ঘটে মৃত্যু।

বাবা-মায়ের অসতর্কতার কারণে প্রতিবছর বহু শিশু পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি), আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ গবেষণার তথ্য, বাংলাদেশে বছরে ১৫ হাজার শিশুর মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে। এর মধ্যে এক থেকে চার বছর বয়সী শিশু বেশি। দেশে অন্য যেকোনো কারণে মৃত্যুর চেয়ে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। প্রায়ই ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাড়ির পাশের পুকুর বা নদীতে খেলতে গিয়ে মারা যাচ্ছে ছোট ছোট শিশু। এরা মূলত পরিবারের বেখেয়ালের কারণে দুর্ঘটনার শিকার হয়।

তাই সবার আগে যা দরকার, তা হচ্ছে নিজে সতর্ক থাকা এবং পরিবারের সদস্যদের পানিতে নামার ব্যাপারে সতর্ক করা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আমাদের বেশির ভাগ মানুষের কোনো সচেতনতা নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন আমরা সতর্ক হই না? জীবনের মায়া কি নেই আমাদের? পানিতে নামার আগে অবশ্যই সব জেনে নামা উচিত। অনেকেই এটা জানে না যে ভাটার সময় সাগরে নামতে নেই। ফলে ভাটার সময় সাগরে নেমে অনেকেই জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। নদী সম্পর্কে বিশদ ধারণা না থাকলে তার পানিতে নামা বিপজ্জনক। বিশেষ করে সে নদী যদি হয় খরস্রোতা। কারণ, নদীর পানিতে ওপরের চেয়ে অনেক সময় নিচে স্রোতের বেগ থাকে বেশি। নদীর ঘূর্ণিতে যে টান থাকে, তা থেকে উদ্ধার পাওয়া দায়। ভরা বর্ষায় খরস্রোতা নদী খুবই বিপজ্জনক। কাজেই এ সময় বুঝেশুনে নদীতে নামা উচিত। আর নিতান্ত দায় না ঠেকল সংহার মূর্তিতে থাকা স্রোতস্বিনীর বুকে নামার দরকারটাইবা কী?

শুধু যে পানিতে নামার ক্ষেত্রে আমাদের এই অসতর্কতা, তা কিন্তু নয়। আমরা আরও অনেক ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করি না। রাজধানীর রাস্তাঘাটে প্রায়ই দেখা যায়, গাড়ি চলছে এমন সময় অনেক মানুষ রাস্তা পার হচ্ছে। উঁচু ভবনে নির্মাণশ্রমিকেরা কাজ করছেন কোনো সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়াই। হেলমেট ছাড়াই মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন অনেকে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, জীবনের চেয়ে বড় আর কিছু নেই। অসতর্ক থাকার কারণে কত প্রাণ ঝরে গেছে, কত মায়ের বুক যে খালি হয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কাজেই আসুন, আমরা সতর্ক হই এবং অন্যকে সতর্ক করি।

রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক