বিশ্বকাপ বিজয়ে শরণার্থী 'স্কোয়াড'

ফ্রান্সের বিশ্বকাপ বিজয়ের নায়ক এমবাপ্পেসহ ফরাসি দলে অভিবাসীরাই ছিলেন ৭৮ শতাংশ। ছবি: এএফপি
ফ্রান্সের বিশ্বকাপ বিজয়ের নায়ক এমবাপ্পেসহ ফরাসি দলে অভিবাসীরাই ছিলেন ৭৮ শতাংশ। ছবি: এএফপি

দীর্ঘ এক মাসের উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তা শেষে ফ্রান্স বিশ্বকাপ জিতে নিল। জিতল তো ফ্রান্স, কিন্তু নাগরিকত্বের পরিচয় যদি হিসাবের বাইরে রাখি, তবে অন্যভাবে বলা যায়, উদ্বাস্তু অভিবাসীরা বিশ্বকাপ জয় করলেন। সন্দেহ নেই, এই উদ্বাস্তুরাই ছিলেন এবারের বিশ্বকাপের মধ্যমণি।

এবারের বিশ্বকাপজয়ী ফরাসি দলের ২৩ জনের মধ্যে ১৫ জনই অভিবাসী ফুটবলার। এঁদের কারও মা-বাবা সাগর পাড়ি দিয়ে বা বিভিন্ন উপায়ে ফ্রান্সে এসেছিলেন বা কেউ কেউ নিজেরাই এসেছেন। যেমন স্যামুয়েল উমতিতি চাচার হাত ধরে ক্যামেরুন থেকে ফ্রান্সে পাড়ি জমিয়েছিলেন। শুধু এবার কেন, ১৯৯৮ সালে ফরাসি বিশ্বকাপজয়ী দলের ১২ জনই ছিলেন অভিবাসী। সেবার সেমিফাইনালে দুই গোল করা লিলিয়াম থুরাম কিংবা ফাইনালে গোলদাতা জিনেদিন জিদানও অভিবাসী। ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার হিসাব অনুসারে, এবারে বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া প্রধান ১০টি দলের ৮৩ জনই অভিবাসী খেলোয়াড়। ফরাসি দলে অভিবাসীদের পরিমাণ ৭৮ শতাংশ।

শরণার্থীরা কেন আসেন?
দুটো কারণেই শরণার্থীরা ইউরোপে আসেন। একটি হচ্ছে অর্থনৈতিক কারণ। আরেকটি হচ্ছে যুদ্ধ-ফ্যাসাদ। অর্থনৈতিক কারণে শরণার্থীরা কমবেশি আসতেই থাকেন। অর্থনৈতিক শরণার্থীদের আসাটা খুব বেশি চোখেও পড়ে না। কিন্তু সম্প্রতি লিবিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের কারণে ইউরোপে শরণার্থীদের ঢল নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। তাই অভিবাসননীতি কড়াকড়ির বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে। কিন্তু অভিবাসী বা শরণার্থী যা-ই বলি বলি না কেন, তাঁদের আগমনের জন্য ইউরোপসহ পশ্চিমারাই দায়ী। অনেকে মনে করেন, মানবিক কারণে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের শরণার্থীদের প্রবেশের সুযোগ দেওয়া উচিত। কিন্তু এটা দয়া বা করুণার বিষয় নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের শরণার্থীদের সুযোগ দিতে পশ্চিমারা বাধ্য। কারণ, বিভিন্ন দেশে অবৈধ যুদ্ধ তারাই চাপিয়ে দিয়েছে। সেই দায় তাদেরই চুকাতে হবে। যুদ্ধ এখন পশ্চিমা মোড়লদের বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। প্রথমে অস্ত্র ব্যবসা। পরে যুদ্ধ শেষে আবার পুনর্গঠনের নামে শুরু হয় অন্য ব্যবসা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে পশ্চিমা ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংগঠন ভিড় জমায়। আপাতভাবে মনে হতে পারে, যুদ্ধের কারণে পশ্চিমাদের হাজার হাজার বিলিয়ন ডলার ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু এসব যুদ্ধ থেকে তাদের আয় কত হচ্ছে—এই প্রশ্ন কেউ করে না। আইএসের নৃশংসতা নিয়ে সবাই সমালোচনা করে কিন্তু আইএসের অস্ত্রের উৎস কী, তাদের বিলাসী জীবনে অর্থ কোত্থেকে আসে, সেটার অনুসন্ধান কেউ করেনি।

আরেকটি কারণ হচ্ছে সস্তা শ্রম। অভিবাসীরা স্বল্প পয়সায় শ্রমঘন শিল্পে কাজ করে থাকেন। এ সস্তা শ্রমের যেমন চাহিদা রয়েছে, অন্যদিকে আফ্রিকা, এশিয়া বা দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশের দরিদ্র শ্রমিকের অর্থের প্রয়োজনও আছে। দুই পক্ষেরই লাভের হিসাব মিলে যাওয়ার কারণে অর্থনৈতিক শরণার্থীরা ইউরোপে প্রবেশ করে। বিষয়টি এমন না যে ইউরোপীয় দেশগুলো এসব জানে না। বরং দেখেও না দেখার ভান করে। চাহিদা অনুসারে অর্থনৈতিক শরণার্থীদের আসার সুযোগও করে দেয় বলা যায়।

শরণার্থী অভিবাসীরা কি অর্থনীতির জন্য উপকারী?
জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে যাওয়ায় ইউরোপের শ্রমবাজারে সবচেয়ে বেশি শ্রমিকের সরবরাহ করছেন অভিবাসীরা। গোটা ইউরোপে ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত নতুন শ্রমিক ও কর্মজীবীদের প্রবৃদ্ধির ৭০ শতাংশই ছিলেন অভিবাসী। অভিবাসীরা যেমন দ্রুত বর্ধনশীল শ্রম খাতে ভূমিকা রাখছেন, আবার পড়ে যাওয়া শিল্প খাতকেও উঠিয়ে আনায় অবদান রাখছেন। অভিবাসীদের দক্ষতার কারণে ইউরোপের মানবসম্পদ পুঁজির উন্নতি ঘটছে। একটি কথা প্রায়ই বলা হয় যে অভিবাসীদের জন্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু অর্গানাইজেশন অব ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) হিসাব অনুসারে, শরণার্থী অভিবাসীরা প্রাথমিক অবস্থায় রাষ্ট্র থেকে যে সুবিধা পান, পরে তার চেয়ে বেশি কর হিসাবে ফেরত দিয়ে থাকেন।

ইউরোপের অভিবাসননীতি পরিবর্তন করা জরুরি
উদ্বাস্তুদের নিয়ে আলোচনার কারণ সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) শরণার্থীবিষয়ক নতুন নীতি গ্রহণ। এই নতুন নীতি অনুসারে ইউরোপের দেশগুলোর সীমান্তে আরও কড়াকড়ি আরোপ করা হবে। ভূমধ্যসাগর দিয়ে আসা অভিবাসীদের যাচাই-বাছাই শেষে অযোগ্যদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে।

ইউরোপে শরণার্থীদের অভিবাসন নিয়ে কয়েক দশক ধরেই আলোচনা হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের চরম দক্ষিণপন্থী দলগুলো অভিবাসনবিরোধী। এরা মনে করছে, শরণার্থীদের কারণে তাদের জাতীয় ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। ফলে নাগরিক সুযোগ-সুবিধাও হ্রাস করছে সরকারগুলো। নতুন নীতি গ্রহণ ইইউয়ের অবস্থানকে বরং প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এখন সময়ে এসেছে শরণার্থী অভিবাসীদের ইউরোপে অবস্থান, শ্রমবাজার ও অর্থনীতিতে তাদের অবদান মূল্যায়ন করার। বিশেষ করে শরণার্থীরা কেন ইউরোপ আসছেন এবং ইউরোপ থেকে শুধুই কি গ্রহণ করছেন, না এখানকার অর্থনীতিতে তাঁদের অবদানও আছে, এ বিষয়গুলো সামনে আনা দরকার।

সময়-সময় সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করে অভিবাসন ঠেকানো যাবে না; বরং এতে করে পাচারকারীদের মানব-ব্যবসা আরও বেড়ে যাবে। বাস্তবিকভাবেই শ্রম চাহিদার কারণে অর্থনৈতিক শরণার্থীরা ইউরোপে আসতেই থাকবেন। শ্রমঘন শিল্পে শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে এবং ক্রমেই তা বাড়ছে। কিন্তু ইউরোপ এই শ্রমিকের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিকে ধরে রাখতে চাইলে শ্রমিক লাগবেই। এ ক্ষেত্রে অভিবাসননীতির পরিবর্তন করে শ্রমিক আগমনের সুযোগ করে দেওয়া দরকার। তাহলে ইউরোপ শ্রমবাজার উন্মুক্ত করে দিচ্ছে না কেন? বা দক্ষ শ্রমিক আমদানি করছে না কেন? এখানেই রয়েছে ইউরোপীয়দের চতুরতা। প্রথমত, সরাসরি শ্রমিক হিসেবে আসার সুযোগ দিলে ইউরোপের শ্রম আইন অনুসারে সুবিধা দিতে হবে। এতে করে শ্রমব্যয় বেড়ে যাবে। অন্যদিকে, অর্থনৈতিক শরণার্থী হিসেবে যাঁরা আসেন, তাঁদের অনেকই স্বল্প পয়সায় কাজ করেন। কম পয়সায় বেশি কাজ করে দেওয়ার বিষয়টি ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোও জানে। নিজস্ব স্বার্থের কারণেই ইউরোপীয়রা এসব নিয়ে খুব বেশি উচ্চবাচ্য করছে না। মূল বিষয় হচ্ছে ভদ্রতা, মানবাধিকার, সমঅধিকারের কথা বলে ইউরোপও শ্রম শোষণ করছে। আগে দাস হিসেবে নিয়ে আসা হতো, এখন শরণার্থী হিসেবে নিয়ে আসা হয়; এই যা পার্থক্য।

অভিবাসীদের নিয়ে ইউরোপে এখন নানা সমস্যা। এদের ধর্ম, পোশাক, সংস্কৃতি নিয়ে সমালোচনা হয়, কিন্তু অভিবাসীদের সস্তা শ্রম নিতে অসুবিধা হয় না। তাদের দিয়ে বিশ্বকাপ জিততেও কোনো সংকোচ নেই। অভিবাসননীতি নিয়ে ইউরোপীয়দের দ্বিচারিতা ও কপটতার মুখে যেন সজোরে চড় কষে দিয়েছে এবারের বিশ্বকাপ ফুটবল। ফ্রান্স দুবারই বিশ্বকাপ জিতল অভিবাসীদের কাঁধে চেপে। এবারের বিশ্বকাপে অভিবাসী ফুটবলারদের ব্যাপক মাত্রায় অংশগ্রহণই ইইউকে বুঝিয়ে দিল, অভিবাসীরা ফুটবল ছাড়াও ইউরোপের অন্যান্য খাতে নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত। ওইসিডির হিসাব অনুসারে দ্বিতীয় প্রজন্মের অভিবাসীদের মধ্যে শিক্ষার হার ও বিভিন্ন পেশায় অংশগ্রহণ বড়ছে। একদিন যদি ইউরোপের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো অভিবাসীদের দখলে চলে যায়, তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বিশ্বকাপ ফাইনাল শেষে অনেকেই এমবাপ্পে, পগবা, উমতিতি বা মাতুইদির উল্লাস দেখেছেন, কিন্তু এ ছিল উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ। এটা ইতিহাসের প্রতিশোধ।

ড. মারুফ মল্লিক, ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন