পাকিস্তান টিভিতে বহু বছর প্রযোজকের কাজ করে আমার কতটা লাভ হয়েছে, তা জানি না। কিন্তু এটুকু জেনেছি, এই অভিজ্ঞতা আমাকে একটা অনন্য উপহার দিয়েছে। সেটি হলো নতুন দৃষ্টি। নতুন করে দেখার ক্ষমতা। নতুন চোখ।
একজন অভিনেতা, অভিনেত্রী কিংবা সংগীতশিল্পী যখন দর্শক-শ্রোতার সামনে পারফর্ম করেন, তখন বহু লোক মুগ্ধ হয়। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও পরিবেশনার জাদুর জালে তারা আটকা পড়ে যায়। মন্ত্রমুগ্ধ হওয়া লোকগুলো তাঁকে অনুকরণ করার চেষ্টা করে। সুযোগ পেলে তারা তাঁর সঙ্গে ছবি তোলে। সেই ছবি তারা যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখে।
১৯৭৩ সালে টিভিতে যোগ দেওয়ার আগে আমিও এই ধরনের মন্ত্রমুগ্ধতার রোগে আক্রান্ত একজন মানুষ ছিলাম। কিন্তু টিভিতে যোগ দেওয়ার পর এই তারকাদের রহস্য আমার সামনে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। তখন তাঁরা আর আমার কাছে বিশেষ কেউ ছিলেন না। বরং এমন সব লোক আমার কাছে বিশেষ মানুষ হয়ে উঠেছিলেন, যাঁরা সমাজের চোখে অনেক অবহেলিত ও উপেক্ষিত।
এ রকম উপেক্ষিত, অবহেলিত বিশেষ মানুষ সবচেয়ে বেশি দেখেছি বিদেশের মাটিতে। যখন কেউ বিশ্বের সব জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র ঘুরতে যান, তখন এ ধরনের মানুষের সঙ্গে তাঁর বেশি দেখা হয়। স্পেন ভরা এই ধরনের লোক। উদ্বাস্তু লোকের বেশির ভাগই কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান। দুটো টাকা রোজগারের জন্য তাঁরা কী না করেন?
স্পেনের সি বিচে গেলে অনেক ‘দোকানদার’ চোখে পড়ে। মাটিতে বিছানো একটুকরো কাপড়েই তাঁদের ‘দোকান’। কাপড়টা মাটিতে বিছিয়ে তাঁরা নকল জিনিসপত্র বেচেন। তাঁরা বলেন, এগুলো আসল জিনিস। এসব জিনিসের দুই ধরনের দাম। প্রথম তাঁরা যে দাম চান, সেটা অনেক চড়া। দরাদরি করলে সেই দাম অর্ধেকের নিচে নেমে আসে। স্পেনে আমার অ্যাপার্টমেন্টের কাছের সৈকতজুড়ে এ রকম অসংখ্য দোকান। স্পেনের আইন অনুযায়ী সৈকতে দোকান বসানোর অধিকার তাঁদের নেই। পুলিশ মাঝেমধ্যেই সেখানে অভিযান চালায়। অনেককে গ্রেপ্তার করে। অনেকের মালামাল নিয়ে যায়। পুলিশ বলে কাউকে একটু সন্দেহ হলেই এসব দোকানদার জিনিসপত্র কাপড়ের পুঁটলিতে বেঁধে এক দৌড়ে পালিয়ে যান।
একদিন আমি এক দোকানদারের কাছে গিয়ে বসে ছিলাম। গল্পগুজবও শুরু করেছিলাম। তিনি আমাকে পেয়ে বেজায় খুশি। তিনি বললেন, ‘আমি এখানে ১০ বছর ধরে জিনিসপত্র বিক্রি করি। এই প্রথম কোনো ইউরোপিয়ান (আমাকে তিনি ইউরোপিয়ান ভেবেছিলেন) আমার সঙ্গে বসে বন্ধুর মতো গল্প করছে।’ গল্প একটু জমে উঠতেই তিনি আমাকে জানালেন, তাঁর নাম মাহমাদো। এসেছেন সেনেগাল থেকে। সেনেগালের একটা প্রত্যন্ত পল্লিতে তাঁর পরিবার থাকে।
যখন তাঁর পরিবারের সদস্যসংখ্যা বাড়ল, তখন আয়-রোজগারে কুলাচ্ছিল না। না খেয়ে মরার দশা হয়েছিল। পরিবার-পরিজনকে বাঁচাতে মাহমাদো স্পেনে আসার পরিকল্পনা করেন। দালালের মাধ্যমে অবৈধভাবে স্পেনে আসার জন্য তিনি তাঁর একখণ্ড জমি বেচে দেন। কয়েক বছর তীব্র দারিদ্র্য ও অপমানকর জীবন কাটানোর পর এই ব্যবসায় নামেন। তিনি চীনে তৈরি নকল লেডি ব্যাগ বেচেন। সারা দিন পর্যটকদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে কিছু মাল বেচতে পারলে দিনে ২০ ইউরোর মতো থাকে। পাঁচজনে ছোট একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন। তাঁকে মাসে ভাড়া গুনতে হয় ২৫ ইউরো।
সেনেগালে মাহমাদোর পরিবারের সাতজন সদস্য ভুখা পেটে তাঁর টাকা পাঠানোর আশায় বসে থাকে। তাদের দুবেলা দুমুঠো খাবার তুলে দেওয়ার জন্য তাঁকে মাসে দেড় শ ইউরো পাঠাতেই হয়। যে মাসে দেড় শ ইউরো কামাই করতে পারেন না, সে মাসে তাঁকে ধারদেনা করতে হয়। নিজের সব সাধ-আহ্লাদ জলাঞ্জলি দিয়ে তাঁকে টাকা জমিয়ে বাড়ি পাঠাতে হয়। তাঁর চারপাশে যে পর্যটকেরা আসেন, তাঁরা কত রকম আমোদ করেন! তাঁকে খালি পেটে উপোস করে থাকতে হয়।
প্রতিদিনই মাহমাদো বাড়ি ফেরার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু শূন্য পকেট। দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া তাঁর আর কিছু করার থাকে না। বহুদিন পরপর অনেক কষ্ট করে যাতায়াতের ভাড়া জোগাড় করতে পারলেও বাড়ি পৌঁছানোর পরের খরচ তিনি জোগাড় করতে পারেন না। সেনেগালের মাটিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সব জোঁকের মতো তাঁকে ছেঁকে ধরে। ইউরোপীয় ঠাটবাট ধরে রাখার জন্য তাঁকে খরচাপাতি করতে হয়। পয়সা খসানোর জন্য সবাই তাঁর চারপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে। বেড়ানো শেষে স্পেনে যখন তিনি ফিরে আসেন, তখন তাঁর অবস্থা হয় পালক উঠে যাওয়া পাখির মতো, যার ডানা আছে কিন্তু ওড়ার ক্ষমতা নেই।
এসব বলতে বলতে মাহমাদোর চোখ ছলছল করে। তিনি বলেন, ‘আমরা তো ক্রীতদাস! এটা আমাদের কপালের লিখন। আমেরিকা থেকে সাদা মানুষেরা এসে প্রথম আমাদের ক্রীতদাস বানিয়েছিল। এখন আমরা ক্রীতদাস হওয়ার জন্য নিজেরাই সাদাদের কাছে আসি। আমরা হচ্ছি সেই ক্রীতদাস, যাদের গায়ে সব সময় অনেকগুলো জোঁক সেঁটে থাকে। এই জোঁকগুলো হচ্ছে আমাদের নিজ দেশে ফেলে আসা বুভুক্ষু স্বজন।’
আমি মাহমাদোর কথা শুনে চারপাশে তাকালাম। দেখলাম, আমার চারপাশে তাঁর মতো লাখ লাখ ক্রীতদাস অগণিত জোঁক গায়ে লাগিয়ে এখানে-ওখানে দুটো পয়সার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছেন। উন্নত বিশ্বে লাখ লাখ ক্রীতদাস সাজা খাটার মতো পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
এই বিদেশবিভুঁইয়ে এসে মাহমাদোর মতো ক্রীতদাসেরা প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে নিজেদের বলি দেন। এখানে যদি তাঁরা চিৎকার করেও মরেন, সেই কান্না শোনার কেউ নেই। কারণ, আপন বলে এখানে কেউ নেই। এসব ক্রীতদাসের মধ্যে পাঞ্জাবি, বাংলাদেশি, ভারতীয়, আফ্রিকান, লাতিন আমেরিকান—অনেক ধরনের মানুষ আছেন। মাঝেমধ্যে এই পোড়াকপালের মানুষগুলোর মায়েদের কথা মনে হয়। মনে হয় তাঁরা সন্তানদায়ী জননী নন, তাঁরা ক্রীতদাস উৎপাদনের কারখানা।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
সৈয়দ আসিফ শাহকার ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি এবং সে সময়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় কারা–নির্যাতিত